বকখালির শান্ত সৈকতে |
উমা চক্রবর্তী |
গরমের ছুটিতে কোথাও একটা যেতেই হবে, এরই পরিকল্পনা চলছিল বহু দিন ধরে। কিন্তু জায়গাটা ঠিক করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হল আমাদের। কারণ এত গরমে যে কোনও জায়গায় যাওয়া বেশ কষ্টকর। অবশেষে ঠিক হল বকখালি। আগেও গিয়েছিলাম, কিন্তু থাকিনি। এ বার ঠিক হল বকখালিতে থেকে আশেপাশের জায়গাগুলোও একটু দেখতে হবে। |
হুগলি নদী দর্শন |
বকখালির যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ নয়। কলকাতা থেকে ভূতল পরিবহণের বাসে বা ট্রেনে চেপে নামখানা পর্যন্ত গিয়ে ভেসেল বা নৌকায় হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী পেরিয়ে আবার বাস। আমরা অবশ্য নিজেদের গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ি থেকে বকখালি ১১০ কিলোমিটারের মতো। সকাল বেলা বেরিয়ে পড়লাম, পথে ডায়মন্ড হারবারে দাঁড়িয়ে হাল্কা ব্রেকফাস্ট আর সেই সঙ্গে হুগলি নদী দর্শন— যেন মনটা ভরিয়ে দিল।
তার পর আবার শুরু পথ চলা। পিচে বাঁধানো রাস্তা খুব চওড়া না হলেও যথেষ্ট ভাল। পথে নামখানা পর্যন্ত মাঝে মাঝে কয়েকটি বাজার রয়েছে। নামখানায় যখন পৌঁছলাম তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। সঙ্গে বেড়েছে রোদের তেজও। এর মধ্যেই হল বিপত্তি। হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী পারাপার হওয়ার বড় ভেসেলটি বিগড়ে যাওয়ায় গাড়ির লম্বা লাইন পড়ে যায়। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর পৌঁছলাম নদীর ওপারে। তার পর সোজা রাস্তা ধরে মিনিট কুড়ি গাড়ি চালিয়েই বকখালি। আগে থেকে ওয়েস্টবেঙ্গল ট্যুরিজমের বকখালি ট্যুরিস্ট লজে ঘর বুক করা ছিল, তাও আবার ইন্টারনেটের মাধ্যমে!
লজের ব্যবস্থা খুবই ভাল। জিনিসপত্র রেখেই সোজা চলে গেলাম সমুদ্রে। ভাটা থাকার কারণে সমুদ্র উত্তাল ছিল না। আমার চার বছরের মেয়ে জীবনের প্রথম সমুদ্র স্নানকে খুবই উপভোগ করল। বেলা পড়ে আসায় রোদের তাপও কমে গিয়েছিল। এক সময় জল থেকে উঠে লজের দিকে ফিরলাম। লজে খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও, বাইরের একটি হোটেলে গরম গরম ভাত, ডাল, আলুভাজা, তরকারি, চিংড়ি আর চিকেন কারি খেতে ভালই লাগল। খাওয়া শেষ করে ঘরে ফিরে এ বার একটু বিশ্রাম। |
বকখালির শান্ত সাগর
|
ফ্রেজারগঞ্জের উইন্ডমিল |
|
বিকেলে ফ্রেজারগঞ্জের সমুদ্রতটে গেলাম। শোনা যায়, ১৯০৩-০৪ সালে বাংলার তত্কালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর অ্যান্ড্রু ফ্রেজার এখানকার একটি ছোট বাড়িতে এসে মাঝে মাঝে থাকতেন। তাঁর নামনুসারে এই জায়গাটির নাম রাখা হয় ফ্রেজারগঞ্জ। এখানকার সমুদ্রতটটি খুব নির্জন। মনে কেমন যেন একটা উদাসীনতা নিয়ে আসে। আধো অন্ধকারে দেখলাম, মেঘের বুক চিরে উড়ে গেল কতগুলো অচেনা পাখি, হয়তো বা অজানা পথে, হয়তো বা ঘরে ফেরার টানে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মনে হল জোয়ার আসছে— সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছিল তার গর্জন। কিছু ক্ষণ সেখানে বসে আবার ফিরে এলাম বকখালিতে। সেখানে সমুদ্রের পাড়ে তখন বেশ ভিড় জমেছে। নোনা হাওয়ায় আড্ডাটা সবে মাত্র জমে উঠেছিল, কিন্তু আকাশ দেখে মনে হল ঝড় আসছে। অগত্যা লজে ফিরতে হল।
