নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর ‘বিলাপ করার আগে ভাবুন, গত কয়েক দশক রাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কতটা শান্তি ছিল’ (১৯-১) প্রতিবেদনটি সময়োচিত এবং তাৎপর্যবাহী। কার্যকারণ সম্বন্ধের অনিবার্যতায় কয়েকটি কলেজে বর্তমানে যে-সমস্ত ঘটনা ঘটেছে, তার মূল কিন্তু অনেক গভীরে প্রোথিত।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ সেনের ‘কেন এই ঘেরাও : নেপথ্যে দৃষ্টিপাত’ শীর্ষক নিবন্ধে (দেশ সুবর্ণজয়ন্তী প্রবন্ধ সংকলন, পৃ: ২৬০) ঘেরাও-এর তিনটি স্তরের কথা বলা হয়েছে। এই ত্রিস্তরীয় ঘেরাও-এর অন্যতম হল শিক্ষাসমস্যা বহির্ভূত বিষয় সংক্রান্ত। দৃষ্টান্তটি শ্রীসেনের ভাষাতেই তুলে ধরি, ‘যেমন বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারার ভোজসভায় আমি যেতে পারব না এই দাবি নিয়ে ঘেরাও। এ ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়, যার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াকলাপের কোনও সংযোগই ছিল না। কয়েকটি ঘেরাও-এ ছেলেমেয়েদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন দু’এক জন শিক্ষক বা শিক্ষকদের এক গোষ্ঠী’।
অধ্যাপক সেন সেই সভায় গিয়েছিলেন জানতে পেরে সকলের সামনে এক ছাত্রনেতা উদ্ধত কটূক্তি করে, ‘ডিনারে ক’গ্লাস মদ খেয়েছিলেন?’ শ্রীসেন লিখেছিলেন, সেই ছাত্রনেতা জানত, এর জন্য তাকে কোনও শাস্তি পেতে হবে না। এই শাস্তি পেতে হবে না জেনেই বিগত কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক অপকর্ম করা হয়েছে। এখনকার ঘটনাগুলিকে তাই অধ্যাপক ভাদুড়ী ঠিক কারণেই ‘প্রতিক্রিয়া’ বলতে চেয়েছেন। বাস্তব কথা মানতে হবে, বছরের পর বছর কলেজগুলিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়নি। উচ্চতর কর্তৃপক্ষকে মূলধন করে নিয়মের আবরণে অনেক অনিয়ম করা হয়েছে। একতরফা ভাবে ‘নিজের লোক’কে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কমিটির শীর্ষস্থানে। এ কথা আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। অনেক সিনিয়র অধ্যাপককেই প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি বরং নানা অছিলায় মানসিক চাপের মধ্যে রেখে কণ্ঠরোধ করারই অপচেষ্টা করা হয়েছে। সরকারি নির্দেশনামা অনুসারে (no 1325-edn (cs)/10m-52/11,dated kolkata the 6th day of september, 2011) উপাধ্যক্ষের পদ উঠিয়ে দেওয়া হলেও কোথায়ও কোথায়ও অন্য ভাবে ঘুরিয়ে এখনও এই পদ জিইয়ে রাখা হয়েছে।
শুনতে খারাপ লাগলেও এ কথা বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে, কোনও কোনও অধ্যক্ষের নৈতিক অস্ত্র আজ ভোঁতা। অধ্যক্ষের চেয়ারটিকে যথোচিত মর্যাদা দিয়ে সমদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করলে কোনও শিক্ষাপ্রাঙ্গণেই অশান্তির বাতাবরণ তৈরি হবে না। তবু যদি হয়, তখন কি ধানতলায় মহিলা আধিকারিক নিগ্রহের পর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রীর সেই ‘ঐতিহাসিক’ উক্তিটিই আমাদের মনে পড়বে না‘এ রকম তো কতই হয়!’
বাণীবরণ সেনগুপ্ত। অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, সংস্কৃত বিভাগ, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কলেজ, নৈহাটি, উত্তর চব্বিশ পরগনা
|
গৌতম চক্রবর্তী ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরীকে উদ্ধৃত করেছেন, ‘তা হলে সুশোভন সরকার থেকে হব্সব্ম, ক্রিস্টোফার হিল, কেউই শিক্ষক হতে পারবেন না’ (২৫-১)। রাজ্যের নতুন শিক্ষা আইনের প্রেক্ষিতে এ মন্তব্য করা হয়েছে। যে চার জন বিখ্যাত ঐতিহাসিকের উল্লেখ শ্রীচক্রবর্তী করেছেন, তাঁদের মতো উচ্চমেধাসম্পন্নদের অধ্যাপক হতে বাধা থাকছে না।
যত দূর জানি, নতুন আইনে জোর দেওয়া হয়েছে যে, উপাচার্য কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না। তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারবে, কিন্তু ফলিত রাজনীতি থেকে বিরত থাকবেন।
আসলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় আইনটির কনটেক্সটটি এখানে মনে রাখতে হবে। এটি বর্তমান রাজ্য সরকারের একটি কারেক্টিভ রিঅ্যাকশন বা সংশোধনমূলক প্রতিক্রিয়া। অ্যাকশন বা ক্রিয়াটি কেমন ছিল? ১৯৭৮-২০১০ এই সময়ে nomenklatura প্রয়োগ করে শাসকগোষ্ঠীর অনুগত বড় কোনও কমরেডকে উপাচার্য করা হত।
তিনি তার পর কোনও মেজ কমরেডকে অধ্যাপক করতেন। তাঁর পালা অনুযায়ী ওই অধ্যাপক কোনও ছোট ক্যাডারকে কনিষ্ঠ শিক্ষকের পদে ঢুকিয়ে দিতেন। আর আমরা দেখতাম দলদাসদের রিলে রেস! এই ভাবেই বাম (?) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মধ্য ও নিম্নমেধার খেলার মাঠ বানিয়েছিল।
পিএইচ ডি নেই, কোনও বই নেই, নিজ বিষয়ে বা শিক্ষায় কোনও উল্লেখযোগ্য অবদান নেই এমন বৌদ্ধিক সর্বহারারও কিন্তু উপাচার্য হতে কোনও বাধা নেই। কারণ, দল আছে। নিম্ন দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতকোত্তর ডিগ্রিটুকুর অধিকারীর রেজিস্ট্রার হতে অসুবিধা হয়নি। উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে দলতন্ত্রের এ রকম ভয়ঙ্কর দাপাদাপির ভূরিভূরি ঘটনা রাজ্যবাসীরা জানেন। অধ্যাপক রায়চৌধুরী মহাশয় জানেন কি না জানি না।
ক্ষমতার ওই partisan pyramid-টাই ভাঙতে চাইছে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় আইন। উদ্দেশ্য হল উপাচার্যরা যাতে মেধার ভিত্তিতে নিযুক্ত হন এবং নিযুক্তির পর তাঁরা যাতে নিম্নমেধার কাউকে নিযুক্ত করতে না-পারেন।
ইতিহাসবিদ রায়চৌধুরী ক্রিস্টোফার হিল-এর উল্লেখ করেছেন। আমি সেই সঙ্গেই একটা উদ্ধৃতি দিয়ে আমার লেখা শেষ করছি। Christopher Hill লিখেছেন, ‘Only very slowly and late have men come to realize that unless freedom is universal, it is only extended privilege.’ বিসর্জন দিয়ে ‘ফ্রিডম’ প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট।
লক্ষ্মীনারায়ণ গুপ্ত। প্রাক্তন অধ্যাপক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় |