ক্ষমতার চেয়ে বড় নেশা কি আর কিছু হয়? সীমানাহীন ক্ষমতা? ঠিক যা চাইব তা-ই? আই এম এফ-এর ডিরেক্টর, ফ্রান্সের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নিবার্চনে নিকোলাস সারকোজি’র এক নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী জিতলে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দমিনিক স্ট্রস-কান-এর যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগে ধরা পড়ার ঘটনাটা পড়তে পড়তে এই কথাটাই ভাবছিলাম ক্ষমতা কী করে দেয় মানুষকে! সম্মান আর দক্ষতার শীর্ষবিন্দুতে থাকা এক জনের হঠাৎ এমন পতন! এই ঘটনাটা আসলে ক্ষমতারই গল্প। চূড়ান্ত আর বল্গাহীন ক্ষমতা।
থ্রিল ফ্যাক্টর ঠিক বিন লাদেন-এর মতো নয়, কিন্তু দমিনিক স্ট্রস-কান এখন গ্লোবাল হেডলাইনস-এ ভয়ঙ্কর ইম্পর্ট্যান্ট ‘মহাশয়’। ঘটনাটা এ রকম ১৪ মে স্ট্রস-কানকে নিউ ইয়র্কে সোফিটেল হোটেলের এক মহিলা কর্মীকে যৌন-হেনস্থার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তিনি ঘর পরিষ্কার করতে ঢুকেছিলেন, এই ভেবে যে গেস্ট ঘরে নেই। হঠাৎ স্ট্রস-কান বাথরুম থেকে বেরিয়ে মহিলার ওপর চড়াও হন। মহিলা কোনও মতে পালিয়ে হোটেল-কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। আই এম এফ-এর বড়কর্তাকে এরোপ্লেন থেকে গ্রেফতার করে নিউইয়র্ক পুলিশ।
ভি ভি ভি আই পি, সামনে এমন জ্বলজ্বলে ভবিষ্যৎ এমন অপরিণত কাণ্ডখানা করেন কী করে? প্রশ্নটা উঠবেই। উত্তর: ক্ষমতা। ক্ষমতাবানরা ভাবেন, আমার এত দাপট, আজ বাদে কাল একটা গোটা দেশ শাসন করব, আমাকে কিনা এক জন মহিলা কর্মচারীর সম্মতির পরোয়া করতে হবে? কিন্তু ক্ষমতা আসে কোথা থেকে? স্ট্রস-কান-এর ক্ষমতা এসেছিল আই এম এফ-এর ডিরেক্টর হওয়ার সুবাদে। এই ক্ষমতা কি তিনি অর্জন করেছিলেন? উত্তর,
হ্যাঁ রেকর্ড বলছে, তাঁর মতো দক্ষ কর্মী এবং প্রশাসক পাওয়া বিরল। নিজের কাজের ময়দানে তিনি বড় ওস্তাদ। ঠিক সেই কারণেই কি নিজের অর্জিত ক্ষমতা নিয়ে এত মাস্তানি? আমরা যেমন বলি দস্যি হলে কী হবে, অঙ্কে কিন্তু মাথাটা দারুণ। তাই দস্যির ছুটকোছাটকা অপরাধ মাফ হয়ে যায়।
স্ট্রস-কান-এর জীবনবৃত্তান্ত পড়লে মনে হয়, একটু বেশিই দস্যিপনা চালালেও পার পেয়ে গিয়েছেন বার বার। এ দিক ও দিক থেকে খবর এসেছে বইকী। নিজের অফিসের অধস্তন মহিলা কর্মী, সাংবাদিক অনেকেই নাকি তাঁর যৌন-দস্যিপনার শিকার, কিন্তু তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটে থেকেছেন। অনুমান করা যায়, তাঁরা ভেবেছেন, বললে ক্ষমতার চাপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। কিন্তু সোফিটেল হোটেল তাঁর নিজস্ব ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে। তাই, স্ট্রস-কান ধরা পড়লেন। তাঁর ব্যক্তিগত অন্যায়ের অভিযোগ তাঁর পেশাদারি জীবনকেও বরবাদ করে দিল। আই এম এফও গেল, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও গেল!
