১৬ আষাঢ় ১৪১৮ শুক্রবার ১ জুলাই ২০১১
আপনার কলমে...


হাওয়াই-এ হাওয়া বদল
ছেলেবেলায় পাশের বাড়িতে ‘কলের গানে’ বাজত ‘হাওয়াই দ্বীপে আজি ফুল ফুটেছে...’। তখন জানতামই না কোথায় হাওয়াই দ্বীপ ! কিন্তু মনের কোণে লুকিয়ে ছিল কাল্পনিক একটা জায়গা, যার চার দিক জলে ঘেরা আর সেখানে অনেক ফুল। মার্কিন মুলুকে আসার পর হাওয়াইয়ে যাওয়া আর ততটা কঠিন মনে হল না। তাই সময় সুযোগ বুঝে গত এপ্রিলের শুরুতেই বেরিয়ে পড়লাম, ভার্জিনিয়া থেকে শিকাগো হয়ে।
প্রথম দিন
শিকাগো থেকে প্রায় আট ঘন্টার উড়ান শেষে নামলাম হনলুলুতে। বিমানবন্দরের লাউঞ্জে পা রাখতেই অভ্যর্থনা, ‘আলোহা’, মানে স্বাগতম। হোটেল থেকে আমাদের নিতে এসেছেন, তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন ফুলের মালা নিয়ে, পরিচয় হওয়ার পরই পরিয়ে দিলেন গলায়। ‘আলোহা’ ছাড়া আর একটি শব্দ শুনতে পেলাম, ‘মাহালো’। মানে? ধন্যবাদ। হাওয়াইয়ের মানুষেরা নিজেদের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন নানা ভাবে, তার মধ্যে একটি, এই প্রদেশকে সরকারি ভাবে দ্বিভাষী ঘোষণা করা— ইংরেজি এবং হাওয়াইয়ান। আদি হাওয়াইয়ান ভাষা ছিল শুধু কথ্য, কোনও লিখিত অক্ষরমালা ছিল না। বর্তমানে হাওয়াইয়ান ভাষা লিখতে এঁরা ইংরেজি অক্ষরমালা ব্যবহার করেন। হাওয়াইয়ান ভাষাতে আছে মোট বারোটি অক্ষর— পাঁচটি স্বরবর্ণ (a, e, i, o, u) আর মাত্র সাতটি ব্যঞ্জনবর্ণ (h, k, l, m, n, p, w)। প্রতিটি অক্ষর আলাদা করে উচ্চারিত হয়, যথা hawaii শব্দের শেষে পরপর দু’টি i আছে বলে এঁদের ভাষায় নিজেদের প্রদেশের আসল নাম হল হাওয়াই-ই।
ওয়াইকিকি সৈকতে সূর্যাস্ত
বিমানবন্দরে শুল্ক আধিকারিক জিজ্ঞেস করলেন, আমরা সঙ্গে কোনও গাছপালা বা বীজ এনেছি কি না (যা আনা নিষিদ্ধ)। কারণ, বাইরে থেকে এই সব জিনিস এখানে আনলে তা স্থানীয় পরিবেশকে বিপন্ন করতে পারে। আমরা তেমন কিছু আনিনি শুনে তিনি বললেন, ‘মাহালো’।

বিমানবন্দরের বাইরে বেরোতেই গায়ে লাগল সুন্দর হাওয়া। দেখতে পেলাম দূরে সবুজ পাহাড়। আমাদের হোটেল ওয়াইকিকি এলাকায়। হোটেলে পৌঁছে কিছু ক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেরোলাম পৃথিবী বিখ্যাত ওয়াইকিকি সৈকত দেখতে। সৈকতের পাশ দিয়ে অভিজাত কালাকাউয়া অ্যাভেনিউ ও আলা মৌনা বুলেভার্ড। তার উপর সারি সারি নামী দামি হোটেল এবং বিখ্যাত আন্তর্জাতিক দোকান সমূহ। ওয়াইকিকি সৈকতের বালি একদম সাদা, যা আনা হয়েছে অন্য জায়গা থেকে। লম্বা এই সৈকতের ধারে সার দিয়ে সাজানো ফুল গাছ আর তার নিচ দিয়ে বসবার বেঞ্চ। সমুদ্রের ধার বলে নারকেল গাছও আছে। বিকেল হয়ে আসছে। সূর্যাস্ত দেখতে ভিড় করেছে পর্যটকের দল। নবীন থেকে প্রবীণ সব বয়সীদেরই দেখা মেলে। তা ছাড়া বিভিন্ন বয়সের প্রেমিক-প্রেমিকারা ও হাত ধরে হাঁটছেন সমুদ্রতটে। সেখানে ডাবের জল পাওয়া যাচ্ছে। মনে হল ভেলপুরি, ফুচকা থাকলে দারুণ জমত। অপরূপ সূর্যাস্ত দেখে ফেরার পথে দেখলাম জায়গায় জায়গায় নিচু মঞ্চ বেঁধে, মশালের আলোয় হাওয়াইয়ান নাচ-গান হচ্ছে এবং পর্যটকরা নিখরচায় দেখেশুনে যোগও দিচ্ছেন তাদের সঙ্গে।

