আপনার কলমে


মৃত্যু উপত্যকার হাতছানি
সঞ্জীব পাল
বাটির মতো একটা উপত্যকা। সেখানকার মাটি এত শুষ্ক, লবণাক্ত ও বিষাক্ত যে কোনও গাছপালাই জন্মাতে পারে না! জায়গাটা আবার এত নিচু যে সেখানে শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুপযুক্ত বিষাক্ত গ্যাস জমে যায়! এখানে যাওয়া মানে মৃত্যু অনিবার্য। তাই বোধ হয় নাম ‘মৃত্যু উপত্যকা’। না! এমন উপত্যকা বাস্তবে আছে কি না জানা নেই। কিন্তু ছেলেবেলার দিনগুলো যখন আনন্দমেলা-শুকতারা পড়ে কাটত তখন এমনই এক উপত্যকার গল্প পড়েছিলাম। এতটাই গা ছমছম করা সেই গল্প যে নামটা আজও মনে গেঁথে রয়েছে। তাই ক্যালিফোর্নিয়ায় এসে যখন শুনলাম, এখানে ওই নামের একটা জাতীয় উদ্যান রয়েছে, তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। কেমন সেই উপত্যকা? কেনই বা এই ভয়ঙ্কর নাম? ভয়াবহতার দিক থেকে এটি গল্পের উপত্যকার থেকে কোনও অংশে কম নয়। ১৯১৩ সালে ডেথ ভ্যালিতে ১২৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা ৯ বছর ধরে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ছিল। সেন্টিগ্রেডের হিসেবে যেটা প্রায় ৫৪ ডিগ্রি!

কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই তো আর যাওয়া হয় না। ‘ডেথ ভ্যালি’ যেতে সঠিক পরিকল্পনা খুবই জরুরি। এক শনিবারের দুপুরে আমাদের আজুসা শহরের আস্তানা থেকে রওনা দিলাম ‘সিন সিটি’ লাস ভেগাসের উদ্দেশে। গাড়িতে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে। মৃত্যু উপত্যকার অবস্থান এ শহর থেকে প্রায় দেড়শো মাইল দূরে, ক্যালিফোর্নিয়া আর নেভাদা রাজ্যের সীমানায়। আমার স্ত্রী সুপর্ণা ও আমাদের আট মাসের মেয়ে আয়ুষী সঙ্গে আছে, বেশি অ্যাডভেঞ্চার করাটা ঠিক হবে না। তাই ঠিক করলাম, গাড়ি নিয়ে যাব। শুক্র-শনিবার এখানে হোটেলের ভাড়া অনেক বেশি। রবিবার থেকে আবার ভাড়া কমে যায় প্রায় এক তৃতীয়াংশ, সেই বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। লাস ভেগাস শহর থেকে কিছুটা দূরে একটি হোটেলে খানিক সস্তায় ঘর বুক করা হল। রাতটা হোটেলে কাটিয়ে পরের দিন সকালেই রওনা দেব মৃত্যু উপত্যকার উদ্দেশে।

পর দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেনটাইন্স ডে! যে দিন লোকে প্রেম, ভালবাসা, শপিং মল, গিফট এই সবের চর্চা করে সেই দিনে মৃত্যু উপত্যকা, ভুতুড়ে শহর এই সব শব্দগুলো একটু বেমানান লাগলেও সেন্ট ভ্যালেনটাইন্সের আশীর্বাদ নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

