প্রবন্ধ ১...
সরকার শক্ত হলেই কাজের অভ্যাস ফিরবে
ন্ধ নিয়ে সাধারণ মানুষের কাকুতিমিনতি কোনও দিনই তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। আমরা আবার এমন একটা রাজ্যে বাস করছি যেখানে কিছু দিন আগে পর্যন্ত সরকার নিজেই বন্ধ করত বা উৎসাহ দিত। এ বার একেবারে অন্য রকম। সরকার বলছে যে সরকারি কর্মচারীদের বন্ধে অংশগ্রহণ করা চলবে না, করলে হয়তো মাইনে কাটা যাবে। সত্যি বলতে কি প্রথম প্রথম কথাটা বিশ্বাস হয়নি, কারণ আমাদের কর্মসংস্কৃতির চেহারাটা অনেক দিনের পুরনো। অফিসে এসে সই করে গণ-অবস্থানের জন্য বেরিয়ে যাওয়া, বা পেন-ডাউন বা গো-স্লো। মনে আছে, ভরদুপুরবেলা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বক্তৃতার রমরমা, কিন্তু কাজ নৈব নৈব চ। একটা কাজের জন্য এক জন একটু খোঁচাতেই তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘দেখছেন না আমাদের প্রতিবাদ চলছে’। এক দিন কাজ না হলে রাজ্য সরকার কোটি কোটি টাকা ক্ষতি স্বীকার করে; অন্তত করার কথা। তাই যদি আপনি-আমি ওই ক্ষতির অংশীদার হই, আমরা একবাক্যে বলব: আমরা ক্ষতি চাই না। বন্ধে অংশগ্রহণ করে যদি কাজে না আসি সেটা ক্ষতির একটা অংশ, আর কাজ না করে সরকারের কাছ থেকে মাইনে নেব, এটা আর এক ধরনের ক্ষতি। অর্থাৎ, ডবল ক্ষতি।
ক্ষতি কার, সে কথাটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। ক্ষতি জনগণের, কারণ সরকারের নিজের পয়সাকড়ি থাকে না। তা ছাড়া, সরকার জনতারই প্রতিনিধি। সই করে সে দিন কাজ না করার উদাহরণ বিগত জমানায় ভূরি ভূরি। শুধু বন্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য নয় মিটিং-মিছিল, গণ-অবস্থান, ধর্না ইত্যাদি ইত্যাদি। সই করে কাজ না করলে বা বন্ধের জন্য কাজে না এলে নৈতিক ভাবে আমাদের যে বেতন নেওয়ার কোনও অধিকার থাকে না, তা কেউ বলেন না। কারণটা খুব সোজা এটাই ‘মডেল’, অথবা সংস্কৃতির অঙ্গ। সরকারি স্তরে এ নিয়ে কোনও দিন প্রশ্ন ওঠেনি। সরকারের এত প্রতিজ্ঞবদ্ধ ভূমিকাও দেখা যায়নি।
দৃশ্যের পরিবর্তন হবে? বামফ্রন্টের পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠিত অনেক বন্ধ-এর একটি।
আন্দোলন, প্রতিবাদ দিবস, ধিক্কার, মিছিল, ধর্মঘট, নিশ্চয়ই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সাধারণ মানুষের বা অর্থনীতি ও সমাজের তাতে ক্ষতি হচ্ছে কি না, তা নিয়েও না-হয় আলোচনা করলাম না। কিন্তু কাজ করব না অথচ মাইনে নেব এই বদ অভ্যাস অনেক দিন মজ্জাগত হয়েছে বলেই কি আজ আমরা অবাক হচ্ছি? সরকারি কর্মচারীরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবেন কি পারবেন না, সেই প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায় কাজ না করলে, বিশেষত ইচ্ছে করে কাজে না এসে যাঁরা বেতন দাবি করবেন, তাঁরা গর্হিত অনৈতিক কাজ করবেন। অনেক দিন নীতিকথা বিসর্জন দিয়েছেন বলে সেটাই জীবনধারণের কাম্য ‘মডেল’, এই যুক্তি টেকে না। আর সরকারি অফিসে কাজ না করে সরকারকে এক হাত দেখে নেওয়ার শিক্ষা আমরা পেয়েছি বহু দিন। বেসরকারি অফিসে যাঁরা নিজেদের কর্তব্য নিয়ে খানিকটা সন্ত্রস্ত, সরকারি অফিসে এলে তাঁরাই এক এক জন ব্যাঘ্রবিক্রম। যদি কেউ আন্দোলন করেন, বন্ধের দিন কাজ করবেন না বলে ঠিক করেন এবং প্রতিবাদ জানাতে চান, তা হলে কোনও এক ভাবে স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে। তা না হলে প্রতিবাদের যাথার্থ্য বোঝা যাবে কী ভাবে? আমার প্রতিবাদের সব ব্যয়ভার কি অন্যরা বহন করবে? সরকারি অফিসে কাজ হবে না, ক্ষতি হবে। যদি সরকারি নিষেধাজ্ঞা, সুপ্রিম কোর্টের রায়, কী করণে বন্ধ হচ্ছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ছেড়েও দিই, একটা অন্যায় কাজ দিনের পর দিন করে আসতে আসতে সেটাতেই আমাদের নৈতিক অধিকার জন্মে যাবে এমনটা ভাবা কি সমীচীন?