হাওয়াইয়ান সঙ্গীত খুবই সুরেলা এবং মন্দতালে শুরু হয়ে দ্রুততালে শেষ হয়। অনেক ক্ষণ সেই সব সুর-তালে বিভোর হয়ে এক সময় হোটেলে ফিরলাম।



দ্বিতীয় দিন
সকালে, পার্ল হারবার। বিরাট লম্বা লাইনের শেষে ঢুকে পড়লাম এক প্রেক্ষাগৃহে। সেখানে দেখলাম পার্ল হারবারের ইতিহাসের তথ্যচিত্র। ৭ ডিসেম্বর ১৯৪১ সকাল আটটা নাগাদ অতর্কিতে প্রায় দুশো জাপানি যুদ্ধবিমান পার্ল হারবারের উপর বোমা বর্ষণ করে। মার্কিন নৌবাহিনীর প্রভূত ক্ষতি হয়। এর মধ্যে একটি যুদ্ধজাহাজ, ‘ইউ এস এস অ্যারিজোনা’ এক হাজারেরও বেশি সেনা-সহ সেখানেই জলে ডুবে যায়। প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে ঢুকলাম স্মারক ভবনে, যা নির্মিত হয়েছে সেই ডুবে যাওয়া জাহাজের উপরেই। এই মেমোরিয়ালের দেওয়ালে লেখা আছে সেই সব নৌ-সেনাদের নাম। ডুবে যাওয়া জাহাজের উপরিভাগ জলের মাত্র কয়েক ফুট নীচে, সেই জন্য তার অনেক অংশ দেখতেও পাওয়া যায়। আজও ওই জাহাজ থেকে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে তেলের ফোঁটা, যা ছড়িয়ে যায় জলের উপর রামধনুর রঙে। এই স্মারককে মার্কিনরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেন এবং এর ভিতরে গির্জার মতো ভব্যতাও পালন করা হয়।

জাপানের এই আক্রমণের পরই আমেরিকা সরাসরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেমে পড়ে, যার করুণ পরিণতি হিরোশিমা ও নাগাসাকির উপর আণবিক বোমা প্রয়োগ। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫, এই পার্ল হারবারেই আর একটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ‘ইউ এস এস মিসৌরি’র ডেকে জাপান সরকার মার্কিন জেনারেল ম্যাকার্থারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। অ্যারিজোনা মেমোরিয়ালের কাছেই আছে ‘ইউ এস এস বোফিন’ নামক ডুবোজাহাজের মিউজিয়াম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মোট চুয়াল্লিশটি জাহাজ ধ্বংস করে বোফিন। সে জন্য এর আর এক নাম ‘পার্ল হারবারের প্রতিশোধ’। এই মিউজিয়ামের বাইরে রাখা আছে মার্কিন নৌবাহিনী ব্যবহৃত বিবিধ রকেট। এখনও পার্ল হারবার মার্কিন নৌবহরের একটি প্রধান কেন্দ্র।

