১৫ কার্তিক ১৪১৯ বৃহস্পতিবার ১ নভেম্বর ২০১২
পুজো ও পার্বণ...
‘আমার বিজয়ার প্রণাম নিও মা’
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়েছি আজ। একে বিজয়ার মরসুম, তার উপর ওয়াশিংটন ডিসি-র সংস্কৃতির পুজো আজ আর কাল। তা ছাড়াও আবার একটা লম্বা উইকএন্ড। এখনই দেশে ফোন পর্ব শুরু হবে সকাল থেকে।

মেরিল্যান্ডে এ বার পূর্বাচলের পুজো হয়েছে পঞ্চমীতে। যদিও প্রতি বছরের মতো এ বছরও পুজোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে বেশ কিছু দিন আগে থেকে। পুজো কমিটি প্রথমে ই-মেলে, তার পর ফোনে জানিয়ে দেন কার কী দায়িত্ব। কেউ প্রতিমা সাজানোর দায়িত্ব পেলেন, কেউ বা আবার পুজোর জোগাড়যন্ত্র করার। তবে, রান্নার গুরু দায়িত্ব কিন্তু সবাইয়ের। লুচি, আলুর দম, খিচুড়ি, লাবড়া, পায়েস থেকে শুরু করে রাতে পাঁঠার মাংস— সব কিছু ঘরোয়া ভাবে রান্না করেন পূর্বাচলের সকল সদস্য। আমার ভাগে এ বার পড়েছিল খিচুড়ি রান্নার ভার। রান্না করার পর অ্যালুমিনিয়ামের ট্রেতে ঢেলে ঠান্ডা করে উঠলাম যখন, তখন রাত প্রায় ভোর। মা-কে ফোন করে জানালাম ‘কার্যসিদ্ধি’ হয়েছে।

আমি কিছু বছর দেশ ছাড়া— প্রথমে উচ্চশিক্ষার জন্য, আর এখন সংসার ও চাকরির কারণে। মা, বাবা, ভাই ও সমস্ত পরিবার পরিজন দেশে। মা-বাবার সঙ্গে ফোনে আর ভাইয়ের সঙ্গে ইন্টারনেটে রোজকার যোগাযোগ। মায়ের সঙ্গে কথা হয় প্রায় রোজই। সে কথাবার্তায় পড়াশোনা, সংসার-পাতার টুকিটাকি, রান্নাবান্না, নতুন বইয়ের সন্ধান, এমনকী চলতি বাংলা ধারাবাহিক— বাদ যায় না কিছুই। বাবার সঙ্গেও গল্পের বিষয় বিস্তারিত, যদিও রাজনীতি, চাকরি আর স্বাস্থ্যই তার মধ্যে প্রাধান্য পায় বেশি।

পুজোর দিনগুলিতে ফোনের এই কথাবার্তা অন্য একটা মাত্রা পায়। দু’তরফেরই নানা ছোটখাটো কথায় দূরে থাকার মনোকষ্ট বারবার সামনে এসে পড়ে। আমার বারবার মনে হয় পাড়ার পুজোর কথা, মা-বাবার কথা, দেশের অন্য প্রান্তে থাকা ভাইয়ের কথা।
পুজোর দিন বেশ সকাল সকাল পৌঁছলাম মণ্ডপে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আর কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে মানুষজন আসতে শুরু করেছেন। মল্লিকাদি ও শুভ্রাদি ফল কাটছেন। পঞ্চাননদা ঘট সাজাচ্ছেন আর পার্থদা রেকাবি থেকে তাজা ফল রাখছেন প্রতিমার পায়ে। হঠাত্ই মনে পড়ে গেল আমাদের বাড়ির পাঁচিলের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা শিউলি গাছটার কথা। সারা বছর একটু একটু ফুল ফুটলেও, পুজোর সময় রোজ সকালে একটা সাদা গালিচা তৈরি হত গাছটার নীচে। উঠোনের স্থলপদ্মের গাছটা নুয়ে পড়ত ফুলের চাপে। ছোটবেলায় দু’রকমের ফুল নিয়েই পাড়ার মণ্ডপে যেতাম। পুষ্পাঞ্জলি দিতে আসা মানুষের ভিড়ে, দেবীর পায়ে পৌঁছনোর আগে মাঝে মাঝেই সে ফুল হাপিস হয়ে যেত। আবার কখনও অঞ্জলির ফুল পাইনি দেখে ঠাকুর মশাই একটু ফুল এগিয়ে দিতেন। যেমন সে দিন পূর্বাচলে দিলেন পঞ্চাননদা। গবেষণার কাজে ১৯৮৮ সালে এ দেশে আসেন তিনি। তার কিছু বছর পর, এক শীত কালে যখন চারপাশ বরফে ঢাকা, হঠাত্ই কয়েক জন বাঙালি মিলে ঠিক করলেন সরস্বতীর পুজো করবেন। সেই শুরু। তার কয়েক বছর পর ‘পাবলিক ডিমান্ড’-এ শুরু হয় দুর্গাপুজো। কুমোরটুলি থেকে ‘লাগেজ’ হিসেবে প্রতিমা নিয়ে আসেন মল্লিকাদি, ঈশ্বরদা ও তাঁদের পরিবারের অন্যান্যরা। পুজোর যাঁরা প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই চলে গিয়েছেন অন্যত্র, আবার অনেক নতুন মানুষ যোগ দিয়েছেন। তবুও সব কিছু থাকা সত্ত্বেও সেই ফেলে আসা মামারবাড়ির দুর্গাপুজোর কথা মনে পড়ে পুজোর সময়।

