|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
‘ও তোকে মেলেছে? এই আমি ওকে মেলে দিলাম’ |
এ ভাবেই তো শিশুকে শেখাই আমরা, কী করে জীবনের মোকাবিলা করতে হয়।
হিংসাই আমাদের পৌরুষের প্রথম শর্ত। তার ফল ফলবে না? প্রশ্ন তুলেছেন কুমার রাণা |
পশ্চিমাঞ্চলে সারা শীতকাল জুড়ে মোরগ লড়াই-এর ‘পালা’ বসে। পায়ে ধারালো ছুরি (কাতি/কাইত) বেঁধে দুটো মোরগকে পরস্পরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। একটা মরে বা পালায়, পালিয়ে বাঁচার উপায় নেই পাহুড় (হেরো) মোরগের মাংসে যে লেগে থাকে জয়ের গৌরবময় সুস্বাদ। আর যে জেতে, তাকে প্রস্তুত করা হয় আর একটা লড়াইয়ের জন্য। ‘এ লড়াই বাঁচার লড়াই, এ লড়াই জিততে হবে’ বলে যত আক্রোশেই যুদ্ধটা করুক না কেন, মাংস হওয়াই তার ভবিতব্য যে মাংসে অধিকার মালিকের।
পৃথিবীর নানা প্রান্তেই পশুপাখিদের লড়িয়ে মানুষের আনন্দলাভ খুবই সাধারণ ঘটনা। হয়তো সভ্য মানুষ এর মধ্য দিয়ে তার আদিম শিকারজীবী অতীতকে স্মরণ করে, আবাহন করে তার প্রাকৃত জীবনের প্রতিচ্ছায়া।
প্রাচীন রোমে দু’জন দাস গ্ল্যাডিয়েটর-এর হাতে মারক অস্ত্র তুলে দিয়ে পরস্পরকে আক্রমণে বাধ্য করা হত। এক জনের মৃত্যুতেই অন্য জনের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা তত দিন, যত দিন না তাকে পরের ‘খেলা’টায় নামানো হচ্ছে। যার বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ, কয়েক মুহূর্ত আগেও সে ছিল তারই স্ব-জন, ভাই বা নিকটাত্মীয়। আজ এমন সার্কাস করে দুটো মানুষের লড়াইটা বেআইনি করে দেওয়ার মতো সভ্য আমরা হয়ে উঠেছি। কিন্তু তার জায়গায় শ’য়ে শ’য়ে মানুষ মারার এক যুদ্ধ-সংস্কৃতিকে আমরা সাদরে বরণ করে নিয়েছি, যে সংস্কৃতির নির্মাতা ও পৃষ্ঠপোষক ক্ষমতাধররা, কিন্তু ক্রীড়নক সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।
যুদ্ধের চেয়ে বড় খেলা কিছু নেই, যত বড় খেলা, সেটা তত বড় যুদ্ধ। পাঠক স্মরণ করতে পারেন আই পি এল, ক্রিকেট বা ফুটবল বিশ্বকাপের বিজ্ঞাপন: দুটো দলের খেলাকে চরম উত্তেজনার মধ্য দিয়ে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করে তোলার জন্য তাকে আখ্যা দেওয়া হল ‘মহারণ’ বা ‘বিশ্বযুদ্ধ’ নামে। শৈশব থেকেই যুদ্ধের পাঠ। খেলনার দোকানে সবচেয়ে বেশি চাহিদা যে বস্তুগুলোর, তার মধ্যে একটা হল বন্দুক। কম্পিউটারে যুদ্ধ ও হত্যার খেলা, টেলিভিশনে কুৎসিত মারামারির শো ছাড়া নাকি অনেক বাচ্চা দুধ খেতে চাইছে না! সদ্য হাঁটতে শেখা শিশু পড়ে গিয়ে কাঁদলে বড়রা মাটিতে ঠাঁই-ঠাঁই কয়েকটা লাথি মারেন ‘ও তোকে মেলেছে? এই, আমি ওকে মেলে দিলাম।’ হতচকিত শিশুর কান্না থামে হিংসার বর্ণপরিচয়ে। একটু বড় হয়ে, বাড়িতে বা ইস্কুলে মার খেয়ে সে পড়ে ফেলে হিংসার দ্বিতীয় ভাগ: ভুল করলে মার খেতে হয়; বড় হয়ে মার খাওয়ার শিক্ষা মার দেওয়াতে উত্তীর্ণ হয়। মার এবং মার কা বদলা মার, তার বদলা আরও মার। শৈশবেই খেলনা মারণাস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা শেষ হতে না হতে খেলা হয়ে উঠল যুদ্ধ করব, লড়ব, জিতব রে! অতঃপর গালভরা জীবনসংগ্রাম ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’ বলে নিষ্প্রশ্ন ঝাঁপিয়ে পড়া। |