হাওয়াই সম্বন্ধে দু-চার কথা

অ্যারিজোনা মেমোরিয়াল দেখার পর ট্যুর বাসে ওয়াহু দ্বীপ পরিক্রমা। গাইড বলতে লাগলেন হাওয়াইয়ের ইতিহাস, ভূগোল। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে আছে অনেকগুলি দ্বীপ, তার মধ্যে প্রধান হল হাওয়াই— যা ‘বিগ আইল্যান্ড’ বলে সমধিক পরিচিত— মাউই, ওয়াহু, কাউয়াই। এ ছাড়া আছে লানাই, মলোকাই, নি-ইহাউ ইত্যাদি আরও অনেক ছোট ছোট দ্বীপ। হাওয়াই প্রদেশের রাজধানী হনলুলু একটি আধুনিক শহর, যা ওয়াহু দ্বীপে অবস্থিত। এই শহরেই জন্ম বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার। হাওয়াই আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত ৫০-তম প্রদেশ। সব দ্বীপগুলি মিলিয়ে জনসংখ্যা ১২ লক্ষের কিছু বেশি। বাসিন্দাদের মধ্যে বিবিধ জনজাতির লোক ও তাদের মিশ্রণ দেখা যায়, যথা জাপানি, পলিনেশীয়, চৈনিক, কোরীয়, ফিলিপিনীয় প্রভৃতি।

রাজা প্রথম কামেহামেহা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে সমস্ত হাওয়াই দ্বীপগুলির উপর আধিপত্য স্থাপন করেন। সেই রাজত্ব চলে প্রায় একশো বছর। ১৮৯৩ সালে এখানকার মার্কিন ব্যবসায়ীরা আমেরিকা সরকারের সাহায্যে এই রাজবংশের শেষ রানি লিলি উওকালানিকে রাজ্যচ্যুত করে এবং একটি তাঁবেদার সরকার গঠন করে। ১৯৫৯ সালে হাওয়াইকে সরকারি ভাবে আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে ১৯৯৩ সালে বিল ক্লিন্টন সরকার রানি লিলি উওকালানিকে ১০০ বছর আগে রাজ্যচ্যুত করার জন্য মার্কিন কংগ্রেসে ‘ক্ষমা প্রস্তাব’ পাশ করেন।

হাওয়াইয়ের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি পর্যটন। প্রতি বছর প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ পর্যটক আসেন এখানে বেড়াতে। তার মধ্যে প্রায় ৩৫ লাখই আসেন ওয়াহুতে। তার পরেই রয়েছে মাউই। বেড়াবার পক্ষে হাওয়াইয়ের আবহাওয়া সারা বছরই দারুণ সুন্দর। বছরের বেশিরভাগ সময়েই দুপুরের তাপমাত্রা থাকে ৭৫ থেকে ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট অর্থাত্ ২৩ থেকে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানে সারা দিন চলে সমুদ্রের বাতাস, তাই গরম ততটা বোঝা যায় না। তবে দূষণের মাত্রা কম বলে সূর্যালোক খুব জোরাল, তাই ‘সানস্ক্রিন’ লাগিয়ে বেরোনো উচিত।
ডোল প্ল্যান্টেশান ডোল প্ল্যান্টেশানের ভুলভুলাইয়া*
পার্ল হারবারের পরে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ‘ডোল’ কোম্পানির আনারসের বাগান। হাওয়াইয়ের জলবায়ু এবং মাটি আনারস চাষের পক্ষে খুবই উপযুক্ত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে জেমস ডোল, হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি ও ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি নিয়ে এখানে জমি কিনে শুরু করেন আনারস চাষ। তাঁকে বলা হত ‘পাইনঅ্যাপল কিং’। তাঁর নামেই এখানকার ডোল প্ল্যান্টেশান। পরে তিনি লানাই নামে একটা পুরো দ্বীপ কিনে সেখানে ব্যাপক ভাবে আনারসের চাষ করতে লাগলেন। কালক্রমে তা হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আনারসের ব্যবসা যা ‘ডোল ফুড কোম্পানি’ নামে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন দেশে।

