ভূতের রাজার কারবারেই
বালাজির বাড়বাড়ন্ত
এক অন্য পর্যটন!
স্বাস্থ্য-পর্যটন থেকে ইকো-পর্যটনের অনেক স্বাদ চেখে দেখেছেন পর্যটকেরা। এটা ভূত পর্যটন।
রাজস্থানের দৌসা জেলার জয়পুর-আগরা সড়কের উপর মেহেন্দিপুরের বালাজি মন্দির। কথিত আছে, এখানেই নাকি জন্ম হয়েছিল পবন-পুত্রের।
কিন্তু তার সঙ্গে ভূতের কী সম্পর্ক? জনশ্রুতি বলে, যেখানে মন্দিরটি রয়েছে ঠিক সেই জায়গায় হাজার বছর আগে এক রাজা খুন হন। রাজার অতৃপ্ত আত্মা বারংবার বালাজির কাছে এসে মুক্তির আবেদন জানাতে থাকে। রাজার প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে বালাজি এখানে নিজের দরবার বসানোর সিদ্ধান্ত নেন। অতৃপ্ত আত্মা ও ভূতে পাওয়া মানুষদের বিচার করার ভার নেন তিনি। নিজের দরবার যথাযথ ভাবে চালানোর জন্য প্রেতরাজ ও ধর্মরাজকেও নিয়োগ করেন। সেই থেকে মন্দিরটির নীচের তলায় বালাজি ও ভৈরোঁজি-র (শিব) অধিষ্ঠান। আর দোতলার মালিক হলেন ধর্মরাজ ও প্রেতরাজ অর্থাৎ ভূতেদের রাজা। মন্দির কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘ভূতে পাওয়া’ মানুষরা এখানে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে যান। আর সেই কারণেই মেহেন্দিপুরে পর্যটকের ঢল!
বাংলা সাহিত্যে এমন ভূত ছাড়ানোর থান বা মাজারের বহু উল্লেখ আছে। বীরভূমে এমন বহু থান আছে। ফুরফুরা শরিফে জল-পড়া দেওয়া হয়। বিহারের ঔরঙ্গাবাদ জেলাতেও এই ধরনের মন্দির রয়েছে। কিন্তু সেগুলির নামডাক মেহেন্দিপুরের তুলনায় কিছুই নয়। উত্তর বা পশ্চিম ভারত তো বটেই, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে রুগিরা আসেন চিকিৎসা করাতে।
মন্দির চত্বরে গেলেই দেখা যাবে, এবড়োখেবড়ো রাস্তার উপর বসে বা শুয়ে রয়েছেন একাধিক বিভিন্ন বয়সী মহিলা। ভোরের ভজনের সুরে দোলা লেগেছে তাঁদের শরীরে। কারও শরীর ঘুরছে কোমর থেকে। কেউ বা হেঁটমুণ্ড হয়ে ঘুরিয়ে চলেছেন আলুলায়িত কেশরাজি। মন্দিরের লোহার ফটক ধরে লাট্টুর মতো পাক খেয়ে যাচ্ছিলেন এক মধ্যবয়সী মহিলা। হরিয়ানার বাসিন্দা। বেশ ছিলেন। হঠাৎ এক দিন মাঝরাত থেকে শুরু এই আছাড়ি-পিছাড়ি খাওয়া। ডাক্তার-বদ্যি ব্যর্থ। বাড়ির লোক নিয়ে এসেছেন ভূতের রাজার বিধান নিতে। এখন আর পাঁচটা মহিলার সঙ্গে তাঁরও ‘পেইশি’ হবে।
“পেইশি মানে?” বুঝিয়ে দিলেন মন্দির সংলগ্ন দোকানদার শিউচরণ। রুগিদের শরীরে যে ‘বুরি আত্মা’ রয়েছে বালাজি তাদের শরীর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আত্মারা বেরোতে চাইছে না। এমতাবস্থায় রুগির পরিবার বালাজিকে ডাল-চাল ও লাড্ডু উৎসর্গ করেন। পুরোহিত সেই লাড্ডু বালাজির বিগ্রহে ঠেকিয়ে তা মন্ত্রপূত করে খেতে দেন রুগিকে। পুরোহিতদের বক্তব্য, ওই প্রসাদী লাড্ডু খেলে রুগির শরীরের ভূত বা দুষ্ট আত্মা বালাজির দরবারে ‘পেইশি’ বা উপস্থিতি দিতে বাধ্য করে।
মন্দির কর্তৃপক্ষের দাবি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওই লাড্ডু খাওয়ার পরেই দুষ্ট আত্মারা শরীর ছাড়তে ব্যগ্র হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে পুরোহিতেরা ওই ভূত বা আত্মাকে আর কোনও দিন সেই শরীরে ফিরে না আসার নির্দেশ দিয়ে মুক্ত করে দেন। আর যদি এত কাণ্ডের পরেও ভূত শরীর থেকে বার না হয় তখন গোটা প্রক্রিয়াটি নতুন করে পরের দিন শুরু হয়। সে ক্ষেত্রে বাড়তে থাকে পুজো ও প্রণামীর পরিমাণ।