|
এত রক্ত কেন? বহুরূপী প্রযোজিত ‘বিসর্জন’ নাটকের একটি মুহূর্ত |
অবশ্য এ সবই পুরুষের খেলা। মেয়েদের ব্যাপারটা আলাদা, তারা নিজেরাই পুরুষের খেলার সামগ্রী। তাকে যে ভাবে খুশি ব্যবহার করা যায় চিয়ারগার্ল থেকে ধর্ষণের শিকার পর্যন্ত। মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থাটা অতএব উল্টো সে হবে সুশীলা, লজ্জাবতী, সাত চড়ে রা-টি কাড়বে না। বালকপুত্র তার কাছে হয়ে উঠবে ‘দস্যি ছেলে’ বা ‘গুন্ডা সোনা’, প্রিয় পুরুষ হয়ে উঠবে ‘ডাকাত’! এবং জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত পুরুষ যখন যুদ্ধের ময়দান থেকে আশাহত হয়ে, হেরে বিধ্বস্ত হয়ে ফিরে আসে, তখনও তাকে বিজয়ীর গৌরবদানের পবিত্র দায়টিও তাকেই নিতে হয় নিজের পিঠ পেতে দিয়ে। বউকে বা প্রতিরোধক্ষমতাহীন বাচ্চাদের পিটিয়ে, বৃহত্তর সমাজের বঞ্চনা ভুলে, ব্যক্তিগত হিংসার চরিতার্থতায় পুরুষ ঘুমোতে যায়। চার দিকে পুরুষ্টু হিংসার চোখধাঁধানো বাজার, সেখানে যুক্তিবোধের জায়গা নেয় অন্ধ অহংকার। ভাববার অবকাশও নেই, কার জন্য, কীসের জন্য লড়াই? ভাতের, পুষ্টির, শিক্ষার, নিরাপদে নির্ভয়ে বেঁচে থাকার? না কি সুযোগ পেলেই হাতের সুখ করে নেওয়ার?
অথচ যুক্তিবোধেই তো মানুষ মানুষ। কিন্তু হিংসার সঞ্চালকদের কাছে সেটা সমস্যার: গ্ল্যাডিয়েটরা যদি যুক্তি দিয়ে বিচার করে, তা হলে শুধু যে অভিজাতদের আমোদটাই নষ্ট হবে তাই নয়, ভ্রাতৃঘাতী যোদ্ধারা তো স্পার্টাকাসও হয়ে উঠবে। যুক্তি যদি কাজ করে, তা হলে দৃশ্য-অদৃশ্য শক্তির কালো হাত ভেঙে দেওয়ার, গুঁড়িয়ে দেওয়ার কল্পিত সাফল্যের আনন্দের চেয়ে বাস্তব কোনও কিছু অর্জন করার দিকেই সে যাবে যে অর্জনে তার মানুষ হয়ে ওঠার সার্থকতা।
এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, মানুষকে সংগ্রাম করতে হবে না। বরং উল্টো। তার দিনগুলোকে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে ভাগ করে নেওয়ার জন্য, পূর্ণতর বুদ্ধিবৃত্তি চালিত মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার জন্য তাকে তো লড়াই চালিয়েই যেতে হবে। তার জন্য যা প্রাপ্য সেটা আদায় করার জন্য, হিংসার বিপরীতে যে সভ্যতা, তার উপর মানুষের দাবি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাকে লড়তেই হবে হিংসাকে ব্যবহার করে যারা অধিপতি হয়ে বসে আছে, তারা স্বেচ্ছায় দাতা হয়ে উঠবে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু সেই লড়াইতে তাকে তো তার আদিম সত্তাকে আঁকড়ে ধরলে চলবে না, যুক্তির আলো ফেলেই তাকে এগোতে হবে।
|
এই বসন্ত
তিলোত্তমা মজুমদার |
|
এবার কি আর ফুটবে পলাশ?
তেপান্তরে
রক্তে ভেজা মনুষ্য লাশ
কোন বসন্ত
জাগল দ্বারে
অনায়াসে মানুষ মারে
খুনের বদলা আরেকটি খুন
ভ্রমরা গায় গুন গুন গুন
ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে আসে
বন্ধ করো জানলা ত্রাসে
বসন্তের এই মাতাল দিনে
কড়ায় ক্রান্তি শান্তি কিনে
তবুও ভয়...
