প্রবাসে বাঙালির বারো মাসে বাইশ পাবন |
শ্রাবণী রায় আকিলা
হিউস্টন থেকে |
বাঙালির একান্ত আপন দুর্গাপুজো— দেশের মতো মার্কিন প্রবাসী বাঙালির বুকেও ঢাক বাজিয়ে প্রতি বছর হই হই করে আসে। সেই সময়টায় অফিস, স্কুল সব খোলা থাকে এখানে। তাই, পঞ্জিকা মতে সপ্তাহের মাঝখানে পুজো পড়লে বাধ্য হয়েই বাঙালিরা সে পুজোর আয়োজন করে কাছাকাছির সপ্তাহান্তে। দেশে হয়তো সপ্তাহের মাঝখানে পড়ল নবমী-দশমী, কিন্তু নিউজার্সি, আটলান্টা বা ডালাসে দশমীর সন্ধে কিন্তু তার ঠিক আগের বা পরের রবিবার। এ ব্যবস্থা সব শহরে প্রত্যেক বছর মোটামুটি একই। |
|
আমেরিকা জুড়ে হাজার হাজার বাঙালির গা-হাত-পা-কোমর টনটনে ব্যথা। হবে না? সেই শুরু হয়েছে পুজোর কত্ত আগে! পুজো কমিটির কোন্দল মেটানো থেকে পুজোর ওয়েবসাইট দেখভাল করা, হল বুক করা থেকে পুজো চলাকালীন ভিড়ের বহর দেখতে আসা ‘ফায়ার ডিপার্টমেন্ট’-এর হোমরাদের গোমড়া মুখ সামলানো, গিন্নীর অহরহ শাড়ি বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে সকাল-সন্ধে পাঞ্জাবি বদলে সঙ্গত দেওয়া। নাহ্, শরীর যেন আর বইছে না। এর মধ্যেই চলছে দেশে ফোন করার ধুম! পুজোর শুভেচ্ছা বা বিজয়ার প্রণাম এই রবিবার রাতের মধ্যেই খানিকটা সেরে না ফেললেই নয়!
প্রতি বছর পুজোর পর পশ্চিমবাংলায় বেশ একটা পুজো ছাড়ানো আলসেমো ভাব থাকে সকালগুলোর গায়ে। স্কুল-কলেজ কিছু দিনের জন্য হলেও ছুটি। অফিস এক দিন ‘হাফ ডে’ করে, এক দিন পরে গিয়ে আগে বেরিয়ে বা মাঝে এক দিন ছুটি নিয়ে— যা হোক করে লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত টেনে দেওয়া যায়। আর আমেরিকায় দ্যাখো! পেছনটা ঠেকাবার উপায় নেই। রাতেই দেশে ফোন করতে করতে ‘কর্তা’ অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে পুজোর সব ছবি, বিশেষ করে ‘গিন্নী’ যেখানে একটু বেশি আছেন, আপলোড করলেন। গিন্নী মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করতে করতে ঘাড় ব্যাঁকা করে কর্ডলেসে বান্ধবীর থেকে জেনে নিলেন তার বাড়ির লক্ষ্মীপুজোতে লাবড়াটা জনা চল্লিশের মাপে আনলেই হবে কি না! ছেলেরা চিকেন স্যান্ডউইচে কামড় দিতে দিতে কিচেন আইল্যান্ডের এক সাইডে রাখা ল্যাপটপে অনলাইনে দেখে নিল স্কুলের কোনও হোমওয়ার্ক ডিউ আছে কি না।