ওয়াশিংটন ডিসি-র কালীবাড়ির দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয় তিথি মেনে। অষ্টমীর সন্ধ্যায় মন্দিরে পৌঁছলাম আরতির একটু আগে। মন্দিরের সঙ্গে দীর্ঘ দিন যুক্ত দেবদাসবাবু জানালেন প্রায় ৪০০ মানুষের সমাগম হয়েছিল সকালের পুজোয়। অনেকেই এসেছিলেন আশেপাশের স্টেটগুলি থেকে, বেশ কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে। সন্ধ্যা আরতি শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের ঢল নামল মন্দিরে। ঢাক, কাঁসর, ঘণ্টা, ধূপ-ধুনো দিয়ে পুজো শুরু হল। বেদীর উপর ঠাকুরমশাই আরতি করছেন, আর নীচে দাঁড়িয়ে অগুনতি মানুষ হাত জোড় করে প্রার্থনা করছেন মা দুর্গার কাছে।

ছোটরা দৌড়ে বেড়াচ্ছে আর বাবাদের ‘দল’ নাজেহাল হচ্ছেন তাদের সামলাতে। বছরের এই ক’দিন মায়েরা নতুন শাড়িতে একটু ঝাড়া হাত-পা থাকতে চান। মণ্ডপের দু’পাশে দেওয়াল ঘেঁষে সারি দিয়ে রাখা চেয়ারে বসে গল্প করছেন অনেকে। হাঁটুর ব্যাথা, শাড়িতে ভাজ পড়ে যাবে, পেছন দিকে বসলে তাড়াতাড়ি উঠে বেরিয়ে যাওয়া যাবে, ঠাকুর দেখার এটাই ‘বেস্ট অ্যাঙ্গল’— এ রকম আরও নানা কারণ ভেসে আসছিল চেয়ার দখলের। এক মা গল্প করছিলেন তাঁর ছেলেকে নিয়ে। সুদূর ওয়েস্ট কোস্টের বার্কলেতে পড়তে গিয়েছে তাঁর ছেলে, তাই মা একাই এসেছেন। তাঁর সঙ্গে গল্প করছিলেন আর এক ‘নিউ মম’। বললেন দু’বছরের ছেলেকে ‘হ্যান্ড ওভার’ করেছেন বাবার কাছে, সারা সন্ধের মতো।

একটু দূরেই এক ভদ্রলোক আপশোস করে বললেন পুজোর আনন্দে তিনি ১৪ পাউন্ড মাছ কিনে ফেলেছেন। সেগুলি ফ্রিজে রাখতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল বাবার মাছ কেনার উত্সাহ। শুধু পুজোর সময়েই নয়, প্রতি রবিবার মাছের বাজারে গিয়েই উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন তিনি।
এ দেশে পুজোর সময় বাড়ির কথা, দেশের কথা কম-বেশি সবারই মনে পড়ে নানা ভাবে। শেলী প্রায় চার বছর বাদে এ বার দেশে ফিরছে বর মেয়েকে নিয়ে। দেখা হতেই একগাল হেসে বলল, ‘‘টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছে।’’ তার পরই পরনের বিস্কিট রঙের লাল পাড় বেনারসির দিকে হাত দেখিয়ে বলল ‘‘এটা মা-র, আজ এটাই পড়লাম।’’ একটা মেরুন পাঞ্জাবি আর ঘিয়ে পায়জামা পরা ৩-৪ বছরের ছেলে এত ভিড়ের মধ্যে একটা লাল রঙের গাড়ি নিয়ে খেলছিল মাটিতে বসে। হাজার চিত্কারে, ঘণ্টার আওয়াজে তার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। মুখ দিয়ে ভুররররর... আওয়াজ করে এক মনে গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছে সে। অনেক বছর আগে, এই বয়সের আর এক জন ছেলেকে সারা দিন গাড়ি চালিয়ে বেড়াতে দেখেছি বাড়িময়। রেসিং কার, সেডান, টেম্পো— আরও অনেক ধরনের গাড়ি ছিল আমার ভাইয়ের সংগ্রহে। আজ অবশ্য হাবেভাবে ও বিশেষ করে উচ্চতায় আমিই ছোট বোন হয়ে গিয়েছি তার কাছে। তবুও ছোটবেলার এ রকম টুকরো স্মৃতি আজও মনে তরতাজা।