মৃত্যু উপত্যকার প্রবেশ পথ
পার্কটির নাম ‘মৃত্যু উপত্যকা’ হল কেন তা নিয়ে অনেক মত আছে। তবে সর্বজনগ্রাহ্য মতবাদটি হল— ১৮৪৯ সালে যখন ক্যালিফোর্নিয়ার সুটারস কারখানায় সোনার সন্ধান পাওয়া যায় তখন আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন ক্যালিফোর্নিয়াতে আসতে শুরু করে। ইতিহাসে এই সময়ের নাম ‘ক্যালিফোর্নিয়ার সোনার দৌড়’ (গোল্ড রাশ)। সেই সময় এক দল অভিযাত্রী গরুরগাড়িতে বাক্স প্যাঁটরা বেঁধে সোনার সন্ধানে রওনা হয়ে অক্টোবর মাসের কোনও এক দিন সল্টলেক সিটি পৌঁছয়। সামনে বরফে মোড়া সিয়েরা পর্বত, যা এ সময় অতিক্রম করা প্রায় অসম্ভব। এমতাবস্থায় তারা হদিশ পেল একটি ‘পুরনো স্প্যানিশ’ পথের। রাস্তাটা সিয়েরা পর্বতের দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে গিয়েছে। তবে এ পথে আগে কেউ কখনও যায়নি। কিন্তু সোনার লোভ বড় লোভ! যাত্রা শুরু হল। সমস্যা বাঁধল যখন অভিযাত্রীদের এক জন আরও একটি রাস্তা খুঁজে পেল, যেটা ‘ডেথ ভ্যালি’র মধ্যে দিয়ে। এই পথে তাদের ৫৫০ মাইল রাস্তা কম হবে। আগে পৌঁছনোর বাসনায় দলটি দু’ ভাগ হয়ে গেল। এক দল পুরনো স্প্যানিস পথ দিয়েই চলতে লাগল। আর অন্য দলটি যাত্রা শুরু করল অচেনা ডেথ ভ্যালির মধ্যে দিয়ে। কিন্তু তাদের কল্পনাতেও ছিল না, কী বিভীষিকা এ পথে অপেক্ষা করে আছে!

মাস খানেক উপত্যকার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে যখন খাবার-জল প্রায় শেষ, তখন গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতন শুরু হল তুষার ঝড়। আপাত ভাবে দুর্ভাগ্যজনক মনে হলেও অভিযাত্রীদের কিন্তু এই দুর্যোগ সাহায্যই করেছিল। হয়তো শীতকাল বলেই সেই সুবিধা হয়েছিল তাদের। তুষার ঝড়ে প্রাকৃতিক ভাবে অনেক জলকুণ্ড তৈরি হয় যা ওই অভিযাত্রীদের জলের কষ্ট লাঘব করে। কিন্তু খাদ্য সংকট তো আর মেটার নয়। কথায় আছে ‘ফরচুন ফেভারস দ্য ব্রেভ’! খাবারের অভাবে গাড়িটানা শীর্ণকায় গরুগুলির মাংস খেয়েই নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছিল তারা। পথের শেষে অভিযাত্রীরা যখন এই উপত্যকা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন তাদেরই এক জন বলে ওঠে, ‘বাই বাই ডেথ ভ্যালি’। সেই থেকেই এটি ‘মৃত্যু উপত্যকা’ নামে পরিচিত।


