দীপালিকায় জ্বালাও আলো... |
সুচেতনা সরকার
লন্ডন |
প্রতি বছর এই সময়টায় লন্ডনে ঘড়ির কাঁটা ঘুরে যায় এক ঘণ্টা পিছন দিকে। দিনের আলোকে যেন নিজের কব্জিতে বেঁধে নেয় পশ্চিমের মানুষ। পশলা খানেক করে বরফের ঝুরো মাঝে মধ্যেই ‘বয়ে’ যায় শহরের উপর দিয়ে। শীতের পোশাক— আলোয়ান, ওভারকোটে জবুথবু সে শহর। দিনের আলো এখন বড় ম্রিয়মান। এটাই বাঙালির আকাশপ্রদীপ জ্বালাবার সময়। সে আলোয় পূর্বপুরুষকে জানান দেওয়া— সাত সমুদ্দুর তেপান্তরের পারে জাগছি আমরাও। তাই সূর্য পাটে বসার সময় হলেই টেমসনগরী হৈ হৈ করে মেতে ওঠে আলোর উৎসবে। এক সঙ্গে কালীপুজো, দীপাবলি এবং গাই ফক্স বনফায়ার নাইটের চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা। লন্ডনের শহরতলির একটি জনপদ বার্কশায়ারের রেডিং। কিছু বাঙালি তরুণ তরুণী মিলে সেখানে ‘সংস্কৃতি’র যাত্রা শুরু করে মাত্র বছর পাঁচেক আগে। এই সংগঠনটির অনেকেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। তাই হয়তো বাৎসরিক উৎসব ‘সংস্কৃতি’র নামানুসারে নিজেদের নামকরণ করেছে! সত্যজিত্-সুনীল-সুমন ছেয়ে রয়েছে এদের বড় হওয়ার সময় জুড়ে। রয়েছে বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদাভোঁদা কিম্বা আনন্দমেলার টিনটিন বা গাবলুর সুখস্মৃতি। নিজেদের ছোটবেলাটা এরা শুধু বুকের ভিতর সযত্নে রাংতা দিয়ে মুড়ে লুকিয়ে রাখতে চায়নি, চেয়েছে তাদের স্কুলপড়ুয়া ছেলেপুলেদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে।
তাই সরস্বতীপুজো দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ধীরে ধীরে তা পূর্ণতা পেয়েছে বর্ষবরণ, মহালয়া ইত্যাদি নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে। এ বার সেখানে প্রথম কালীপুজোর আয়োজন। উৎসাহ তাই পরতে পরতে। ট্রাঙ্কওয়েল হাউস রেডিং শহরে ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত একটি বিশাল প্রাসাদে দীপাবলির রাতে শোনা যাবে বাঙালির হৃদ্স্পন্দন। রেডিং শহরতলির এই প্রথম কালীপুজো ফুলঝুরি ছড়াবে ‘নস্টালজিয়া’র। কুমোরটুলির গোরাচাঁদ পালের গর্ভমন্দির থেকে ‘শ্যামা’ মা এসেছেন এ বার। ক্রিসান্থিমাম, কার্নেশান আর লিলিফুলে ঢেকে গিয়েছেন জননী। লাল কার্নেশান পূরণ করে দিয়েছে জবার অভাবকে। কে বলে বিদেশের পুজোয় প্রাণ নেই? থাক না জবার বদলে কার্নেশান, কলাগাছের অভাবে ঝাউগাছ, শোলার ফুলের অভাবে টিনসেলের ক্রিসমাস ডেকরেশন। লাউড স্পিকারে পান্নালাল— বলরে জবা বল... এ গান তো শুধু গান নয়, একটা গোটা ছোটবেলা, একটা নস্টালজিয়া! আজ যে কুচোকাঁচারা ইলাস্টিকের ধুতি-শাড়ি পরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে এই গান তাদের ছেলেবেলার স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে। সেখানেই এই পুজোর সার্থকতা। নিজের শিকড়কে পরের প্রজন্মের মধ্যে থিতু করে দেওয়াই প্রবাসী মনের ইচ্ছে। হৈ হুল্লোড়, ধূপ-ধুনোর ধোঁয়া ভেদ করে কানে আসে উদাত্ত ভরাট গলায় পুরোহিতের স্বস্তিবাচন। এখানে আভিজাত্যে না হোক ইচ্ছেশক্তিতেই পূর্ণ হয়েছে মহাশক্তির আরাধনা। প্রাণের টান প্রতি ‘পলে’ অনুভব করে উপস্থিত প্রতিটি মানুষ!
