|
|
|
|
ধর্মঘট না করার অধিকারও মানল সিপিএম |
অনিন্দ্য জানা • কলকাতা |
ধর্মঘটে ‘ধর্মযুদ্ধে’ নামছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিরোধী নেত্রী হিসেবে বন্ধ-অবরোধের রাজনীতি বর্জন-করা মমতা ‘প্রশাসক’ হিসেবে আজ, মঙ্গলবার তাঁর শাসনকালে প্রথম সাধারণ ধর্মঘটের মোকাবিলায় নামবেন। কর্মনাশা বন্ধ-সংস্কৃতি থেকে রাজ্যকে মুক্ত করার যে লড়াই তিনি শুরু করেছিলেন, ফলিত স্তরে তার প্রথম প্রয়োগ দেখতে পাবেন রাজ্যবাসী।
অন্য দিকে সিপিএম।
এই প্রথম ‘বিরোধী’ হিসেবে বন্ধের পৃষ্ঠপোষকতা (কারণ, দেশ জুড়ে সাধারণ ধর্মঘট আসলে ডেকেছে সিটু-সহ অন্যান্য শ্রমিক সংগঠন) করতে হচ্ছে তাদের। যে বন্ধে ‘সরকারি সাহায্য’ নেই। বরং রয়েছে সরকার ও শাসকদলের তরফে ‘সর্বাত্মক’ বিরোধিতা।
বন্ধ ‘সফল’ করতে তাঁরা যে রাস্তায় নামবেন না, সোমবার তা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন বিরোধী দলনেতা তথা সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র। বলেছেন, “ধর্মঘট কারও উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। আমরা সেই কাজ করতে রাস্তায়ও নামব না। আমাদের কথা হল, যাঁরা ধর্মঘটে যোগ দিতে চান, তাঁদের অধিকার আছে। তাঁরা নির্ভয়ে যোগ দিন। আবার যাঁরা ধর্মঘটে যোগ দিতে না-চান, তাঁদেরও যোগ না-দেওয়ার অধিকার আছে।”
সূর্যবাবুর এ দিনের বক্তব্য যথেষ্ট ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। কারণ, সম্ভবত এই প্রথম সিপিএমের কোনও শীর্ষ নেতা ধর্মঘটে যোগ না-দেওয়ার ‘অধিকারে’র কথাও বললেন। বললেন, ধর্মঘট কারও উপর ‘চাপিয়ে’ দেওয়া যায় না। অথচ, এত দিন সিপিএম রাজ্যবাসীর উপর ধর্মঘট ‘চাপিয়ে’ই দিয়ে এসেছে! এ দিন দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যও জানিয়েছেন, দলীয় স্তরে তাঁদের নির্দেশ, শান্তিপূর্ণ ভাবে মানুষের কাছে ‘আবেদন’ করতে। কেউ মানতে না-চাইলে যেন জোর খাটানো না-হয়। অর্থাৎ, সূর্যবাবুর কথার প্রতিধ্বনি। অর্থাৎ, ধর্মঘট না-করার ‘অধিকার’কেও মর্যাদা দেওয়া। |
কেউ জোর করে বন্ধ করার চেষ্টা করলে এমন শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর সে বন্ধ করার কথা না ভাবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
যাঁরা ধর্মঘটে যোগ দিতে চান, নির্ভয়ে যোগ দিন। যাঁরা চান না, তাঁদেরও ধর্মঘটে যোগ না-দেওয়ার অধিকার আছে।
সূর্যকান্ত মিশ্র |
|
ধর্মঘটে সিপিএমের এই ‘আপাত-নিষ্ক্রিয়তা’র পিছনে মূলত দু’টি কারণ রয়েছে বলে আলিমুদ্দিন সূত্রের খবর। প্রথমত, সিপিএম মনে করে, গত ন’মাস তারা যে ভাবে ‘সংযমী বিরোধী’র ভূমিকা পালন করছে, তাতে তাদের ‘রাজনৈতিক ফায়দা’ হচ্ছে। ব্রিগেড সমাবেশের ভিড়ের বহরেই তার প্রমাণ মিলেছে। এই পরিস্থিতিতে বন্ধে ‘আগ্রাসী’ ভূমিকায় নামলে হিতে-বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা। দ্বিতীয়ত, আলিমুদ্দিনের শীর্ষ নেতৃত্বের একটা বড় অংশের কাছে বন্ধ-ধর্মঘট-অবরোধ নিয়ে সিটুর ভূমিকা ‘সন্তোষজনক’ নয়। মাঝেমধ্যে ‘বিরক্তি উদ্রেককারী’। কিন্তু দলের শ্রমিক সংগঠন হওয়ায় তাদের কার্যকলাপ মেনে না-নিয়েও উপায় থাকে না সিপিএমের। কিন্তু মেনে নিয়েও এ বার সিপিএম নেতৃত্ব একটা ‘দূরত্ব’ বজায় রাখছেন। বুঝেসুঝেই ‘জোর’ খাটানোর রাস্তায় যাচ্ছেন না। সেই ‘তাগিদ’ তাঁদের নেই।