পাথরের স্তরের উপর আলোর খেলা মরুভূমির মধ্যে জলের কুণ্ড
আমরা যখন ‘ডেথ ভ্যালি’তে পৌঁছলাম তখন সকাল প্রায় এগারোটা। বিশেষ লোকজন চোখে পড়ল না। বেশ কিছুটা যাওয়ার পরে এল জেব্রাস্কি ভিউ পয়েন্ট। সামনেই পার্কিং লট থেকে কালো পিচের রাস্তা ভিউ পয়েন্টের দিকে চলে গিয়েছে। খাড়াই পথে একটুখানি হাঁটা। পথের মাঝে কাঠের বেঞ্চ রাখা আছে জিরিয়ে নেওয়ার জন্য। প্রকৃতি দীর্ঘ দিন ধরে মার্বেল পাথর কেটে এই রংবেরঙের পাহাড় বানিয়েছে। সকালবেলা সূর্যের আলো পড়ে সেই পাহাড় খুব সুন্দর রঙের খেলায় সেজে ওঠে। ভিউ পয়েন্ট থেকে নীচে দেখা যায় ‘২০ খচ্চরের টানা ওয়াগন’-এর রাস্তা। এই রাস্তারও এক গল্প আছে। সেটা পরে বলছি। জেব্রাস্কি পয়েন্ট দেখে যখন ফিরছি তখন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। হঠাত্ শুনলাম কেউ যেন আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘নমস্কার’। কোনও ভারতীয় হবেন ভেবে তাকিয়ে দেখি ছেঁড়া কাপড়ে, হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা এক লোক। ভারতীয় নন, বিদেশি! তবে পোশাক দেখে বেশ গরিব বলে মনে হল। প্রতি নমস্কার জানিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাব, দেখি লোকটি কাঁধের ঝোলা থেকে বেলুন বার করে আয়ুষীর জন্য ফোলাচ্ছেন। এর পর নির্ঘাত পয়সা চাইবেন! কিন্তু ভাঙা হিন্দিতে এ বার তিনি বলতে লাগলেন ‘কাইসে হো’ ‘কাঁহা সে হো’ ইত্যাদি বাক্য। অবাক হওয়ার কিছু নেই, ক্যালিফোর্নিয়ায় এত ভারতীয় আছে যে এখানকার স্থানীয় লোকেরাও অনেক ছোট ছোট হিন্দি শব্দ-বাক্য শিখে গিয়েছে। আমি ‘কলকাতা’ বলাতে তিনি বেশ আনন্দিত হলেন বলে মনে হল। এর পর টুকরো টুকরো বাংলায় বলতে লাগলেন ‘কেমন আছে?’ ‘ভাল আছে?’ ‘চপ-সিঙ্গাড়া খাবে?’ ‘ওম শান্তি, ওম শান্তি’... আরও নানা কথা। এ বার আমার অবাক হওয়ার পালা। বাংলা থেকে এত দূরে এই মৃত্যু উপত্যকায় এক জন ভিনদেশির কাছে বাংলা শুনতে পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! কোথা থেকে বাংলা শিখেছেন জিজ্ঞাসা করায় জানালেন— আদতে তিনি সান ফ্রান্সিসকোর বাসিন্দা। ডেথ ভ্যালিতে ঘুরতে এসেছেন কোনও একটি দলের সঙ্গে। প্রায় পাঁচ বছর ভারতে কাটিয়েছেন। কিছু বছর হিমালয়ে তপস্যাও করেছেন নাকি, শান্তির খোঁজে! তার পর বেশ কয়েক বছর মাদার টেরিজার আশ্রমে কাজ করেছেন কলকাতায়। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই বেলুন দিয়ে একটা কুকুর বানিয়ে দিলেন তিনি আয়ুষীকে। খবরের কাগজ খুললেই আজ যে দেশের চারিদিকে খুনোখুনি আর হানাহানির খবর, সেখানে ভিনদেশ থেকে মানুষ গিয়েছে শান্তির খোঁজে! সত্য সেলুকাস...

তাঁকে প্রথম দিকে অন্য চোখে দেখায় এ বার নিজেরই খারাপ লাগল। ‘ফটাস’ আওয়াজে ভাবনায় ছেদ পড়ল। আয়ুষী এর মধ্যেই কামড়ে দিয়েছে বেলুনটা। মৃত্যুর উপত্যকায় একটি বেলুনের অকাল মৃত্যু!

পরবর্তী গন্তব্যস্থল ‘ব্যাড ওয়াটার বেসিন’। জেব্রাস্কি পয়েন্ট থেকে এটা বেশ অনেকটাই দূরে। এই জাতীয় উদ্যানে এটা একটা সমস্যা। আলাস্কার জাতীয় উদ্যানগুলি বাদ দিলে, আয়তনে এটিই আমেরিকার বৃহত্তম জাতীয় উদ্যান। কাজেই একটা ভিউ পয়েন্ট থেকে অন্যত্র যেতে অনেকটা সময় লেগে যায়।


ব্যাড ওয়াটার বেসিন মাটির উপর জমে থাকা লবণ
টেলিস্কোপ পিক
পার্কের মধ্যে ‘ব্যাড ওয়াটার বেসিন’ অন্যতম দর্শনীয়। কারণ এটি আমেরিকা তথা পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে নিচু জায়গা, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮২ ফুট নীচে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু জায়গা ইজরায়েল আর জর্ডনের মধ্যে অবস্থিত মৃত সাগর বা ডেড সি— সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩৭১ ফুট নিচু। ব্যাড ওয়াটার বেসিনের পার্কিং লট থেকে কাঠের রাস্তা নেমে গিয়েছে। জায়গাটা ভেজা ভেজা এবং লবণাক্ত। মাটিতে লবণের প্রলেপ লেগে সাদা হয়ে রয়েছে। সাদা লবণাক্ত জমির মাঝে মাঝে ছোট ছোট গর্তে জল জমে। পাশের পাহাড়ের উপরে সমুদ্রপৃষ্ঠের সীমা চিহ্নিত করা আছে। ভাবতেই অবাক লাগে, সমুদ্রপৃষ্ঠের কত নীচে রয়েছি আমরা! চারিদিক ফাঁকা, সাদা মাঠ খাঁ খাঁ করছে। দূরে এই পার্কের সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ ‘টেলিস্কোপ পিক’ বরফ-চাদর জড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

