|
|
|
|
সরকারি অফিসে ছুটির মেজাজে নিশিযাপন |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
একেবারেই চড়ুইভাতির মেজাজ। এক দিকে স্টোভে ভাত ফুটছে, বড় গামলায় নামিয়ে রাখা হয়েছে ডিম সেদ্ধ। তারই কয়েক হাত দূরে মাটিতে বিছানা পাতার তোড়জোড়। সঙ্গে দেদার গান-বাজনা, তাস খেলা আর জমাটি আড্ডা। সাধারণ ধর্মঘটের আগের রাতে এটাই খাদ্য ভবনের টুকরো ছবি।
মঙ্গলবার সাধারণ ধর্মঘটে যাতে অফিস করা যায়, সে জন্য দূর থেকে আসা খাদ্য দফতরের বহু কর্মী সোমবার ছুটির পরে আর বাড়ি যাননি। থেকে গিয়েছেন নিজের অফিসেই। এবং সেই সূত্রেই অফিস চত্বরে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। আয়োজক স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশন (ইউনিফায়েড)। ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সমীরণ রায় বলেন, “কলকাতার বাইরে থেকে যাঁরা অফিসে আসেন, মূলত তাঁদেরই খাদ্য ভবনে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সংখ্যাটা কম করে ৬০০ তো হবেই।” এমনই এক জন, পাঁচলার বাসিন্দা অশোক ঘোষ। ৩১ বছরের চাকরি জীবনে এই প্রথম রাতে থাকছেন অফিসে। বললেন, “গাড়ি চলবে কি না জানি না। সরকার বলছে, না এলে চাকরিতে ছেদ পড়বে। সেই ভয়ে আমার মতো অনেকেই এখানে রাত কাটাচ্ছেন।” |
|
রাত কাটানোর প্রস্তুতি। সোমবার মহাকরণে অর্থ দফতরে তোলা রাজীব বসুর ছবি। |
শুধু খাবারই নয়, রয়েছে বিনোদনের ব্যবস্থাও। অস্থায়ী রান্নাঘর লাগোয়া শেডে বসেছে গান-বাজনার আসর। কর্মীরা বলেন, “সকালের দিকে বাংলা ব্যান্ড এসেছিল। এ বেলা আমরা নিজেরাই যা পারছি করছি।” রাতের খাবারের মেনু অবশ্য খুবই সাধারণ। ভাত, মুগের ডাল, আলুভাজা ও ডিমের ঝোল। রাত ৯টা নাগাদ খাদ্য ভবনে গিয়ে দেখা যায়, ইলেকট্রিক্যাল ডিউটি রুমের সামনে ২ নম্বর শেডে সারি দিয়ে স্টোভ জ্বলছে। তার কোনওটায় ভাত ফুটছে, কোনওটায় ডাল। ডিমের ঝোলের গন্ধে ম ম করছে চারদিক। কর্মীরা জানালেন, একটু দেরিতেই রান্না শুরু হয়েছে। তাই একসঙ্গে ছ’টি স্টোভে রান্না বসানো হয়েছে। না হলে খাওয়াদাওয়া শেষ হতে রাত ১টা হয়ে যাবে। এর মধ্যেই খাদ্য দফতর সূত্রের খবর, ধর্মঘটের দিন কাজে যোগ দিতে আগের রাতে অফিসেই থাকতে চেয়েছিলেন অনেক মহিলা কর্মী। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে সেই আর্জি মঞ্জুর করা হয়নি।
মহাকরণের অনেক কর্মীই সোমবার অফিসে এসেছিলেন টুথপেস্ট, গামছা সঙ্গে নিয়েই। কিন্তু সব কিছুই ছিল আড়ালে। মুখে বলা হচ্ছিল, ‘সরকারি অনুমতি না মিললে কেউই রাতে মহাকরণে থাকবেন না। দূরে যাঁরা থাকেন, কাছাকাছি কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে রাত কাটিয়ে সকালে অফিসে চলে আসবেন।’