শুভ্রাদি বললেন, দেশে দিদিকে ফোনে পুজো দিনের শাড়ি, গয়নার গল্প আজও করতে ভোলেন না তিনি। ছোটবেলায় এগারো জন জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো বোনের সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে মাপ নিয়ে জামা বানানো হত পুজোর সময়।

এখানকার পুজো খুবই ভাল লাগে, তবে মন খারাপ করাটা রয়েই গেছে। অনেকেরই মা-বাবা পুজোর সময় ছেলেমেয়েদের কাছে বেড়াতে আসেন। তাদের দেখে এক দিকে যেমন খুব ভাল লাগে, অন্য দিকে আবার নিজের মা-বাবার জন্য মন খারাপ করে। এ বার পুজোয় গৌতমের মা এসেছেন মুর্শিদাবাদের কান্দি থেকে। নতুন দেশ কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করাতে হেসে বললেন, ‘‘বেশ ভাল।’’ তবে তাঁর কুড়ি মাসের নাতি মাথার উপর হাত তুলে ‘জয় নিতাই’ বলতে শিখেছে— সেটাই আসল আকর্ষণ। সঞ্জয়দার মা এ দেশে এসেছেন বেশ কয়েক বার। এ বার পুজোয় আবার দেখা হল, শেরওয়ানি পরা তিন বছরের নাতির সঙ্গে।

গ্রেটার ওয়াশিংটন অঞ্চলের আরও দু’টি খুব পুরনো পুজো সংস্কৃতি ও প্রান্তিক। বহু বাঙালির পুজোর দিনে দেশের বাইরে ঢাকের বাদ্য, দেবীদর্শন থেকে ভোগ খাওয়ার সুযোগ করে এই দুই পুজো কমিটি। সংস্কৃতিতে কোমর বেঁধে, আস্তিন গুটিয়ে কাজে নামে বোলপুরের ছেলে দেবব্রত। তবে দেশের দুর্গাপুজোর জন্য মন খারাপ করে না তার। বরং পৌষমেলা বা দোলে বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করে। কখনও দেশে পুজোতে এ ভাবে কাজ করার সুযোগ পায়নি যা এখানে পায়, বলল দেবু। অনেক দূর থেকে মানুষ এই সব পুজোতে আসেন, যেমন এসেছে কলকাতার মেয়ে মেঘরঞ্জি। মিলওকি থেকে বল্টিমোর এসে, সংস্কৃতিতে প্রতিমা দর্শন করতে এসেছে সে। আরও একটা কারণ মেঘার বর গবেষণা করে বল্টিমোরে। তাই তাকে নিয়েই পুজোয় পৌঁছল মেঘা।
অষ্টমীর দিন সকালবেলা ফোন করতেই বাবা ধরে বললেন, সকাল বেলাতেই প্রতিমা দর্শন করে এসেছেন তিনি। কথা বলতে বলতেই টিভিতে এক বাবা-মেয়ের শ্রুতি নাটক শুরু হল। বাবা টিভির ভল্যুম বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটা শোন। আর একটু পরই বললেন, যে সমস্ত মা-বাবাদের ছেলে মেয়েরা পুজোর সময় ঘরে ফেরে না, তাদের সবার এমনই মনে হয়— কিসেরই বা পুজো, আর কিসেরই বা দেবীর পায়ে ফুল নিবেদন!

এই বিশ্বায়নের যুগে মানুষ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য পারে চলে যায় অনায়াসে। মার্সাল ম্যাকলুহান-এর ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। আমরা সবাই এমন এক বৃহত্তর বিশ্বের নাগরিক। আমরা কেউ সঠিক ভাবে জানি না, আগামী দিনে জীবনের ধারা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে। নিজেদের ভিটেমাটির সঙ্গে ভৌগলিক দূরত্ব যত বেড়েছে, উন্নত যোগাযোগের মাধ্যমকে করেছে সর্ব কালের সেরা। ওয়াশিংটন ডিসি-তে অনুষ্ঠিত এক স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনের আলোচনায় সদস্যরা ব্রাজিলিয়া, নাইরোবি, ভিয়েনা অথবা দিল্লি থেকে যোগ দিতে পারেন ‘রিয়েল টাইম’-এ। এমনকী মেরিল্যান্ডে বোনপো’র মুখেভাতে কলকাতায় বসে মাসি শাঁখ বাজিয়ে দিতে পারেন স্কাইপের মাধ্যমে। তবুও কিছু কিছু সময়ে মনে হয় সব ফেলে দেশে ফিরে যাই। ইচ্ছে করে মহালয়ার ভোরে সাদা জামা পরে বাবার সঙ্গে বাজার থেকে গরম জিলিপি কিনে আনতে। আর ইচ্ছে করে বিজয়ায় মা-বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি!
ছবি: লেখক
পুজোর বিশেষ কিছু লেখনী
পরিবর্তনের পুজো ওড়িশায়!
প্রবাসে বাঙালির বারো মাসে বাইশ পাবন
দীপালিকায় জ্বালাও আলো
রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি চিঠি পুরনো সংস্করণ