আরও দক্ষিণে এগিয়ে গেলে পড়বে অ্যাশবোর্ড কারখানার ধ্বংসাবশেষ যেখানে আগে সোনার আকরিক পরিশোধন করা হতো। এটা দেখে আমরা উত্তরে রেস ট্র্যাকের উদ্দেশে রওনা দিলাম। পথে পড়ল একটা প্রাকৃতিক সেতু— লাল পাথরের তৈরি ‘আর্চ’, সেতুর মতন আকার নিয়েছে। এটি হাঁটা পথে প্রায় আধ মাইল। এর পর প্রধান সড়ক থেকে একটা একমুখী রাস্তা চলে গিয়েছে চিত্রকরের রঙের থালা বা আর্টিস্ট প্যালেট-এর দিকে। পাথরের উপর বিভিন্ন রঙের প্রলেপ— নীল, সবুজ, গোলাপি। জায়গাটি আসলে আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে তৈরি হয়েছে। আর বিভিন্ন রঙের মধ্যে লাল, হলুদ আর গোলাপি রং হয়েছে লোহার নানা যৌগ থেকে— মাইকা সৃষ্টি করেছে সবুজ রং আর ম্যাঙ্গানিজ তৈরি করেছে রক্তাভ।

সেখান থেকে আমরা পৌঁছলাম ফার্নেস ক্রিক দর্শনার্থী কেন্দ্রে। মরুভূমির মধ্যে যেন একটা মরুদ্যান। এখানে খাবারদাবার, গ্যাসোলিন— সব কিছুই পাওয়া যায়। যদিও দামটা একটু বেশি। তবে পাওয়া যে যায় এটাই ভরসা! ভিজিটর সেন্টারে একটা সুন্দর জাদুঘর আছে, সেখানে উপত্যকার বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক নিদর্শন রাখা আছে।

রেঞ্জারের সঙ্গে কথা বলে মনটা খারাপ হয়ে গেল— রেস ট্র্যাক দেখার অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু বিগত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে নাকি পুরো ট্র্যাক জলে ভরে গিয়েছে এবং রাস্তাও আপাতত বন্ধ। ‘রেস ট্র্যাক প্লায়া’ এমন এক রহস্যময় জায়গা যেখানে ফাঁকা মাঠের মধ্যে বড় বড় পাথর রয়েছে। এই অঞ্চলে খুব জোরে হাওয়া প্রবাহিত হয়। আর বৃষ্টিতে মাঠে জল জমে পিচ্ছিল হয়ে গেলে হাওয়ায় এই পাথরগুলো গড়াতে শুরু করে। আর তার ফলেই তৈরি হয় এই রেস ট্র্যাক। তবে এখানে যাওয়ার জন্য ভাল রাস্তা নেই। প্রায় ২৭ মাইল এবড়োখেবড়ো পাথুরে রাস্তা। ফলে চার চাকার গাড়ি ছাড়া গতি নেই। এটা না থাকলে পার্ক কর্তৃপক্ষও যেতেও দেবে না।

রেস ট্রাক (পার্কের সাইট থেকে নেওয়া)


জাদুঘরে রাখা খনিজ বোরাক্স আকরিকের নমুনা
হারমোনি বোরাক্স কারখানার ধ্বংসাবশেষের কাছে রাখা ২০ খচ্চরের টানা ওয়াগন