শাসক শিবির থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে ‘তাগিদ’ না-থাকতে পারে। কিন্তু নিশ্চিত ভাবে সেই ‘তাগদ’ নেই। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “এত দিন ওদের ডাকা ভারত বন্ধে সারা দেশে কাজ হয়েছে। কিন্তু সরকারি মদতে রাজ্যে বন্ধ সফল হয়েছে। এ বার সেই ছবি দেখা যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই বুঝেই সিপিএম সুর পাল্টেছে।” প্রসঙ্গত, ধর্মঘটের দিন কাজে না-এলে ছুটি নেওয়া যাবে না বলে নির্দেশ জারি করেছে সরকার। শাসক দলের মতে, যা বন্ধ-মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রীর ‘সদিচ্ছা’রই পরিচায়ক।
সূর্যবাবু বলছেন, “বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন ধর্মঘটে সরকারের যা ভূমিকা নেওয়ার ছিল, তা-ই নেওয়া হত। সরকারি কর্মচারীরা ধর্মঘটের দিন ছুটির আবেদন করতেন। তাঁদের সেই আবেদন মঞ্জুর করা হত। ছুটি না-নিয়েই তাঁরা কাজে এলেন না, এমন হত না। তাঁদের ছুটির কোটা থেকে এক দিন কাটা যেত। কিন্তু ছুটি চাইলেও ছুটি দেওয়া হবে না, এ কথা আমরা কোনও দিন বলিনি। এই কথা বলার মধ্যে থেকেই কর্মচারীদের অধিকারের প্রতি এই সরকারের মনোভাব, তাদের চরিত্র স্পষ্ট হয়ে যায়!” |
মুখ্যমন্ত্রী বললেন |
• না এলে সার্ভিস ব্রেক হবে, নিয়ম আছে
• মানুষকে আশ্বস্ত করছি, গণ্ডগোল হবে না
• রাস্তা জুড়ে মিছিল করতে দেওয়া হবে না
|
• বেসরকারি গাড়ি ভাঙা হলে বিমার টাকা পাবেন
• দয়া করে সিপিএমে প্ররোচনায় পা দেবেন না
• ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে থাকবেন না |
বিরোধী দলনেতা বললেন |
• প্ররোচনা দেব না। তবে প্ররোচিত হতেও বারণ করছি |
|
প্রশাসন সচল রাখতে |
• সরকারি কর্মীরা অফিসে না এলে দাগ পড়বে সার্ভিসবুকে
• স্কুলে-কলেজে শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মীদের ছুটি নামঞ্জুর
|
পরিবহণ সচল রাখতে |
• সরকারি পরিবহণকর্মীরা না এলে চাকরিতে ছেদ
• বেসরকারি পরিবহণ মালিকদের সরকারি হুঁশিয়ারি কতটা সচল
• মেট্রো, লোকাল ট্রেন, সরকারি বাস-ট্রাম সূচি মেনেই
|
• বিমান চলাচলে কোনও বদল নেই
• বাস-মিনি-অটোর মালিকরা দ্বিধায়
• ট্রাক মালিকদের অধিকাংশই না চালানোর পক্ষে |
সমস্যায় ফোন |
মহাকরণ
• কন্ট্রোল রুম: ২২১৪৩০২৪
• জেলার জন্য: ২২১৪৫৪৮৬, ২২১৪৫০৮৭,
২২১৪৪০৩১ |
• লালবাজার: ১০০, ১০৯০
• পরিবহণ: ২২১৪৪০১৪,
২২১৪৫৭০০,
৮৩০৩২১০৩২ |
• বিমানবন্দরে যেতে: ৪০৬২১১১১, ৪০৬৩১১১১, ৪০৬৪১১১১, ৪০৬৫১১১১
• ট্যাক্সি: ২৪৭৫৩৫০৫, ২৪৭৪২২৪৯ |
|
|
