তখনও রবীন্দ্রসদনে এসে পৌঁছাননি মান্নাদা। মোহনবাগানের কিছু ছেলে ক্লাবের পতাকা লাগাচ্ছিল চারিদিকে। যেখানে শায়িত রাখা হবে মরদেহ, সেখান থেকে রাস্তায় সর্বত্র। পিছনের কাচে আঁকা রবীন্দ্রনাথের ছবিতেও একবার লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল সবুজ-মেরুণ পতাকা। দেখে বেশ রাগই হচ্ছিল। এই লোকগুলো গত তিন মাস কোথায় ছিল! যখন মান্নাদা যন্ত্রণায় হাসপাতালে ছটফট করছিলেন। তাঁর পরিবারের লোক লড়াই করছিলেন তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য!
নীলাঞ্জনার সিদ্ধান্তে তাই অবাক হইনি। আমাদের দেশে এটাই প্রথা। লোক মারা যাওয়ার পর যাবতীয় হইচই। দেখবেন এর পর মান্নাদার শোকসভায় কত বক্তৃতা হবে। যাঁরা বলবেন, খোঁজ নিয়ে দেখবেন তাঁদের অনেকেই কিন্তু শেষ কয়েক বছর মান্নাদা’র ধারে কাছেই যায়নি। গ্যালারিতে ছোট্ট ফুটফুটে লুনাকে দেখেছি। মায়ের কোলে চড়ে খেলা দেখতে আসত মোহনবাগানের। সেই মেয়েই যখন এরকম একটা চরম ও কঠিন সিদ্ধান্ত নিল নিশ্চয়ই এর পিছনে কোনও কারণ আছে। নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে তীব্র কোনও ক্ষোভ বা বিরক্তি। প্রচণ্ড ভিড় ছিল তাই লুনার সঙ্গে কথা হয়নি। কিন্তু অসুস্থ থাকা অবস্থায় বেশ কয়েকবার মান্নাদার বাড়িতে এবং হাসপাতালে গিয়েছি। দেখেছি শেষ দিকে প্রচন্ড অসুস্থতার মধ্যেও ওর মনে প্রচুর ক্ষোভ ছিল। মান্না দা-র মতো অজাতশত্রু ও নির্লোভ মানুষ আমি ফুটবল মাঠে কম দেখেছি। অন্য কয়েকজন তথাকথিত ‘মহা-তারকার’ মতো অর্থের পিছনে কখনও ওকে দৌড়াতে দেখিনি। কিছু প্রাপ্তির আশায় কোনও রাজনৈতিক নেতার গায়ের কাছে গিয়েও উসখুস করেননি। গিয়ে পায়েও ধরেননি। যা পেয়েছেন তা নিজের পারফরম্যান্সের জোরেই। হাসপাতালে বা বাড়িতে যখন কথা হত তখন বারবার বলতেন, “লোক যে আমাকে এত ভালবাসে এটাই বিরাট ব্যাপার। এ জন্যই যেখানে ডাকে, সেখানে চলে যাই। মোহনবাগান আর ফুটবল তো আমার প্রাণ। এখন কেউই খোঁজ নিতে আসে না। খবরও নেয় না। ক্লাবেরও কেউ আসে না। খুব কষ্ট হয়।” মেয়ে এবং বাড়ির লোকের কাছেও নিশ্চয়ই এ সব বলেছিলেন। সে জন্যই এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল ওর পরিবার।
|
মরদেহ ক্লাব তাঁবুতে না নিয়ে যাওয়ায় শুনলাম মোহন কর্তারা বলেছেন, “ওকে মোহনবাগান রত্ন দেওয়া হয়েছে। ওর নামে ড্রেসিংরুম করে দেওয়া হয়েছে। প্রতি অনুষ্ঠানেই ওকে ডাকা হয়। আর কী চাই?” আমি পাল্টা প্রশ্ন করি, যে লোকটা ‘পদ্মশ্রী’ পেয়ে গিয়েছে তাকে বাদ দিয়ে ‘রত্ন’ দেওয়ার মতো আর কেউ মোহনবাগান কর্তাদের হাতে ছিল কি? আর ড্রেসিংরুম? সেটাও তো মান্না-দার প্রাপ্যই ছিল। স্বাধীনোত্তর ভারতে ওর চেয়ে বড় ফুটবলার মোহনবাগান পেয়েছে কি? আমরা যাঁরা প্রাক্তন তারা ক্লাবের কাছে পুরস্কার বা টাকার চেয়েও যেটা বেশি প্রত্যাশা করি তা, হল ভালবাসা। নাড়ির টান। যে ক্লাবের জন্য সারা জীবনটা দিলাম, তাঁরা কেউ যদি অসুস্থতার সময় পাশে এসে বলেন, ‘আমরা আছি, চিন্তা করবেন না’ সেটাই তো বিরাট ভারসা। এখনকার ক্লাব কর্তারা অনেক সময়ই সেটা করেন না।
আমি সারাজীবন মান্নাদার বিপক্ষে খেলেছি। তাঁর কোচিং-এ শুধু ভারতীয় দলে খেলেছি। তবুও মান্না দা আমার আদর্শ। ফুটবলার হিসাবে তো বটেই, মানুষ হিসাবে। ৩০-৪০ গজ দূর থেকে দেখেছি ফ্রি কিকে গোল করছেন। তা-ও আবার খালি পায়ে। এত যত্ন করে ফ্রিকিক মারার আগে বলটাকে বসাতেন যেন বুক সেলফে বই সাজিয়ে রাখছেন। আমার দেখা সর্বকালের সেরা ফ্রি কিক নেওয়া ফুটবলার ছিলেন মান্না দা। সনৎ শেঠ, ভরদ্বাজের মতো সেই সময়ের সেরা গোলকিপারকেও বোকা বানিয়েছেন বহুদূর থেকে গোল করে। কখনও তাঁকে রাগতে দেখিনি। প্রচণ্ড স্পোর্টস ম্যান স্পিরিট ছিল। যোগ্য মানুষকেই রাজ্য সরকার যোগ্য সম্মান দিয়েছেন দেখে ভাল লাগল। মুখ্যমন্ত্রী নিজে হেঁটেছেন রবীন্দ্রসদন থেকে কেওড়াতলা পর্যন্ত।
মান্নাদার সঙ্গে মোহনবাগান শেষ তিন মাস যা করেছে, ইস্টবেঙ্গল আমাকে সারা জীবনই তাই করেছে। যে ক্লাবের হয়ে রক্ত জল করেছি, নানা প্রলোভনেও মান্নাদার মতোই ছেড়ে যাইনি ক্লাব, তারাই আমাকে একটা কমপ্লিমেন্টারি কার্ড দেয়নি। নীলাঞ্জনা যেটা বাবার জন্য করেছে আমিও সেটাই চাই। আমি মারা যাওয়ার পর আমার মৃতদেহ যেন ময়দানে না আনা হয়। এটাই আমারা শেষ ইচ্ছা। মান্নাদা-ও কি এই ইচ্ছে প্রকাশ করে গিয়েছিলেন? জানি না। লুনার সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞাসা করব। |