রেস ট্র্যাকে যখন যাওয়া হল না তখন তার কাছে স্কটি ক্যাসল বলে একটা জায়গা দেখতে গেলাম। পথে পড়ল হারমোনি বোরাক্স কারখানা। কাচ তৈরিতে অপরিহার্য উপাদান হল বোরাক্স। সান ফ্রান্সিস্কোর ব্যবসায়ী উইলিয়াম কোলম্যান এই কারখানাটির পত্তন করেন। উপত্যকায় প্রাপ্ত কটনবল বোরাক্স পরিশোধিত করা হতো এখানে। এখন কারখানায় ব্যবহৃত জিনিসের নিদর্শন রাখা আছে। যে কাঠের বগি করে বোরাক্স পরিবহণ করা হতো সেটিও আছে। ২০ খচ্চরের গল্প এই বগিকে ঘিরেই। বিশাল বিশাল দু’টি ওয়াগানে খনিজ ভর্তি করে, আর একটা ট্যাঙ্কারে জল ও খাবারদাবার নিয়ে ১০ দিন এই ভয়ঙ্কর মরুভূমির মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে ১৬৫ মাইল দূরের রেল স্টেশনে ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৯ সাল অবধি এই ২০ খচ্চরের গাড়ি খনিজ পরিবহণ করেছে। তখনকার দিনে এটা ছিল কোম্পানির অন্যতম বিজ্ঞাপন।

এ বার আমাদের লক্ষ্য মরুভূমির মধ্যে গড়ে ওঠা স্কটি দুর্গ। ৩০ ডলার দিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম।

আমরা যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন এক দল লোক দুর্গের ভেতরে ঢুকেছে, পরের গ্রুপ ঢুকতে আরও কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। এ দিকে বেলা প্রায় শেষের দিকে। আমাদের আরও একটা জায়গা দেখা বাকি। তাই ক্যাসলের চার পাশে নিজেদের মতো একটু ঘুরে আবার ফিরতি পথে রওনা দিলাম মরুভূমির বালি-পাহাড় দেখতে।