মুখ্যমন্ত্রী মমতা নিজে, তাঁর মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের ভাষায়, ‘অল-আউট’ বন্ধ-বিরোধিতায় যাচ্ছেন। এ দিন তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “কোথাও কোনও গণ্ডগোল হবে না। গণ্ডগোল করতে দেওয়া হবে না। করলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। এবং এমন শাস্তি দেওয়া হবে যে, আর কেউ কখনও বন্ধ করবে না!” মুখ্যমন্ত্রী নিজে বিশ্বাস করেন, বন্ধের ফলে উন্নয়ন ব্যাহত হয় (যে জন্য তিনি খোলাখুলিই বলেন, “আমরাও অতীতে বন্ধ করতাম। ভুল করতাম। ভুল শুধরেও নিয়েছিলাম)। বন্ধ-বিরোধিতায় অনড় তিনি যেমন বলেছেন, “আমরা অনেকটাই প্রগতিশীল সরকার। বাস-ট্রাম-লরির চাকা চলবে। দোকানবাজার খোলা থাকবে। কেউ জোর করে বন্ধ করার চেষ্টা করলে কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ, এটা মানুষের সরকার।”
দ্বিতীয়ত, শাসক শিবিরের একাংশের মতে, সম্প্রতি পার্ক স্ট্রিট এবং বর্ধমানের ঘটনায় সরকারের ‘ভাবমূর্তি’ টোল খেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কড়া হাতে ধর্মঘটের মোকাবিলা করে মুখ্যমন্ত্রী বোঝাতে চান, তাঁর সরকার মানুষের পাশেই আছে। পার্ক স্ট্রিট বা বর্ধমান প্রসঙ্গ দূরে রেখেও রাজ্যের এক মন্ত্রী এদিন বলেছেন, “মানুষের দুর্ভোগ হয়, এমন কিছু যে আমরা মেনে নেব না, তা বোঝানোর জন্য এমন একটা পদক্ষেপ দরকার ছিল। তাঁর সরকার যে মানুষের পাশেই আছে, সেটা বোঝানোর জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত মঞ্চ আর পাওয়া যেত না।”
বস্তুত, বন্ধ-মোকাবিলায় মমতা এতটাই ‘কড়া’ যে, এ দিন বামকর্মীদের উপর ‘হামলা’র বিষয়ে স্মারকলিপি নেওয়ার জন্য বাম নেতাদের ‘সময়’ দিয়েও লালবাজার ছেড়ে চলে যান পুলিশ কমিশনার রঞ্জিৎ পচনন্দা। স্মারকলিপি নেন যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম। বাম নেতারা ‘ক্ষুব্ধ’ হন। কিন্তু পুলিশ কমিশনার ‘নীরব’ই থেকে গিয়েছেন। বলা বাহুল্য যে, মুখ্যমন্ত্রীর ‘নির্দেশ’ ছাড়া পুলিশ কমিশনার বাম নেতাদের সময় দিয়েও লালবাজার ছেড়ে চলে যেতেন না।
মুখ্যমন্ত্রী নিজে এ দিন সন্ধ্যায় মহাকরণ ছেড়ে যাওয়ার সময় আবার বলে গিয়েছেন, ধর্মঘটের দিন কাজে যোগ না-দিলে সরকারি কর্মচারীদের শাস্তির মুখে পড়তে হবে। তাঁদের ‘ব্রেক অফ সার্ভিস’ হবে। তাঁর কথায়, “স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি। কাজে না-এলে সার্ভিস ব্রেক হবে। এটা নিয়ম আছে।” যে প্রসঙ্গে বিরোধী দলনেতার পাল্টা বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী ভয় পেয়েছেন। আতঙ্কজনিত প্রতিক্রিয়া হচ্ছে! এই সব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ধর্মঘট আরও সফল করার রাস্তা খুলে দিচ্ছেন! সংবিধান, বিধি কোনও কিছু অনুযায়ীই ‘ব্রেক অফ সার্ভিস’ হয় না। ‘ব্রেক অফ সার্ভিস’ করার আগে ‘ব্রেক অফ গভর্নমেন্ট’ হয়ে যায় কি না, সেটা আগে দেখুন!” সূর্যবাবুর সংযোজন, এর আগে কিছু রাজ্য ‘দমন-পীড়নমূলক নীতি’ নিয়ে কর্মচারী, শ্রমিকদের মনোবল ভাঙার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পরিবর্তে সেই সরকারগুলিই ভেঙে পড়েছিল!