আমেরিকায় সোমবার ভোর মানে ‘দোর খোল’, সরি ‘গ্যারেজ খোল’। আগের রাতে মা দুর্গা এক বছরের জন্য ফেরত যান বা ওবামা বরাবরের জন্য, তাতে সোমবার সকালের মার্কিন-রোজনামচার কিচ্ছু এসে যায় না। সোমবার সকাল মানেই— ও সব গালগপ্পো রাখো, কাজের কথায় এসো! তাই রবিবার রাতে হাজার হাজার বাঙালির টনটনে ব্যথার মোক্ষম দাওয়াই— আমেরিকার প্রায় জাতীয় ওষুধ সন্মানপ্রাপ্ত, জ্বর থেকে মাথাব্যথা, বমি থেকে পেটব্যথা কমানোর আবালবৃদ্ধবনিতার সর্বজ্বরহর বটিকা— ‘টাইলনল’ খেয়ে মাথার পাশে সেলফোনে পাঁচটায় অ্যালার্ম দিয়ে শুতে গেলেন। |
|
আমেরিকার ভোর মুরগির ডাকে তো নয়ই, গরুর হাম্বাতেও হয় না। পাশের বাড়ির ডেরেক বা জেকবদের প্রায় বাঘ-ভাল্লুক বলে চোখে ভ্রম হওয়া কুকুরের ডাকে হয়। ঠিক সময়ে অ্যালার্ম আর প্রতিবেশীর পোষ্যের ডাকে খান খান হয়ে বাঙালির একাদশীর ভোর কানে-মাথায় ভোঁ ধরিয়ে শুরু হয়। রিমোটের চিচিং ফাঁকে খুলে গেল সব বাঙালির গ্যারেজের ‘অটোমেটিক ডাবল ডোর’। সব নন্টে ফন্টেদের স্কুলের হলুদ বাস ঠিক সময়ে বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিল। গিন্নী গেলেন গাড়ি নিয়ে ‘পার্ক অ্যান্ড রাইডে’ মেট্রো ধরতে। অফিসটা তারও মন্দ দূর নয়। মেট্রোয় যেতে যেতে গিন্নীর মনে হল লাবড়ার কাঁচকলাটা আবার বাড়ির সামনের সুপার মার্কেটে পাওয়া যায় না। অফিস ফেরত যেতে হবে সেই ১৫ মাইল দূরের চাইনিজ মার্কেটে। আজ বিকেলেই সব্জিগুলো কেটে ফ্রিজে তুলে রাখতে হবে। আদা বাটাটা অবশ্য মাসখানেকের জন্য ফ্রিজ করাই আছে। আর বিজয়া সম্মেলনীর জন্য রসগোল্লার ছানাটা বাড়ি এসে আগামিকাল করলেও হবে। পরশু দু’বার চড়ালেই গোটা পঞ্চাশ আরামসে হয়ে যাবে। এ মা যাহ্, গিন্নীর মনে পড়ল অক্টোবর শুরু হয়ে গিয়েছে, মাসের শেষেই হ্যালোউইন। গ্যারেজের উপর অ্যাটিক থেকে কুমড়োর মতো দেখতে কমলা আলোগুলো আর ফ্রন্ট ইয়ার্ডে গাছে ঝোলানোর জন্য লম্বা দাঁড়ানো ভূতটা কয়েক দিনের মধ্যেই হাত লাগিয়ে সাজিয়ে হ্যালোউইন পার্টির আগেই বাড়ির গায়ে হন্টেডহাউস মার্কা ভাবটা এনে ফেলতে হবে। আরও মনে হল, এ বারেও পাম্পকিন পাইটা গত বারের মতো খেতে ভাল হলে হয়। ভাবলে গিন্নীর মন খারাপ হয়। অমন বড় বড় ঢাউস ঢাউস কুমড়ো, তাদের নিয়ে হ্যালোউইনে এত্ত আদিখ্যেতা! তা কোথায় ঘি গরমমশলা ছোলা দিয়ে ছক্কা রেঁধে খাবে তা নয়, কি এক ‘পাই’ না ছাই। কী-ই বা জানে এরা রান্নার! আমাদের দ্যাখো, শরীরের জন্য খাওয়া ভাল বলে কেমন অ্যাসপ্যারাগাসকেও কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা দিয়ে বেশ মাখোমাখো তেলে ভেজে খাই। হোক না চাকরির পোস্টিং কুমেরুতে, কেমন পেঙ্গুইনের মাথা দিয়ে পুঁইশাক রেঁধে খাওয়াব দেখো!
