মান্নার শেষযাত্রায় মোহনবাগান বনাম মান
তিনি নিজে ছিলেন অজাতশত্রু। বিতর্ক থেকে সব সময় বহু যোজন দূরে। ভালবাসতেন সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে চলতে। বলা হত ময়দানের সব চেয়ে ভালমানুষ।
এআইএফএফের চোখে ‘শতাব্দীর সেরা ভারতীয় ফুটবলার’ শৈলেন মান্নার শোকযাত্রাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সব কিছু ছাপিয়ে গেল। যার ফলে তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয় মোহনবাগান ক্লাবে মরদেহই গেল না। যে ময়দান তাঁকে মান্না করেছে, তা-ও অচ্ছুত রইল শেষ যাত্রায়। তাঁর শোকমিছিলকে ঘিরে শোকের আবহ মুছে বড় হয়ে দাঁড়াল নাটকের পরে নাটক। সল্টলেকের বাড়ি থেকে হাওড়ার বাড়ি হয়ে রবীন্দ্রসদন-- শোকমিছিলে প্রধান অংশে শৈলেন মান্নার গায়ে জড়ানো থাকল ইস্টবেঙ্গলের লাল-হলুদ পতাকা।
রবিবার রাত দুটোয় হাসপাতালে প্রয়াত হন দেশের প্রাক্তন অধিনায়ক, অলিম্পিয়ান। ভোর থেকে তাঁর শেষযাত্রা নিয়েই নাটক শুরু। মোহনবাগান কর্তাদের ধারণা ছিল, মান্নার মরদেহ ক্লাবে যাবে। মোহনবাগান মাঠে সকাল থেকে জমা হচ্ছিল ফুলের মালা। সুব্রত ভট্টাচার্য ওকোলি ওডাফাদের প্র্যাক্টিস বন্ধ করে অপেক্ষায় ছিলেন, কখন মরদেহ আনা হবে। ক্লাব লনে টাঙানো হচ্ছিল শামিয়ানা, ক্লাব পতাকা। চলে আসেন অনেক প্রাক্তন খেলোয়াড়। সব ফুটবলারের জন্য আনা হয় একটি করে মালা। ঘণ্টা চারেক অপেক্ষায় থাকতে থাকতে লনে শুয়ে পড়লেন ওডাফা। তখনও বোঝা যাচ্ছে না, কী হবে।
শৈলেন মান্নার মরদেহে শ্রদ্ধা মুখ্যমন্ত্রীর। সোমবার রবীন্দ্র সদনে। ছবি: শঙ্কর নাগদাস।
ও দিকে তখন সল্টলেকে শৈলেন মান্নার বাড়িতে অন্য দৃশ্য। তাঁর মেয়ে নীলাঞ্জনা তৃণমূল কাউন্সিলর। বিধাননগরের চেয়ারম্যান কৃষ্ণা চক্রবর্তীর সঙ্গে হাজির প্রচুর রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী। সচিব-সহ মোহনবাগানের বড় কর্তারাও হাজির। চলছিল শেষযাত্রার প্রস্তুতি। সেখানেই শৈলেনবাবুর স্ত্রী ও মেয়ে বলে দেন, “শেষ তিন মাস মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, আইএফএ কেউ ওঁর খোঁজ নেয়নি। তাই ময়দানে ওঁর মরদেহ নিয়ে যাব না। সরাসরি শ্মশানে যাব।”
বিব্রত মোহনবাগান কর্তারা তাঁদের বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেন। প্রথমে সরাসরি। পরে নেতাদের মাধ্যমে। শৈলেনবাবুর স্ত্রী নরম হলেও মেয়ে অনড় থাকেন। এ বার এই নাটকে জড়িয়ে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এসএমএসে জানতে চান, মোহনবাগান মাঠে কি শোকযাত্রা আসছে? সে ক্ষেত্রে দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ তিনি আসতে পারেন। শৈলেন মান্নার মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। নীলাঞ্জনা তাঁর ক্ষোভের কথা জানান। শেষ পর্যন্ত মমতাই বলেন, বেলা একটা থেকে চারটে রবীন্দ্রসদনে মরদেহ রাখার জন্যএত দিন যেখানে খেলার জগতের বিখ্যাতদের ঠাঁই হত না।
মোহনবাগানের অপেক্ষা অপেক্ষাই রইল। ফুটবলাররা বাড়ির রাস্তা ধরলেন যে যার।
রাজ্যের খেলার জগতের বিখ্যাতদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক জগতের বিখ্যাতদের বিভেদের প্রাচীর ভেঙে দিলেন ময়দানের মান্না। তাঁর শোকমিছিলে, রবীন্দ্রসদন থেকে কেওড়াতলা পর্যন্ত হাঁটলেন মুখ্যমন্ত্রী। পর পর এসে মালা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা, অনেক মন্ত্রী। পাশাপাশি তাঁর মরদেহ নিয়ে সওয়াল-পাল্টা সওয়াল অদ্ভুত জায়গায় পৌঁছল। শ্রদ্ধা জানাতে এসে অনেক ফুটবলার মারাত্মক ক্ষুব্ধ, বিস্মিত। অধিকাংশেরই এক কথা, “পরিবারের ক্ষোভ থাকতে পারে। কিন্তু মোহনবাগানে গেলে মান্নাদার আত্মা শান্তিই পেত।”