ঘনিষ্ঠ মহলে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন জানিয়েছেন, তাঁর আশঙ্কা, মুখে জোর না-খাটানোর কথা বললেও সিপিএম কোথাও কোথাও ‘পরিকল্পিত’ ভাবে গোলমাল করার চেষ্টা করবে। ‘উত্তেজনা’ যাতে না-ছড়ায়, সে কারণে প্রকাশ্যে তিনি জানিয়ে রেখেছেন, তৃণমূল কর্মীরা কোথাও কোনও বন্ধ-বিরোধী মিছিল করবে না। কিন্তু তারা রাস্তাঘাটে ‘নজর’ রাখবে। মমতার কথায়, “তৃণমূল কর্মীরা মানুষের কাছে আবেদন জানাবে। সিপিএমের প্ররোচনায় পা দেবে না। আমি সিপিএমের মতো রাজনীতি করি না, যে ওরা ডান্ডা নিয়ে রাস্তা নামলে আমরাও নেমে পড়ব ডান্ডা নিয়ে।”
শাসক বা বিরোধী যে কোনও ধর্মঘট বা বন্ধেই গোলমালের আশঙ্কায় রাস্তায় বেরোন না মানুষ। সিপিএম যে ভাবে সরকারের বিরুদ্ধে বন্ধ-বিরোধী ‘যুদ্ধ ঘোষণা’র অভিযোগ করছে ও মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে ‘কঠোর’ পদক্ষেপের কথা বলছেন, তাতে বিক্ষিপ্ত গোলমালের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছে না প্রশাসনিক মহল। রাজ্য সরকারের তরফে নির্দিষ্ট আশ্বাস, সরকারি কর্মীদের জন্য নির্দেশিকা এবং তুলনায় ‘নিষ্ক্রিয়’ সিপিএম এ রাজ্যে বন্ধে নতুন এক আবহ তৈরি। দেখার, আমজনতার বন্ধ-সংক্রান্ত ‘আতঙ্ক’ দূর করতে পারেন কি না মুখ্যমন্ত্রী।
দেখার, ‘রাজধর্ম’ পালনের ‘ধর্মযুদ্ধে’ প্রশাসনে ভরসা রাখে কি না জনগণ।
|
সংঘর্ষের আশঙ্কা |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
কাল রাজ্যে ধর্মঘট সমর্থক ও তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে নানা জায়গায় সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। স্বরাষ্ট্রসচিব রাজকুমার সিংহ রাজ্যকে চিঠি দিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন, কাজে আসতে ইচ্ছুক কর্মীদের যেন নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা হয়। কেন্দ্রের আশঙ্কা, দেশ জুড়ে ব্যাঙ্ক, পরিবহণ, পোস্ট অফিস, বন্দর, খনি, বিদ্যুৎ এবং ইস্পাত ক্ষেত্রেও ধর্মঘটের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রেল ও জাতীয় সড়কও অবরোধ করা হতে পারে। |
|
|
|
|
|