ওয়াহু দ্বীপের এই ডোল প্ল্যান্টেশান একটা বড় ট্যুরিস্ট আকর্ষণ। এই আনারসের বাগান এত বড় যে তা ঘুরে দেখানোর জন্যে একটা ছোট ট্রেন আছে। নাম তার ‘পাইনঅ্যাপল এক্সপ্রেস’। আনারস যে কত রকমের হয়, তা এখানে না এলে জানতেই পারতাম না। বাগানের মাঝে আছে গাছ দিয়ে তৈরি ভুলভুলাইয়া। আনারসের তৈরি নানা রকমের খাবার বিক্রি হয় এখানে, যেমন আইসক্রিম, শরবত, জুস, আপসাইড-ডাউন কেক ইত্যাদি।
হাওয়াই ফুলের দ্বীপ। এই প্রদেশের জাতীয় ফুল হলুদ জবা যা এখানে প্রচুর পরিমাণে ফোটে। আরও বিভিন্ন রঙের জবা দেখলাম জায়গায় জায়গায়। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুল হল গুলঞ্চ, ভারতেও এই ফুল দেখতে পাওয়া যায়। এর ইংরেজি নাম প্লুমেরিয়া, হালকা হলুদ থেকে গাঢ় গোলাপি, নানা রঙের হয়। কানের পাশে ফুল গোঁজা হাওয়াইয়ীয় মহিলাদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় এবং সে কাজে গুলঞ্চ ফুলের ব্যবহারই বেশি। অবিবাহিতরা ফুল লাগান ডান কানের উপর এবং বিবাহিতরা বাঁ কানের উপর। তবে বর্তমানে অনেক বিবাহিতরাও কানে ফুল লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান। জলবায়ুর জন্য এখানে প্রচুর পরিমাণে নানা ধরনের ফুল ফোটে সারা বছরই। ফলও উৎপন্ন হয় প্রচুর। আনারস ছাড়াও কমলা লেবু, পেঁপে, আভোকাডো এবং ‘ম্যাকাডেমিয়া’ নামের এক ধরনের বাদাম।

তৃতীয় দিন
পলিনেশীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র*
ওয়াহু দ্বীপের উত্তর ভাগে অবস্থিত পলিনেশীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে টিকিট কেটে ঢুকতেই আমাদের গলায় পরানো হল ফুলের মালা, যেটা এ দেশে অতিথি অভ্যর্থনা করবার বিশেষ এক প্রথা। পলিনেশিয়া বলতে প্রশান্ত মহাসাগরের একটা বিশাল এলাকাকে বোঝায় যা নিউজিল্যান্ড থেকে শুরু করে সামোয়া, তাহিতি, টঙ্গা, হাওয়াই প্রভৃতি দ্বীপগুলিকে নিয়েই। ভৌগলিক দূরত্ব সত্বেও এদের অধিবাসীদের সামুদ্রিক দক্ষতার জন্য গত এক হাজার বছর ধরে এই দ্বীপগুলির মধ্যে নৌ যাতায়াত চালু ছিল। তার ফলে এদের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান প্রদান ও জাতিগত মিশ্রণ হয়েছে। সাতটি আলাদা পলিনেশীয় (যার মধ্যে আছে মাউরি, টঙ্গা, তাহিতিয়ান, সামোয়ান প্রভৃতি) জনগোষ্ঠীর এক একটি গ্রাম বানিয়ে তাদের জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতি পাশাপাশি দেখানো হয় এই কেন্দ্রে। প্রতিটি গোষ্ঠীর আলাদা পোশাক পরে যাঁরা অনুষ্ঠানগুলি করেন, তাঁরা বেশির ভাগই এখানকার ‘বি ওয়াই ইউ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। মেয়েদের কোমরে ঘাসের স্কার্ট, গলায় ফুলের মালা, কানে গুলঞ্চ ফুল এবং ঊর্ধাঙ্গে দু’টি নারকেল মালার বক্ষবন্ধনী।
পুরুষেরা বিবিধ যোদ্ধার সাজে ঢাল, তরোয়াল, আগুন ইত্যাদি নিয়ে যে সমস্ত খেলা দেখান সেগুলি খুবই আকর্ষক। এত তাড়াতাড়ি মানুষ যে নারকেল গাছে চড়তে পারে তা না-দেখলে বিশ্বাস করতাম না কখনও। এই কেন্দ্রের ভিতরে একটি আই ম্যাক্স থিয়েটার আছে যেখানে ‘দ্য লিভিং সি’ নামে একটি দারুণ ফিল্ম দেখলাম, সমুদ্র সম্বন্ধে। নেপথ্য কন্ঠ দিয়েছেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ। এখানে একটি বড় জলাশয় আছে, যেখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর তৈরি প্রাচীন নৌকা প্রদর্শন করা হয়। সেগুলোতে চড়াও যায়। সর্বত্র প্রচুর ফুলের সমারোহ, সবুজ বাগান আর অঢেল খাবারের ব্যবস্থা, যার মধ্যে আছে প্রচুর আনারস। হাওয়াইয়ের সঙ্গে আনারসের সম্পর্ক যেন বাঙালির সঙ্গে রসগোল্লার!