ইংল্যান্ডের বর্তমান রানি এলিজাবেথ তখন রাজকুমারী। লন্ডন অলিম্পিকে মান্নার খেলা দেখার পরে তিনি হাওড়ার বঙ্গসন্তানের পা দেখতে চেয়েছিলেন। ওই লেফট ব্যাকের পা’টা আসল, না স্টিলের? ১৯৫৩ সালে ইংল্যান্ডের এফএ বিশ্বের দশ সেরা অধিনায়কের তালিকায় রেখেছিল তাঁকে। তাঁর নেতৃত্বেই এশিয়াডে প্রথম সোনা। মান্নার শুটিংয়ের তীব্রতা, তাঁর ফ্রি কিকের নিখুঁত মাপ নিয়েও এমন বহু রূপকথা ছড়িয়ে রয়েছে ময়দানে। অথচ তাঁর শোকযাত্রায় ওই সব রূপকথার বদলে বারবার ফিরে আসছিল বিতর্ক-কথা।
রবীন্দ্রসদনেও নাটকের পরবর্তী দৃশ্য ছিল জমজমাট। মান্নার মরদেহ পৌঁছনোর এক ঘণ্টা আগে গোটা চত্বরে লাগানো শুরু হয়ে যায় সবুজ মেরুন পতাকা। এত ক্ষণ আবার শেষযাত্রার নিয়ন্ত্রণে ছিলেন কালীঘাট স্পোর্টস লাভার্স অ্যাসোসিয়েশন ক্লাবের সদস্যরা। যার প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়। মান্নার ছবি-সহ ব্যাজ পরে ঘুরতে দেখা যায় তাঁদের। লাল-হলুদ পতাকায় মোড়া মরদেহ রবীন্দ্রসদনের হলে আসা মাত্র বিশাল সবুজ-মেরুন পতাকায় ঢেকে দেন মোহনবাগান কর্তারা। সামান্য পরে মান্নার ছবি-সহ মোহনবাগানের ব্যাজ চলে আসে সেখানে। এক কোণে থাকা ক্লাবকর্তারা সেটা পরলেও পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতে ছিল না। নীলাঞ্জনা ক্লাবকর্তাদের দিকে তাকানইনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসা পর্যন্ত দু’তরফের লোকেরাই এমন ভাবে মরদেহ ঘিরে থাকেন, সাধারণ মানুষ সে ভাবে দেখতেই পাননি। মমতা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মরদেহ দ্রুত তুলে নেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ের পনেরো মিনিট আগে। তখন আবার মরদেহবাহী শকট জুড়ে মোহনবাগান পতাকা। পাশে আবার অজস্র তৃণমূল কর্মী। শোকযাত্রা আগেই চলে যাওয়ায় অনেকে দেখতে পাননি।
শৈলেন মান্নার স্মৃতিতে অ্যাকাডেমি তৈরি, বিশেষ বৃত্তি ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। বিধাননগর পুরসভা তাঁর বাড়ির পাশের রাস্তা, আইল্যান্ডের নামকরণ করতে চাইছে তাঁর নামে। দিল্লির ফুটবল হাউসে এই প্রথম কোনও ফুটবলারের মৃত্যুতে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হল। দুবাইয়ে ভারতীয় ফুটবলাররা তাঁর স্মরণে কালো ব্যাজ পরে ম্যাচে নামলেন।
শুধু শোকের বদলে ক্ষোভ, দুঃখ ফুটে উঠছে ‘মান্নাদা’র সাধের মোহনবাগানে। বলরাম, গুরবক্স, বদ্রু, ভাইচুংদের মতো অজস্র ফুটবলারের ভিড় রবীন্দ্রসদনে। সেখানে ক্ষোভ ঠিকরে উঠছিল মোহনবাগান কোচ সুব্রতর, “মান্নাদা মোহনবাগানের। তাঁর শবদেহ আনার ব্যাপারে শুধু মেয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথ কি শুধু জোড়াসাঁকোর? উনি সারা ভারতের।” পাশে বসে মোহনবাগান সচিব অঞ্জন মিত্র প্রশ্ন তুললেন, “এত করে বললাম, মেয়েটা শুনল না। আমরা মান্নাদাকে ‘মোহনবাগান রত্ন’ দিয়েছি। বেনিফিট ম্যাচ হয়েছে। ওঁর নামে ড্রেসিংরুম করা হয়েছে। ২৯ জুলাই মোহনবাগান দিবসে অনুষ্ঠানে ডাকা হয়েছিল। আমি ওঁর মেয়েকে বলেছি, এই সিদ্ধান্তের পরে তুমি শান্তিতে ঘুমোতে পারবে তো?” শেষকৃত্য সেরে বাড়ি ফেরার সময় নীলাঞ্জনার উত্তর, “বাবা শুধু মোহনবাগানের ছিলেন না। তিনি সব ক্লাবের ছিলেন। শুধু মোহনবাগানে গেলে অনেকে দুঃখ পেত বলেই ওখানে নিয়ে যাইনি।”
মোহনবাগান বড়, না অভিমান? সারা জীবনের অবিতর্কিত শৈলেন মান্না মৃত্যুর পরে এক বিতর্কিত প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেলেন।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.