মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিতরণের ক্ষেত্রে পুনর্বার গোলযোগ ঘটিয়াছে। উপর্যুপরি দুই বৎসর এই অপকাণ্ডটি ঘটিল। ঘটনাটি ঘটিয়া যাইবার পরে দুঃখপ্রকাশ তুলনায় অনেক সহজ। জীবনের প্রথম বৃহৎ প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসিয়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিভ্রান্তির শিকার হইবার পরে চেতনা স্থির রাখিয়া পরীক্ষার উত্তর প্রদান অনেক কঠিন। এই দুইয়ের অন্তর্গত ফারাক এমনই বিপুল যে তাহা এমনকী তুলনীয়ও নহে। যাঁহারা এই গাফিলতির জন্য দায়ী, তাঁহারা কঠোর ধিক্কারের যোগ্য। কিন্তু, সেই ধিক্কার মূলত তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মাত্র। সমস্যাটির মূল খুঁজিতে হইলে গভীরে প্রবেশ করিতে হইবে। গভীরতর বিবেচনায় অন্য একটি সত্য উঠিয়া আসে। সেই সত্য চূড়ান্ত ভাবে কেন্দ্রীকৃত পরীক্ষা ব্যবস্থার সংকটের প্রতি নির্দেশ করে। বিরাট একটি অঞ্চল জুড়িয়া পরীক্ষার বন্দোবস্ত। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রতি বৎসর বাড়িতেছে। তুলনায়, প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর সংস্থান যে সেই অনুপাতে বর্ধমান, এমন নহে। ফলে, প্রয়োজনের সহিত আয়োজনের ফারাক ক্রমশই দৃষ্টিকটু ভাবে দৃশ্যমান। একটি বিশেষ সময়ে এক-একটি বিশেষ বিষয়ের পরীক্ষা গোটা রাজ্য জুড়িয়া শুরু হইবে। কোথাও সামান্যতম ভুল হইলেও সমস্ত আয়োজনটি কার্যত জলাঞ্জলি! এমন একটি রুদ্ধশ্বাস পরীক্ষা-ব্যবস্থা সার্কাসের ‘ট্র্যাপিজ’-এ কলাকুশলীদের অবিশ্বাস্য ভারসাম্যের খেলা দেখাইবার সহিত তুলনীয়। প্রাণপণে সেই খেলাটি না দেখাইয়া শিক্ষা দফতর যদি পরীক্ষা ব্যবস্থাটির মৌলিক এবং দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার সাধনে মনোনিবেশ করে, তবে লাভ বই ক্ষতি হইবে না।
প্রশ্ন উঠিবে, কী ধরনের সংস্কার? প্রথম সংস্কারটির নাম পরীক্ষা ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ। একটি বিশেষ সংস্থার অধীনে রাজ্যময় লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থী উত্তরপত্র লিখিতে বসিয়াছেন এমন একটি দৃশ্যের ভিতর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আত্মগৌরবের অবকাশ থাকিলেও থাকিতে পারে, যুক্তির স্পর্শ বিশেষ নাই। এই কেন্দ্রীকরণ কি পরীক্ষার্থীদের প্রতি সুবিচার করে? প্রশ্নপত্র বিতরণে গোলযোগ, যোগ্য পরীক্ষকের অভাব এবং পরিণামে যেন তেন প্রকারেণ খাতাগুলিকে দেখাইয়া কোনও ক্রমে নির্ধারিত সময়ে ফল প্রকাশের বন্দোবস্তকে পরীক্ষার্থীর প্রতি সুবিচার বলা চলে না। এই সব অসুখ এই কেন্দ্রীকৃত পরীক্ষা ব্যবস্থার পরিচিত অসুখ। বিভিন্ন সময় ইহারা আত্মপ্রকাশ করে, তখন কিছু কথাবার্তা হয়, পুনরায় গড্ডল প্রবাহটি চলিতে থাকে। অসুখ আরও একটি আছে। তাহা সর্বদা চক্ষুর নাগালে আসে না। তুলনায় অন্তরালবর্তী সেই পীড়াটিও শিক্ষার্থীদের প্রতি এক ধরনের অবিচার। কোনও একটি নির্ধারিত দিনে কোনও শিক্ষার্থী কতখানি প্রস্তুত ভাবে উত্তর দিতে পারিল, ইহাই কি তাহার শিক্ষার প্রকৃত মুখচ্ছবি? প্রশ্নটি বিবেচনা দাবি করে। গভীরতর বিবেচনা। কোনও শিক্ষার্থী সম্বৎসর কতখানি যোগ্যতার সহিত শিক্ষাগ্রহণ করিয়াছেন, তাহা একটি প্রশ্ন। সমস্ত অধীত বিদ্যা তিনি বিশেষ কোনও একটি দিনে পরীক্ষার পত্রে যথাযথ ভাবে লিখিতে পারিলেন কি না, তাহা অন্য। দ্বিতীয় কাজটিও একটি পরীক্ষা সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহাকেই সেই পরীক্ষার্থীর অধীত বিদ্যার একমাত্র মানদণ্ড বলিয়া ভাবিয়া লইলে মুশকিল। তৎসহ, সমস্ত পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্রই যে একই রকম পরিস্থিতির ভিতর মূল্যায়িত হয়, এমনও নহে। কোন পরীক্ষক কী পরিস্থিতিতে কোন উত্তরপত্রটি দেখিতেছেন, তাহা কার্যত অনির্ণেয়। সমস্যা হইল, ঘটনা হইল, এই সব পরিস্থিতির ভিতর ফারাক এমনই যে তাহা কোনও ভাবেই পরীক্ষার্থীদের প্রতি সুবিচার করে না। সুতরাং, মাধ্যমিক পরীক্ষা নামক এই বিপুল কর্মকাণ্ডটিই একাধিক দিক হইতে পুনর্বিবেচনা দাবি করে। শিক্ষার্থীর স্বার্থেই দাবি করে। এক্ষণে, উচ্চতর শিক্ষার নানা স্তরে ‘সেমেস্টার’ নামক খণ্ডীকৃত মূল্যায়ন পদ্ধতি আসিয়া গিয়াছে। মাধ্যমিক লইয়াও অন্যতর ভাবনাচিন্তা কাম্য। স্কুল স্তরের মূল্যায়নে সংস্কার চিন্তার কিছু লক্ষণ দেখা গিয়াছে। তাহা উচ্চতর পর্বেও প্রসারিত হোক। |