সরকারি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অনেক কথা উঠেছে। ইউনিয়নগুলি প্রতিবাদ জানিয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যা সহজেই গ্রহণযোগ্য, সরকারি সে কথাগুলি মনে করিয়ে দিয়ে ভয়ানক অন্যায় হচ্ছে এমনটা ভাবা উচিত নয়। তবে অন্য একটি কারণেও নিষেধাজ্ঞা বা সরকারের কড়া মনোভাবের প্রয়োজন আছে। অর্থনীতির তাত্ত্বিক যুক্তি বলে, এ ধরনের কড়া মনোভাব যথার্থ প্রতিবাদী, সংগ্রামী ব্যক্তিত্বকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
আমাদের মধ্যে অনেকেরই বন্ধ সম্পর্কে, বন্ধের মূল কারণগুলি সম্পর্কে এবং সর্বোপরি আন্দোলন ও রাজনীতি সম্পর্কে উৎসাহ না-ই থাকতে পাবে। কিন্তু আমরা সেই মনোভাব প্রকাশ করতে ভয় পাই। আর যদি ছুটি এমনিতেই পাওয়া যায়, তবে তো বন্ধ হলে ভালই! আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই আছেন যাঁরা আদর্শগত ভাবে অনেক বেশি সচেতন বা বিশ্বাসী। তাঁরা মাইনে পান বা না পান, তাঁদের কাজ থাকুক বা না থাকুক বা কোনও ভাবে তাঁদের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হোক বা না হোক, তাঁরা শক্ত মনে এই প্রক্রিয়ার মোকাবিলা করবেন। কিন্তু অনেকেই সেই রকম নই। সরকার যদি সত্যি নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করেন, তা হলে এই শ্রেণির লোকরা খামখা ‘বন্ধ, বন্ধ’ করে নিজেগের স্বার্থত্যাগের ঝুঁকি নেবেন না। ফলে, আদর্শবাদী রাজনৈতিক বিশ্বাসে নির্ভীক মানুষজনের থেকে স্বার্থান্বেষী মানুষদের আলাদা করা যাবে। তাই নিষেধাজ্ঞা জারির সামাজিক উপকারিতা অগ্রাহ্য করা যায় না। নখদন্তহীন সরকারের সামনে আস্ফালন করা সহজ, কিন্তু সরকার শক্ত ঠাঁই হলে সংগ্রামের আসল মুরোদ বোঝা যাবে। সরকার মূক, বধির, অক্ষম, প্রতিবাদ প্রতিরোধের ভাষা সে জানে না এটাই তো আমাদের চিরকাল শেখানো হয়েছে। কারণ, গণতন্ত্র মানে দুর্বল সরকার আর সবল হল ক্ষুদ্র কিন্তু সঙ্ঘবদ্ধ কায়েমি স্বার্থে ভরপুর জনগোষ্ঠী। সরকার ফোঁস করলেই অপরাধী। মনে রাখতে হবে, এ দেশে শতকরা নব্বই জনেরও বেশি শ্রমিক অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে। অর্থাৎ, সারা ভারতের সব সরকারি কর্মচারীকে একত্র করলে শ্রমিক সংখ্যার পাঁচ শতাংশের বেশি হবে না।
আরও একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। বন্ধ, আন্দোলন, মিছিল, এই সব বেশি দিন করতে না পারলে রাজনৈতিক নেতাদের কিছু করার থাকে না। খুব আদর্শবাদী বামপন্থী পাঁচ জনকে দিয়ে তো নিজেদের রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায় না। দরকার হয় অনেকের। তাঁদের অনেকেই আদর্শে নিষ্ঠাবান নয়, স্রেফ সুযোগসন্ধানী, স্বার্থপর। তাঁদের দলে যোগ দিতে হলে কিন্তু ভর্তুকির প্রয়োজন, অর্থাৎ কাজ করবে না কিন্তু মাইনে কাটে বা অন্য কোনও শাস্তি দেয়, কার সাধ্যি! সরকার কড়া হলে এঁদের দলে নেওয়া শক্ত। তাই আদর্শ ও সংগ্রামের আধার যত ঠুনকো হবে তত নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা বাড়বে। স্বাভাবিক।
সব শেষে আমাদের পাড়ার মন্টুদার কথা বলতেই হয়। তিনি বন্ধ পছন্দ করেন না, কাজের সময় গণ-অবস্থান, গো-স্লো পছন্দ করেন না, কিন্তু সবেতেই অংশগ্রহণ করেন; কারণ তিনি এক জন সাধারণ কর্মচারী, কর্মবিমুখ নন, কিন্তু ভয় পান। কাজে ফাঁকি দেওয়া রাজনৈতিক দাদাদের তিনি ভয় পান। তাই মুখ বুজে সব করে যান। সরকারি নিষেধাজ্ঞা হয়তো তাঁকে মাথা তুলে বাঁচতে শেখাবে। সরকারি অফিসের বাইরে যে বিশাল জগৎ, সেখানে যাঁরা বাস করেন, তাঁরা অন্তত এইটুকু আশা করতেই পারেন।

অর্থনীতিবিদ, কলকাতায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এর অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.