ছেলে টানতে টানতে নিয়ে যায় বাইরের মাঠে, আকাশ জুড়ে জ্বলছে আলোর মালা। ধাতব আলোতে চোখ ঝলসায়। পুড়ছে ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম কিম্বা লিথিয়াম— সেই লাল-নীল-বেগুনি বৃত্তাকার আলোয় জমা পড়ে আমাদের ছোটবেলাটা। খাটের তলায় চুপিসাড়ে জ্বালানো সাপবাজির দেহত্যাগের সরু লম্বা ছাই সরালে যে সাদাকালো গোলাকার বৃত্তটুকু দেখা যায় অথবা সবুজ মেরুন ধানিপটকা কিম্বা আনাড়ি হাতে বানানো ছুঁচোবাজি! তাকে ঘিরেই কালীপুজোর সন্ধেবেলাটা রঙিন হয়ে ওঠে। ফুটতে থাকে নানা রকম তুবড়ি, রংমশাল, চরকি আলোয় আলোয় দিগ্বিদিক ঝলমল করে। তমসা নাশিনীর আবাহন তো সে জন্যেই! মনে আসে আর এক বাঙালি তরুণের কথা, তিনি এসেছিলেন এই রেডিং শহরেই। সেই ছিন্ন পায়ের চিহ্ন বাঙালির স্মৃতিতে প্রায় মুছে গিয়েছে। কিন্তু তিনি প্রাচ্য-দর্শনের হাজার রংমশাল জ্বালিয়ে ছিলেন ব্রিটিশ সমাজে। ১৮৯৫ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর, লন্ডনের ব্যস্ত সমস্ত প্যাডিংটন রেলস্টেশনে প্যারিস হয়ে আসছেন সেই যুবক— বিবেকানন্দ, অপেক্ষায় ছিলেন মি. স্টার্ডি। সঙ্গে তাঁকে নিয়ে চললেন রেডিং শহরতলীর ক্যাভার্শ্যামে। পাহাড়ের উপরে এই বাড়িটির নাম হাই ভিউ। এখানে নিরালা নির্জনে কেটেছিল বেশ কিছু সপ্তাহ। ইংল্যান্ডে বেদান্তের বীজবপন হয় এই সময়েই। টেমস দিয়ে গড়িয়ে গেছে তার পর অনেক জল। আজ আর রেডিং এর ক্যাভার্শ্যামে হাইভিউ বলে কোনও বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায় না। তবু শহর জেগে আছে— ইতিহাস বুকে নিয়ে।
|
|
রেডিং-এ জন্ম হয়েছে সফল বাঙালি সংগঠন ‘সংস্কৃতি’র। পুজোবাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখি লন্ডন শহর মেতেছে আলোর রোশনাইয়ে। গাই ফক্সের কুশপুতুল পোড়ানোর উৎসব এখন। প্রতি বছর এই উৎসব মিলে যায় দীপাবলি সময়েই। ৫০০ বছর আগে শুরু হয় এই বিপন্মুক্তির উৎসব। প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের রমরমা ছিল বৃটিশ রাজপরিবারে চির কালই, তাই বিপ্লবী ক্যাথলিক গাই ফক্স প্রতিজ্ঞা করেছিল পার্লামেন্ট উড়িয়ে দেওয়ার। তিলে তিলে জমেছিল বারুদের বস্তা। আগুন দেওয়ার আগের মুহূর্তে ধরা পড়ে সেই বিদ্রোহী ‘রাবণ’। দীপাবলি যেমন রামরাজত্বের সূচনা আর রাবণ ধ্বংসের ইঙ্গিত দেয়, ঠিক তেমনই পশ্চিমের ‘বনফায়ার নাইট’ও যেন গাইফক্সের মৃত্যু আর রাজা জেমসের শহরবাসীকে রক্ষা করার গল্প হয়ে থিতু হয়। এক পক্ষ কাল ধরে চলা এই উৎসবের উদযাপন হয় প্রায় দীপাবলির সময় নাগাদই। |
ছবি: লেখক |
|
|