পরের দিন সারা সকাল কেটে গেল সমুদ্রে। সে দিন সমুদ্র কিছুটা উন্মত্ত ছিল ঠিকই, তবে খুব বড় ঢেউ ছিল না। দ্বিতীয় দিনে বিকেলের গন্তব্য ছিল হেনরি আইল্যান্ড— ফ্রেজারগঞ্জ থাকে প্রায় ৭ কিলোমিটার। এই অঞ্চলের নাম রাখা হয় এক ইউরোপীয় সার্ভেয়ারের নামানুসারে। ১৯ শতকে তিনি এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কর্মরত ছিলেন। কোথাও সরু কোথাও বা চওড়া রাস্তা পেরিয়ে অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছলাম। হেনরি আইল্যান্ডে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়— মাথাপিছু পাঁচ টাকা, গাড়ির জন্য পনেরো টাকা। সন্ধে ছ’টার পর অবশ্য আর ঢুকতে দেওয়া হয় না। সেখানে পৌঁছে রাস্তার জন্য বাধ্য হয়ে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে যেতে হল। দু-ধারে ম্যানগ্রোভ অরণ্য, মাঝে ইটের রাস্তা আর বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে পৌঁছলাম সমুদ্রের তীরে। এখানকার সমুদ্রতট বকখালি বা ফ্রেজারগঞ্জের চেয়ে অনেক বড় আর নির্জন। পুরো জায়গাটা লাল কাঁকড়ায় ভরা। এখানে থাকার জন্য হেতাল, গরান আর সুন্দরী নামে তিনটে গেস্ট হাউসও চোখে পড়ল। একটা ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। |
হেনরি আইল্যান্ড... |
ম্যানগ্রোভ অরণ্য
|
লাল কাঁকড়া |
|
হেনরি আইল্যান্ড থেকে ফ্রেজারগঞ্জ হারবার যাওয়া যায়। আর সেখান থেকে নৌকা করে মোহনা এবং জম্বুদ্বীপেও যাওয়া যায়। হারবার অঞ্চলে নৌকা তৈরি হয়। এই জায়গাটিও ভীষণ সুন্দর। সমুদ্রের তীরে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত আগেও দেখেছি, কিন্তু এখানে দেখা একটি অনন্য সুন্দর সূর্যাস্ত আমার সারা জীবন মনে থাকবে— মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ক্লান্ত সূর্যদেব নির্জন বনানীতে হারিয়ে গেলেন। আর আমরা ফিরে এলাম বকখালিতে।
পর দিন আমরা বকখালির একটা পার্ক দেখতে গেলাম। এখানে কিছু কুমির, বাঁদর আর বড় বড় শিংওয়ালা হরিণ রয়েছে। ঢুকতে জনপ্রতি ২ টাকা করে টিকিট। পার্ক দেখার পর সমুদ্রে স্নান করে খাওয়াদাওয়া সেরে রওনা হলাম শহুরে জীবনের দিকে। সমুদ্রকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চললাম ঠিকই, কিন্তু মন ভরে থাকল ঢেউয়ের ছবিতে। মনে মনে ভাবলাম, সমুদ্র সত্যিই কিছু নেয় না, শুধু দিয়ে যায়। এ বার সে আমায় দিল তিনটি দিনের নয়ন ভোলানো স্মৃতি। মনে হল—
নির্জন তুমি সমুদ্রভূমি
তবু এত দাবি আছে,
শান্ত নীর অশান্ত সমীর
লুটায় তোমার কাছে।
নিটোল সে ঝাউ বন
মন আজ উচাটন
নরম রোদের আলো
বিকেলের গাছে গাছে।
জোয়ার ভাঁটায় মিলে পরিপূর্ণ পারাবার,
ফিরে যাই সংসারে
মনে মনে তোমারে করি
করজোড়ে নমস্কার।
|
এক কথায়: সমুদ্র সত্যিই কিছু নেয় না, শুধু দিয়ে যায়। |
|
টুকিটাকি তথ্য |
কী ভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে ভূতল পরিবহণের বাস ছাড়ে। অথবা ট্রেনে চেপে কলকাতা থেকে
নামখানা পর্যন্ত
গিয়ে হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী পেরিয়ে বাস বা গাড়িতে বকখালি।
কোথায় থাকবেন: সরকারি ট্যুরিস্ট লজ বা অনেক বেসরকারি হোটেল রয়েছে।
সঙ্গে রাখবেন: টর্চ আর পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকা, কারণ বকখালিতে কোনও এটিএম নেই। |
|
|
পেশায় স্কুল শিক্ষক। স্বামী কাজের সুবাদে ইউরোপে থাকেন, তাই সেখানে কেটেছে বেশ কিছু দিন। কবিতা লেখায় সিদ্ধহস্ত এবং নিজেকে বইপোকা বললে মন্দ হয় না। বেড়াতে আর সেই বেড়ানোর বৃত্তান্ত লিখতেও বেশ ভাল লাগে। |
|
|
|