সব কিছু ভাল ভাবে দেখতে হলে কমপক্ষে একটা দিন পুরো লাগে। সন্ধেবেলায় বিশাল ভোজ (হাওয়াইয়ান ভাষায় ভোজকে বলে লুয়াউ, রাজকীয় ভোজকে বলে আলি ই লুয়াউ)। তাতে বহু রকমের পদ এবং যত খুশি খাও। প্রধান পদ হল মাটির নীচে বসানো তন্দুরের মতো উনুনে রান্না করা শুয়োরের মাংস। তার পর অডিটোরিয়ামে দু’ঘন্টার নাচ-গানের অনুষ্ঠান ‘হরাইজন’, যাতে পলিনেশীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরলেন শতাধিক কলাকার, যাঁদের অনেকেই ওই সাতটি আদি জনগোষ্ঠীর মানুষ। হুলা নাচ এখানকার বিখ্যাত, কিছুটা ধীর গতি কিন্তু অত্যন্ত লীলায়িত ও ছন্দময়। অনুষ্ঠান দেখে হোটেলে ফিরতে প্রায় মাঝরাত হয়ে গেল।

চতুর্থ দিন
হনলুলু থেকে মাত্র পঞ্চাশ মিনিটের উড়ানে পৌঁছালাম বিগ আইল্যান্ডের প্রধান শহর কাইলুয়া-কনা। যে হোটেলে উঠলাম সেটা সমুদ্রের কিনারায়, রুম পেলাম এক তলায়, পিছনের ব্যালকনি দিয়ে বেরোলেই একেবারে সমুদ্রতট। পরের দিন সকালে স্থানীয় ম্যাকডোনাল্ডে প্রাতরাশ সারলাম। ওখানে সকালেই গরম ভাত খাওয়ার রেওয়াজ আছে। তার পর গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম এই দ্বীপের অন্য প্রধান শহর হিলোর উদ্দেশে, যা একেবারে অন্য প্রান্তে। বেল্ট রোড ধরে দ্বীপ অর্ধ পরিক্রমা করে পথের দু’ধারের মনোরম দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে পৌঁছালাম হিলো। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে দ্বীপ দেখা। প্রতি হেলিকপ্টারে চার কিংবা ছয় জন যাত্রী। আমাদেরটাতে চারজন, আমরা ছাড়া আর দু’জন। প্রথমে সবার ওজন করা হল এবং তার পর নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ। আগে থেকে অনুরোধ করেছিলাম বলে সামনের সারিতে জায়গা পেলাম, পাইলটের পাশেই। পাইলটের সঙ্গে এবং নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য সবাইকে দেওয়া হল বিশেষ হেড সেট। কারণ হেলিকপ্টারের ভিতরে এত আওয়াজ যে পাশের লোকের কথাও শোনা যায় না। মহিলা পাইলট, আমাদের ট্যুর গাইডও বটে। অনেক নদী, পাহাড়, ঝরনা, সবুজ বন, জনবসতি, হেলিকপ্টার থেকে দেখা সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা!