স্কটি ক্যাসল
৪৫ মাইল ফিরতি রাস্তা ড্রাইভ করে যখন স্যান্ড ডিউন্সে পৌঁছলাম তখন সূর্য পশ্চিমে হেলে গিয়েছে। আর পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছে স্যান্ড ডিউন্সের উপর। ছবি তোলার একেবারে ‘গোল্ডেন টাইম’। তাড়াতাড়ি গাড়ি পার্ক করে নেমে পড়লাম। আয়ুষী বালি দেখে তো প্রচণ্ড উত্তেজিত! মুঠোমুঠো বালি নিয়ে খেলতে শুরু করেছে সে। বালির ঢিপিতে চড়া যত সহজ ভেবেছিলাম তা কিন্তু নয়! তাই ভাবলাম, আমি একাই একটু ঘুরে ছবি তুলি। জুতোর মধ্যে বালি ঢুকে যাওয়ায় তা খুলে গাড়িতে রেখে দিলাম। বিকেলবেলা বলে বালি খুব একটা গরম ছিল না, সহজেই হাঁটা যাচ্ছিল। খুব তাড়াতাড়ি এক একটা বালির ঢিবি টপকে যেতে গেলাম। যত ডিউন্সের ভিতরে যাচ্ছি, ঢিবিগুলো উচ্চতায় ও আয়তনে ততই যেন বেড়ে যাচ্ছিল। ফলে ক্রমশ দম কমছে আর বাড়ছে তেষ্টা। একটা সময়ে ঢিবিগুলি পাহাড়ের আকার নিয়েছে মনে হল। একটা অতিক্রম করে যেই নামছি— সামনে-পিছনে শুধুই বালি। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় হঠাত্ করে নিজেকে বেশ একা মনে হল। গ্রাস করছিল একটা বিষণ্ণতা, একটু দম আটকানোও লাগছিল। দূর থেকে কাছে লাগলেও ডিউন্সগুলো আসলে বেশ দূরে। হাঁচোড়পাঁচোড় করে আবারও একটা ঢিবি পেরোলাম। দেখলাম বালির উপর অসংখ্য পায়ের ছাপ। বালির মাঝে মাঝে রয়েছে কাঁটা ঝোপের মতো কটন উড ট্রি আর ইউকা গাছ, যাতে হলুদ ও সাদা রঙের সুন্দর ফুল ফুটে আছে। কোথাও আবার বালির উপর ঢেউয়ের মতো আলপনা আঁকা। এ ভাবে বেশ খানিক ক্ষণ চলার পর এসে পৌঁছলাম সব থেকে উঁচু ঢিবিগুলোয়। এ বার খানিকটা জিরিয়ে নিলাম। উঁচু বলে দূরদূরান্ত অবধি দেখা যাচ্ছে। ছোট ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করছে, বালির ঢিবি থেকে গড়িয়ে নীচে নামছে। এক চিনা দম্পতি পাশ দিয়ে চলে গেল। ভ্যালেন্টাইন্স ডে বলে একটু বেশিই অন্তরঙ্গ যেন! আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা দেখলে অবশ্যই এক মাথা ঘোমটা টেনে বলতেন ‘যত্ত সব আদিখ্যেতা’! সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। ফোটো তুলে গাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। আবারও একই পথের পুনরাবৃত্তি। তবে যাওয়ার সময় ছবি তোলার জন্য যেমন তাড়াহুড়ো করেছিলাম, ফেরার সময় সেই ভুলটা করিনি।
মরুভূমিতে ফুটে ওঠা ফুল...
এই সমস্ত জায়গায় কখনও কখনও দেখা দেয় ভয়ঙ্কর মরুঝড়। এমনিতেই বালির পাহাড় চড়া কঠিন! তার উপর সেটা আবার মরুঝড়ের মধ্যে চড়তে হলে কী অবস্থা দাঁড়ায়, ভেবেই শিহরণ জাগে। চোখ বন্ধ করে যেন দেখতে পেলাম— প্রায় ১৫০ বছর আগে প্রচণ্ড ধুলোর ঝড়ের মধ্যে দিয়ে, মৃত্যুর নিশ্চিত হাতছানিকে উপেক্ষা করে এক দল জীর্ণ শীর্ণ অভিযাত্রী ধীরে ধীরে আদিম মৃত্যুর উপত্যকার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। ঐতিহাসিক অভিযান তাদেরকে অমর করে রেখেছে মৃত্যু উপত্যকায়! প্রকৃত অর্থেই তারা ‘অমৃতের পুত্র’! ছেলেবেলায় গল্পের পাতায় পড়া মরুযাত্রীদের কাহিনি যে শিহরণ জাগাত সেটা আবার অনুভব করলাম এই মৃত্যুর উপত্যকায়। ডেথ ভ্যালি থেকে ফেরার পথে, বেটি শহর আসার আগে রাস্তায় পড়ে রাইওলাইট নামে একটা ‘ঘোস্ট টাউন’। সেখানে কেউ থাকে না। এটা একটা পরিত্যক্ত ভুতুড়ে শহর। সন্ধের অন্ধকারে ফ্যাকাশে আকাশের সামনে কালো কালো বাড়ির ভগ্নস্তূপ দাঁড়িয়ে আছে। ভূত বা প্রেতাত্মা সেখানে আছে কি না জানি না। কিন্তু যখন পাশ দিয়ে ফিরছি গা টা বেশ ছমছম করে উঠল!

সরকারি হিসাবে এই উপত্যকায় কোনও মানুষের মৃত্যু হয়নি। তবে বেসরকারি হিসাবে এক জন অভিযাত্রীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষ ছাড়াও যে কত প্রাণী এই উপত্যকায় এসে খিদে-তেষ্টায় মৃত্যুবরণ করেছে তার হিসাব কেউ রাখেনি। সেই পরিসংখ্যান বুকে নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে আছে মৃত্যু উপত্যকা। নৈঃশব্দ্যের মাঝে হয়তো শুনতে পাওয়া যাবে তাঁদের আত্মার ফিসফাস আওয়াজ!

স্বর্ণাভ স্যান্ড ডিউন্সে সোনালি সূর্যালোক

এক কথায়: প্রযুক্তির কল্যাণে মৃত্যু উপত্যকায় হয়েছে হাওয়াবদল, দামাল উপত্যকা
নতুন প্রজন্মের সামনে আজ শান্ত নাকি সুপ্ত সেটা শুধু সময়ই বলবে।

বাড়ি: বর্ধমান
শিক্ষা: শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বিই
পেশা: কর্মসূত্রে ২০০৪ থেকে আমেরিকার বাসিন্দা
নেশা: দাবা খেলা, বই পড়া
শখ: বেড়ানো, ছবি তোলা
ছবি: লেখক

লেখকের আরও ভ্রমণকথা:
• মহান ধুম্র পর্বতমালা
• স্বপ্নের অ্যারিজোনা

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