২০১৩ সালেও তন্ত্র-মন্ত্র-ঝাড়ফুঁকে এমন অচলা ভক্তির রহস্য? অনেকেই একটা জিনিস খেয়াল করতে বলেন। তথাকথিত ভূতের শিকার এই মহিলারা মূলত নিম্ন মধ্যবিত্ত। উত্তরপ্রদেশ-রাজস্থান-হরিয়ানা-মধ্যপ্রদেশ-বিহার থেকেই ‘রুগি’ আসে বেশি। চেহারা-ছবিতে যাদের দৈন্যে-অশিক্ষার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে আসা বছর তিরিশের এক যুবককেও দেখলাম। তাঁদের দু’জনেরই পরনে কিন্তু দামি জিন্স-টি শার্ট।
শুধু অশিক্ষা আর দৈন্য দিয়ে সব ব্যাখ্যা মেলে না মেহেন্দিপুরে। বালাজি মন্দিরের রুগিদের নিয়ে দীর্ঘ দিন গবেষণা চালান সমাজ-মনোবিদ সুধীর কক্কর। তিনি ‘শমন মিস্টিক অ্যান্ড ডক্টরস’ বইতে বলছেন, বালাজির মন্দিরে আগত অধিকাংশ মহিলা হিস্টেরিক্যাল ডিসঅর্ডার-এর শিকার। এর পিছনে ওই মহিলাদের দীর্ঘ দিনের জমা ক্ষোভ, অসহায় রাগকেই প্রধান কারণ হিসাবে তুলে ধরেছেন কক্কর। ওই সব মহিলাদের উপর দীর্ঘ দিনের আরোপিত কড়া বিধিনিষেধই, তাঁর মতে অবদমিত সামাজিক বা যৌন ইচ্ছা বিকৃত রূপে ফুটে বেরোয়।
ভূতের রাজা রুগিদের সুস্থ করেন কী করে? কক্কর বলছেন, রুগিদের সুস্থ হওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ, তাঁদের নিজের উপরে বিশ্বাস ফিরে আসা। সাধারণত স্থানীয় চিকিৎসক-ওঝা-পীর-ফকিরের কাছে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পরেই বালাজির কাছে আসার সিদ্ধান্ত নেয় রুগির পরিবার। ফলে রুগিরা মানসিক ভাবে এক আধ্যাত্মিক সফরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেটাই তাঁকে মানসিক বৈকল্য থেকে বেরিয়ে আসার শক্তি জোগায় বলে কক্করের অভিমত।
এ হেন প্রেতরাজ মহারাজের দরবার দোতলায়। লৌহবেষ্টনীর মধ্যে রুপোর চাদরে মোড়া বিগ্রহ। বুকের কাছে জ্বলজ্বলে চোখ। যজ্ঞের আগুনে মাঝেমধ্যে ঘি-কর্পূর দিচ্ছেন পুরোহিত। সেই শিখার সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো কষ্টকর। তার মধ্যেই সুর করে হনুমান চল্লিশা পাঠ করছেন এক যুবক। ভূতের রাজাকে ভাত আর কলাইয়ের ডাল পুজো চড়িয়ে এসে সেই গানে ধুয়ো দিচ্ছেন রুগির আত্মীয়েরা। গোটা ঘর ভরে গিয়েছে বিভিন্ন বয়সী মহিলায়। কেউ ডিগবাজি খাচ্ছেন, কারও শরীর মাটিতে কিন্তু পা আকাশের দিকে! যাদের ‘পেইশি’ চলছে তাদের এনে দাঁড় করাচ্ছেন আত্মীয়রা। পুরোহিতের মাধ্যমে চলছে শাস্তিবিধান।
“বৈঠ জাও, খাড়া মৎ রহো!” দেওয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম এক কোণে। খোনা গলায় কথাটা বলেই কিশোরীর মতো খিলখিল করে হেসে উঠলেন লোলচর্ম এক বৃদ্ধা। সত্যিই এঁদের ভূতে ধরেছে? নাকি গোটাটাই মন্দির কর্তৃপক্ষের কারসাজি! ডালি-বিক্রেতা শিউচরণ ফিসফিস করে বললেন, “কিছু তো লোক দেখানো ব্যাপার আছেই। কিন্তু সত্যি ভাল হয়ে গিয়েছে এমন ঘটনাও রয়েছে। নইলে সুদূর বাঙ্গাল থেকেও লোকে কেন আসবে বলুন!”
মন্দির চত্বরে কয়েক বছর আগে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত রুগিদের। কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি ওঠায় বর্তমানে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাতে ভিড় কমেনি। বর্ষার সময়টুকু বাদ দিলে ধর্মশালা পাওয়া মুশকিল।
মেহেন্দিপুরের স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ এখনও ভূতের রাজার হাতেই!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.