সে যাকগে, যস্মিন দেশে যদাচার। গত কাল শাঁখাপলাটা খোলা হয়ে গিয়েছে। বিকেলের সিঁদুরখেলার পরে মা শীতলামার্কা মাথাটাও রাতের শ্যাম্পুর পরে পরিষ্কার। আবার ট্রাউজার, ব্লেজার, স্ট্রেটনার চালানো চুলে ‘পুনর্মুষিক ভব’ ভাবটা খুলেছে ভাল। সদা ব্যস্ত গিন্নী এর কিছু দিন পরেই বিজয়া সম্মেলনী আর লক্ষ্মীপুজোতে দারুণ একটা গৃহলক্ষ্মী গোছের ঝটিকা সাজে সবাইকে তাক লাগাবেন। স্বামী নারায়ণ মন্দিরের ফায়ারওয়ার্কস আর গর্বায় এক বার ঢুঁ মারবেন। কালীপুজোয় উষা উত্থুপের গান কি ছাড়া যায়? এ সব মিটতে না-মিটতেই চোঙ্গা কালো লম্বা টুপি, কমলা জামা বা নীল উইগে আমেরিকান পেত্নী-মার্কা ভাব এনে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ‘ট্রিক অর ট্রিট’-এ পাড়ায় বেরোবেন। বাঙালির বাঙালি ও আমেরিকান পরব চলছে ও চলবে।
পরের পরবগুলোর জন্যও এখন থেকেই ক্যালেন্ডারে ঢ্যাড়া পরে গিয়েছে, সব বুকড্। অফিসের জেনিফারের বেবি শাওয়ার, পাড়ায় অ্যালেক্সের জন্মদিন, ছেলের স্কুলের ইন্টারন্যাশনাল নাইটে ইন্ডিয়ান বুথের সামনে তাজমহলের ছবি সাঁটিয়ে দু’ এক পদ ভারতীয় খানা রেঁধে শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে ভলেনটিয়ারিং। উফ্ বাবা! এ সবের পরেও যদি থামত! নভেম্বরের শেষেই আবার হই হই করে আসছে ‘থ্যাঙ্কস গিভিং নাইট’। সেই কবে ব্রিটিশ পিলগ্রিমসরা নেটিভ আমেরিকানদের তাদের সাহায্যের জন্য ‘ধন্যবাদ’ জানাতে এক ডিনারের আয়োজন করেছিল। সেই ধারা বজায় রাখতে প্রতি বছর নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার গোটা আমেরিকা আত্মীয়-বন্ধুদের নিয়ে ডিনার টেবিলে বসবে— জীবনে কে কার কাছে কিসের জন্য কৃতজ্ঞ, তা গদগদ গলায় বলতে। তাতে বাঙালিত্ব ধরে রাখতে মরিয়া আর আমেরিকানত্ব বজায় রাখতে তটস্থ বাঙালি কর্তা-গিন্নীও বাদ নেই। বাঙালির লক্ষ্মীপুজোর খিচুড়ি, লাবড়া, পায়েসের মতো এই থ্যাঙ্কস গিভিং নাইটেরও একটা স্পেশাল মেনু আছে। কর্নব্রেড, ক্র্যানবেরি সস্ আর স্ম্যাশড পটেটো— যা কিনা আদতে মার্কিন আলুভাতে মাখা, যেখানে সরষের তেলের বদলে দুধ আর মাখন থাকে, এই যা! তবে সঙ্গে অবশ্যই টেবলের ঠিক মাঝখানে উপুড় করে রাখতে হবে এক পেল্লায় আস্ত রোস্টেড বা গ্রিলড টার্কি। মরে যাওয়ার পরেও সে টার্কির কী গাম্ভীর্য! দেশে থাকতে কেউ টার্কি খাননি, চোখে দেখেননি, এমনকী নাম পর্যন্ত শোনেননি। সেটা কোনও ব্যাপার নয়। আমেরিকায় এসে প্রথম বছরই বাঙালিরা শ্বেতাঙ্গদের সামনে এমন পারদর্শিতায় কাঁটা-চামচে গেঁথে দু’ঠোঁট বন্ধ করে মৃদু চাপে সে বিস্বাদ টার্কি খান দেখে মনে হয় আইসক্রিম খাচ্ছেন, ‘মুখে দিলে গলে যায় আহারে কী পুষ্টি’।