শিমুল পলাশ ফোটেও যদি
ভুল করে হাত যদি বাড়াই
যদি ছুঁলেই ফুলেরা হয়
গলতে গলতে রক্তনদী! |
|
|
যুক্তি এখানে কেবল মানসিক অনুশীলনই নয়, সেই সঙ্গে সেটা এক প্রবল শক্তি, যা প্রচলিত হিংসাশ্রয়ী ক্ষমতার কাঠামোকেই বদলে দিতে পারে। যে আধিপত্য গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধে নামতে বাধ্য করে, সেই আধিপত্যই তো পশ্চিমবাংলার চাষি, মজুর, ছাত্র’কে লাগিয়ে দেয় পরস্পরের প্রাণ নিতে শ্রমপবিত্র মানুষগুলিকে খুনি জল্লাদে পরিণত করতে। এটাই ক্ষমতার যুক্তি: খেলাকে যুদ্ধে পরিণত করো, যুদ্ধকে জয়ে, কিন্তু সে জয়ের ভাগ অন্য কারও। তোমার কাজ শুধুই যুদ্ধ করা। যুদ্ধের নেশায় আচ্ছন্ন মানুষ ভুলে যায় তার রোজকার চাহিদা কী, মনুষ্যত্বের শর্ত বা সংজ্ঞাই বা কী? সামনে একটাই লক্ষ্য স্বজনঘাতী যুদ্ধ, যাতে জয়ী হলে পরেরটার জন্য তৈরি হওয়া, আর হারলে শহিদত্বে সান্ত্বনা! যুদ্ধের উন্মাদনায় সে সহজেই ভুলে যায় যে, সে একটা মানুষ থেকে একটা খুনিতে পরিণত হল।
জীবনের প্রতি পদে যে আদিমতা, শৈশব থেকে যে হিংসাকে পৌরুষের শর্ত হিসেবে গড়ে তোলা হয়, সে হিংসার বিলোপ না করে শুধুমাত্র শাসকের শুভেচ্ছার হাতে ব্যাপারটাকে ছেড়ে দেওয়া সভ্যতার পরিপন্থী। শাসকরা এটাকে দেখায় আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে, কিন্তু যুক্তি বলে সমস্যাটা শাসকীয় আধিপত্য-দর্শনের। ক্ষমতার নিরঙ্কুশতায় হিংসা সবচেয়ে সুলভ উপকরণ। মানুষকে খুনি বানিয়ে ফেলতে পারলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ জনতার ভোট হয়ে ঝরে পড়তে হবে না, সেটা সর্বদাই সঙ্গে থাকবে। অতএব হিংসার যুক্তিতেই হিংসার বৃদ্ধি। হিংসার সাফাই গেয়ে প্রতিহিংসার, জনরোষের কাহিনি নির্মাণ: অমুক অমুককে মেরেছিল, অতএব তমুকের তমুকের উপর জনরোষে ঝাঁপিয়ে পড়ার পুরো হক আছে। হিংসার ওকালতি করতে গিয়ে হিংসার শিকারকেই তার জন্য দায়ী করা অমুক ছিল খুনি, তমুক দুশ্চরিত্রা বা বেশ্যা; অতএব তাদের খুন বা ধর্ষণ করে তাদের হাতেনাতে ফল ধরিয়ে দেওয়ার মতো ন্যায় আর কী হতে পারে?
শাসকীয় আধিপত্যের এই বর্বর অযুক্তির বিরুদ্ধে শাসিত গণ-যুক্তিবোধই পারে মানুষকে হিংসার গ্রাস থেকে রক্ষা করতে। তার জন্য মিছিল করে, কবিতা লিখে, পোস্টার সেঁটে প্রতিবাদ করাটা যত জরুরি, তার চেয়ে বোধহয় বেশি দরকারি সমাজে আদিম হিংসার লালিত সংস্কৃতির মুলোচ্ছেদ করা। প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ, প্রতিটি কৃত কর্মকে প্রশ্নের সামনে ফেলেই আমরা এই কঠিন কাজটা করে উঠতে পারি। ক্ষুধিত মানুষের মুখের অন্ন কেড়ে নেওয়া অত্যাচারীদের মানুষের ‘স্বজন হারানো শ্মশান’-এর চিতায় তুলবার প্রতিজ্ঞায় ‘আদিম হিংস্র মানবিকতা’কে আবাহন করব, না এই সোনার পাথরবাটির চিন্তাকে বিসর্জন দিয়ে স্বজন হারানোর মূলগত হিংসাকে নির্মূল করব, সেটা ভাবতেই হবে। শব্দ, ছন্দ ও আবেগের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা কবি-র শুভ প্রত্যয়কে সম্মান জানাতেই তাকে প্রশ্নটা করতে হবে।
|
প্রতীচী ইনস্টিটিউট-এ কর্মরত। মতামত ব্যক্তিগত |
|
|
|
|
|