সোমবার সাড়ে চারটে নাগাদ রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষের ঘোষণার পরে তাতে সরকারি সিলমোহর পড়ে। মুখ্যসচিব বলেন, “দু’একটি কর্মী সংগঠন থাকতে চেয়েছিল। তাঁদের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। পূর্ত দফতরকে বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে। যাঁরা থাকতে চান, তাঁরা অফিসঘর, করিডর, যেখানে খুশি থাকতে পারেন।” তিনি বলেন, “এই নির্দেশ ধর্মঘটের জন্য দেওয়া হয়েছে। অন্য দিন কেউ দিঘা যাওয়ার জন্য রাতে থাকতে চাইলে তা অবশ্যই অনুমোদন করা হবে না।”
মহাকরণের কেয়ারটেকার অফিস সূত্রে খবর, কংগ্রেস আমলেও রাতে থাকার ঘটনা ঘটেছে। বাম আমলেও দু’এক বার কিছু কর্মী ছিলেন। তবে কর্মীদের রাখতে সরকারের এই তৎপরতা আগে কখনও দেখা যায়নি। মুখ্যসচিবের ঘরে এ দিন দুপুরে সরকারি অফিসারদের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। তার পরেই পূর্ত দফতরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার বিবেক রাহা রাজ্যের সমস্ত সরকারি অফিসে নির্দেশিকা পাঠান। তাতে বলা হয়েছে, “আজ রাতে সমস্ত সরকারি অফিসে জল এবং বিদ্যুতের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে। যাতে যে সব কর্মী রাতে থেকে যেতে চাইছেন, তাঁদের কোনও অসুবিধে না হয়।”
এই নির্দেশ বেরনোর পরেও অবশ্য প্রতিদিনের মতো কো-অর্ডিনেশনের অফিস সন্ধ্যা সাতটায় বন্ধ হয়ে যায়। আইএনটিইউসি অনুমোদিত কর্মী সংগঠন ইউনাইটেড স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের ঘরেও সন্ধ্যায় তালা পড়ে যায়। সংগঠনের নেতা সুব্রত ভট্টাচার্যের দাবি, “মুখ্যমন্ত্রী নিজে আশ্বাস দিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এর পরে রাতে থাকার অর্থ, তাঁর প্রতিই অনাস্থা দেখানো। আমরা কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আস্থা রাখছি।” যদিও সরকারি নির্দেশ মেলার পরেই তৎপরতা শুরু হয়ে যায় তৃণমূল সমর্থিত কর্মী সংগঠনগুলির অফিসে। ক্যান্টিনগুলিতে শুরু হয়ে যায় তরকারি কাটা। বাজার থেকে ক্রেট ক্রেট ডিম আসে। ফের গ্যাস জ্বেলে বসানো হয় রান্না। রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে তো! মহাকরণের ক্যান্টিনে সোমবার রাতে ছিল দু’রকম মেনু: রুটি, আলুভাজা, ডিমের ঝোল অথবা ভাত, বাঁধাকপির তরকারি, ডিমের ঝোল। নিজেদের বিভাগে টেবিল জোড়া দিয়ে বিছানা পাতেন কর্মীরা। মহাকরণের মতোই নব মহাকরণ, শিল্প ভবন, সল্টলেকের ময়ূখ ভবন, জল-সম্পদ, পূর্ত, বিদ্যুৎ, উন্নয়ন ভবনে বিকেল থেকেই অন্য সব কাজ শিকেয় উঠেছে। শুরু হয়ে গিয়েছে নিশিযাপনের প্রস্তুতি, তৃণমূল সমর্থিত এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের নেতৃত্বে। তবে নেতৃত্বের দাবি, সল্টলেকের প্রতিটি সরকারি অফিসে গড়ে ২৫০ জন কর্মচারী থাকবেন। সব মিলিয়ে বিধাননগরে দেড় থেকে দু’হাজার কর্মী অফিসে রাত কাটাতে চলেছেন। |
|
|
|
|
|