না! নটেশাক এখানেই মুড়োবে না। টার্কি হজম হতে না-হতেই আসবে ক্রিসমাস। বাড়ির সামনের কুমড়ো, আলো, ভিতরের ডিনার টেবিলের সব কমলা রঙের রানার, টেবিল ম্যাট নিমেষে উধাও হবে। অন্দরমহল এ বার সাজবে সোনালি, সবুজ আর লাল রঙে। ফায়ারপ্লেসের পাশে ঝকঝক করবে ক্রিসমাস ট্রি আর মাথায় বড় বড় স্টকিংস বা মোজা। বাড়ির সামনে ব্যাটারি চালিত সান্টা হেসে, গেয়ে, নেচে মন মাতাবে সব নন্টে ফন্টেদের।
ও দিকে মুখের উপর রোজ সকালে খবরের কাগজের সঙ্গে ঝপাঝপ এসে পড়বে দিস্তা দিস্তা বিজ্ঞাপনী ফ্লায়ার। সঙ্গে বার্তা— জীবনে যাহা কিছু নাই, তাহা আজই কিনিয়া ফেলুন বা যাহা কিছু আছে পুরাতন, তাহা ফেলিয়া দিন। কিন্তু খবরদার কোনও ফ্লায়ার ভুলেও ফেলিবেন না, পাইলেও পাইতে পারেন অমূল্য রতন, চূড়ান্ত সেলে। কর্তা সেলফোনের মডেল বদলাবেন, বাড়ির কোনও আনাচকানাচ বাকি থাকলে সেখানে বসাবেন আর একটি এলইডি টিভি। গিন্নী উইন্টার ফ্যাশনের সম্ভার বাড়াবেন। নন্টে ফন্টে নতুন ভিডিও গেমস ‘এক্স বক্স থ্রি সিক্সটি’র জন্য বায়না ধরবে। মাঝে শহরে যদি বরফ পড়ে তা হলে সেই বরফে পাড়ার মার্কিনি শ্বেতাঙ্গরা যখন স্কেটিং-স্কিয়িং বা আরও সব উইন্টার গেমসে মেতে উঠবে, তখন ও সবে সময় নষ্ট না করে কর্তা ছেলেদের ছুটির সকালে বেশি করে অঙ্ক করাবেন। গিন্নী শীতের সকালে গোল গোল কড়াইশুঁটির কচুরি ভেজে তুলবেন আর ফোনে দেশে থাকা মায়ের কাছ থেকে আরও এক বার ঝালিয়ে নেবেন পাটিসাপটার রেসিপি— আসন্ন পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে। এ সব করতে করতেই ৩১ ডিসেম্বর মধ্য রাতের পার্টিতে নতুন বছর এসে পড়বে— শ্যাম্পেন খুলে ‘উ লা লা’ গানের মাদকতায় হাস্যে লাস্যে কর্তা গিন্নীর যুগল নাচের দুষ্টুমিতে।
আমেরিকার বাঙালি কর্তা-গিন্নী এ ভাবেই ডুবে থাকবে, মেতে থাকবে আমেরিকান ড্রিমে আর আচ্ছন্ন থাকবে বাঙালি নস্ট্যালজিয়ায়— সরস্বতী পুজোর হলুদ সকালে, বৈশাখের পয়লায় বা পঁচিশেও। নতুন বাড়ির গৃহপ্রবেশের সকালে সত্যনারায়ণ পুজো সামলে ইস্টারের বিকেলে ছোট ছেলের হাত ধরে বানি বাস্কেট নিয়ে গিন্নী দৌড়বেন পাড়ার বা চার্চের খেলার মাঠে লুকিয়ে রাখা প্লাস্টিকের ডিম কুড়োতে। যার পেটে ভরা থাকবে ছোট ছোট ক্যান্ডি আর গুডি গিফটস। উপচে পড়া বাস্কেট আর উছলে পড়া খুশিতে ছেলে মাকে দু’হাতে জড়িয়ে অভ্যাসবশত বলবে, ‘আই লাভ ইউ মা’, গিন্নী তার কপালে চুমু এঁকে বলবেন, ‘আই লাভ ইউ টু সোনা’! |
ছবি: লেখক |
|
|