যাবেই। স্ট্রস-কান তাঁর পেশাদারি সূত্রে পাওয়া ক্ষমতা কোথায় ব্যবহার করেছেন? ব্যক্তিগত ইচ্ছা চরিতার্থ করতে। অধস্তন কর্মচারী, সাংবাদিক কিংবা হোটেলের মহিলা কর্মীকে হেনস্থা করা বা তাঁর যৌনইচ্ছায় সঙ্গত দিতে বাধ্য করা কোনওটাই নিশ্চয় তাঁর পেশাদারি রুল-বুক-এ ছিল না। কিন্তু তিনি নিজেই রুল-বুকটি বার বার ভেঙেছেন। এত দিন ধরা পড়েননি, এই যা। পেশাদারি সূত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতা যদি ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তা হলে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের অন্যায় কেন পেশার ক্ষেত্রে গণ্য করা হবে না?
আর, কাগজেকলমে আমরা যতই পেশাদারি জীবন আর ব্যক্তিগত জীবন আলাদা করার কথা বলি, আদতে কি পারি? বড় বড় ম্যানেজমেন্ট বইয়ে পড়ে এসেছি ব্যক্তিগত আর পেশাদারি জীবন আলাদা হওয়া উচিত, অফিসের টেনশন বাড়িতে এনো না, বাড়ি বসে অফিসের কাজ করো না কিন্তু শুনছে কে? মাসের শেষে টার্গেট পূরণ না হলে ব্যক্তিগত জীবনের সিনেমা দেখা-পপকর্ন খাওয়া কি হাই ব্লাড প্রেশার আটকাতে পেরেছে? পারেনি। একটাই মানুষ বাড়ি থেকে অফিস যায় আর সেই মানুষটাই অফিস থেকে বাড়ি ফেরে। অফিসের কলিগদের সঙ্গে সে একটা সময়ের পর ব্যবহার করে বন্ধুর মতো, যে সম্পর্কটা পেশাদারি নয়, বিপদে পড়লে টাকা ধার চায় বস-এর কাছ থেকে। কেবল পেশাদারি এথিকস মেনে চললে, এ কাজ নৈব নৈব চ। বাড়িতে সে মিথ্যে কথা বলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারে। অফিসে মিথ্যে কথা বলে বউ-এর সঙ্গে শপিংয়ে যায়। অফিসে নতুন জয়েন করা মেয়েটিকে তার ব্যক্তিগত ভাবে ভাল লেগে যায়। বস-এর ওপর রাগ হয় ঠিক সে রকম, যেমনটা হয়েছিল বড় জ্যাঠা যে দিন রাত করে বাড়ি ফেরার জন্য ধমকেছিলেন। তা হলে? অফিস যাওয়ার পথে ১০:০৩:৪৭ আর অফিস থেকে ফেরার পথে ৬:৩৫:১৩ ঠিক এই সময় দুটোয় বুঝি সে চট করে বদলে নেয় নিজের সত্তা? তা যদি সত্যি কেউ পেরে থাকে, তা হলে নির্ঘাত তার দ্বৈতসত্তা। আমরা যখন ব্যক্তিগত চরিত্র দেখে পেশাদারি জীবনে এক জনকে নিযুক্ত করি, তখন কী ভাবি? যে, এই ছেলেটা বা মেয়েটা সৎ কিন্তু মাথা-গরম, দক্ষ কিন্তু ফাঁকিবাজ। কী বিচার করলাম? তার ব্যক্তিগত গুণাগুণ। ভাবলাম, এই গুণ বা দোষগুলোই প্রতিফলিত হবে তার পেশাদারি জীবনে। তা না হলে, যে লোকটা বাড়িতে অসৎ, সে অফিসে খুব সৎ হবে কি?
তার ওপর হাতে যদি চলে আসে বেলাগাম ক্ষমতা। সামলাতে পারবে তো? ক্ষমতা যে সবচেয়ে বড় মাদক। তার নেশায় বুঁদ মানেই বেলাইন অনন্ত ঘূর্ণিতে নিক্ষেপ। ভাবুন তো, আমার ইচ্ছেয় অন্য এক জন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এর চেয়ে বড় ‘কিক’ তো কিছুই নয়। আমি চাইছি তবে তার চাকরি থাকছে, সে চাইছে না তবু চোখ-নাক-মুখ টিপে আমার যৌনবাসনা তৃপ্ত করছে। এখানে যৌনতার থেকেও বড় প্রাপ্তি জবরদস্তি তার অনিচ্ছাকে পোষ মানানো। আর এই রুটিন রোজ রোজ বছর বছর চলতে থাকলে একটা সময় ‘ক্ষমতা’ও হয়ে যায় অন্যতম বেসিক ইন্সটিংক্ট। মস্তিষ্ক ভুলে যায় কোনটা অর্জিত আর কোনটা জন্মগত। যেমন, ভালবাসা, লোভ, ক্ষোভ, হিংসা জন্মগত, তেমনই ‘ক্ষমতা’র অণু-পরমাণু শিরা-উপশিরা-ধমনী-মহাধমনীতে বাসা বাঁধে। এক বার সে যায় মস্তিষ্কে, এক বার হৃদয়ে। গুলিয়ে যায় সীমানা জন্মগত না অর্জিত, ব্যক্তিগত না পেশাদারি। ক্ষমতা হয়ে যায় সেই মানুষটা, আর সেই মানুষটা হয়ে যায় ক্ষমতা। ভাবাই যায়, ‘ক্ষমতা’ স্ট্রস-কান-এর অন্দরে এত বছর বসবাস করেছে আর এত রকম ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে যে তার ‘পেশাদারি’ দাবি স্ট্রস-কান-এর মন-মস্তিষ্ক থেকে তামাদি হয়ে গিয়েছে। জমিয়ে বললে, Power became Strauss-Kahn.
যাঁরা ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ অভ্যেস করতে পেরেছেন, যাঁরা পেরেছেন অনীতিকে দমিয়ে রাখতে, তাঁদের আমরা মনীষী বলি, প্রণাম করি, টেক্সট বইয়ে তাঁদের জীবনী পড়ি। জীবনের প্রথম ভাগে, যখন প্রাপ্ত আর অর্জিত গুণাগুণ আমাদের থালায় সাজিয়ে দেওয়া হয়, তখন নিজেদের মনকে বলি, আমি সংযম করব, আমি হব ইতিহাস। কিন্তু তার পর যখন ক্ষমতার আয়েসগুলো জীবনকে মথিত করে তোলে তখন নিজেকে যুক্তি দিই যা পেয়েছি তা-ই তো ব্যবহার করছি, আমার অন্যায় কোথায়? ক্ষমতা কি আলমারিতে তুলে রাখার জন্য? কখন নীতি আর অনীতির বাউন্ডারি গুলিয়ে পাট হয়ে যায়, নিজেই বুঝতে পারি না।
স্ট্রস-কান-এর সমস্যাটা আসলে ‘প্রবলেম অব প্লেনটি’। একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল তাঁর ক্ষমতা। আমাদের যেমন এখানে ওখানে দু-পাঁচ টাকার রেজকি পড়ে থাকে। ফেলে-ছড়িয়ে ব্যবহার করতে গিয়ে তাঁর দাপট বেখেয়ালে একটু বিপজ্জনক কুঠরিতে চলে গিয়েছে। এই বিপদ আমরাও ভাল বুঝি বসকে গালাগাল দিয়ে এসএমএসটা করতে গিয়েছিলাম প্রাণের বন্ধুকে, বেখেয়ালে করে দিলাম বস-এর বন্ধুকে সেই আর কী। |