এই দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব ভাগে আছে পৃথিবীর অন্যতম জীবন্ত আগ্নেয়গিরি— কিলাউইয়া। সবাই অনুরোধ করায় নিরাপত্তার আইন মেনে যতটা কাছে এবং নীচে নিয়ে যাওয়া যায়, পাইলট আমাদের ততটাই নিয়ে গেলেন। তপ্ত লাভার উত্তাপ ছুঁতে লাগল আমাদের। বিস্ফারিত নয়নে প্রকৃতির এই অদ্ভুত লীলা দেখলাম অনেক ক্ষণ। ১৯৮৩ সালে কিলাউইয়া তার উদ্গীরণ শুরু করে এবং তার থেকে গলিত লাভা আজও বয়ে চলেছে। লাভার উপরিভাগ কিছুটা ঠান্ডা হয়ে জমে গিয়ে জং ধরা লোহার মতো দেখতে হয়ে গেছে (তবুও খুব গরম, তার থেকে ক্রমাগত বাষ্প উঠছে এবং সেখানে যাওয়া নিষেধ)। তার তলায় ‘লাভা টিউবের’ ভিতর দিয়ে অতি ধীর গতিতে লাভা বয়ে চলেছে সমুদ্রের দিকে। যেখানে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে, সেইখান থেকেও উঠছে প্রচুর বাষ্প। জায়গায় জায়গায় ফাটলের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে লাল রঙের গলিত লাভা। এই লাভা জমে গিয়ে গত কয়েক বছরেই সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৬০০ একর নতুন জমি, যা এখনও বেশ গরম। কালক্রমে এই সব জমির প্রকৃতি পালটাবে এবং তাতে গাছপালা গজাবে, হয়ত কালান্তরে লোকে বসবাসও করবে।
তপ্ত লাভার স্রোত মিশছে সাগরে* লাভা টিউব* হালেমাউমাউ নামক বিশাল গ্বহর
আসলে হাওয়াই দ্বীপের বেশির ভাগ অংশ এই ভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের এখানে আসার মাসখানেক আগেই কিলাউইয়া আবার নতুন করে জেগে উঠেছে। এক কালে এর চূড়াতে ছিল জ্বালামুখী, যা ধসে গিয়ে তৈরি হয়েছে হালেমাউমাউ নামক বিশাল গহ্বর। এখান থেকে বাষ্প, ধোঁয়া ও ছাই উদ্গীরণ হতে শুরু হয়েছে এবং আজও সমানে চলছে। কিলাউইয়া ছাড়াও মাউনা লোয়া নামে আর একটি আগ্নেয়গিরি আছে এই দ্বীপে, যা বর্তমানে চুপচাপ আছে ১৯৮৪ সাল থেকে। ষাটের দশকে মার্কিন মহাকাশ যাত্রীরা জমির সাদৃশ্যের কারণে মাউনা লোয়ার লাভার মাঠে প্রশিক্ষণ করতেন চাঁদে অবতরণের এবং হাঁটার কৌশল।

পঞ্চম দিন
আজকের দিনটা একটি ট্যুর কোম্পানির বাসে চড়ে বিগ আইল্যান্ড দর্শনে বেরলাম। কিছু ক্ষণ পর বাস থামল এক সৈকতে। সৈকতটা তত ভাল নয়, কিন্তু সমুদ্রে দারুণ ঢেউ। দূরে তাকিয়ে দেখি অনেকে সার্ফিং করছে। সার্ফিং এক ধরনের জলের খেলা যাতে একটা পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে বা শুয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় চড়ে ভেসে চলা, কয়েক সেকেন্ড বা এক-দু’ মিনিটের জন্য। খেলাটি বেশ বিপজ্জনক এবং প্রচুর দক্ষতারও প্রয়োজন। সার্ফিং-এর জন্য উঁচু ঢেউ চাই, যা সাপের ফণার মতো আকার নিয়ে এগিয়ে আসে। সাঁতারুরা বিশেষ কায়দায় সেই ঢেউয়ের মাথায় চড়ে এগোতে থাকেন। এই ধরনের ঢেউ পৃথিবীর কয়েকটি জায়গাতেই পাওয়া যায় এবং তার মধ্যে এখানকার ঢেউ বিখ্যাত। তাই বহু জায়গা থেকে সার্ফাররা হাওয়াইয়ে আসেন শুধু সার্ফিং করতে। সমুদ্রতটে দাঁড়ানো বহু মানুষের সঙ্গে আমরাও এই সব দুঃসাহসীদের খেলা দেখলাম আর মনে ভাবলাম ‘মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই’!

এর পরে গেলাম এই দ্বীপের পুনালুউ সৈকত, যার বালি কালো রঙের। এই কালো বালি আসলে আগ্নেয় পাথর এবং আগ্নেয় কাচের গুঁড়ি। এই সৈকতে বড় বড় কচ্ছপরা জল থেকে ডাঙায় উঠে এসে রোদ পোহায়।

সেখান থেকে রওনা দিয়ে দুপুর একটা নাগাদ বাস থামল রাস্তার ধারে এক জায়গায় দ্বিপ্রাহরিক আহারের জন্য। বাস থেকে নামার আগে গাইড এখানকার দোকানের খাবারের প্রশংসা করলেন। নেমে দেখি সেখানে আরও অনেক বাস এবং গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একটা পুরনো স্কুলবাসের ভেতরটাকে পালটে তার মধ্যে তৈরি করেছে খাবার দোকান, সেইখানেই রান্না হচ্ছে। ভীষণ ভীড়। কিন্তু তারা প্রত্যেকের অর্ডার নিয়ে তাড়াতাড়ি খাবার পরিবেশন করতে খুবই দক্ষ। এমন কি ওই মাঠের মধ্যে থেকেই ‘ক্রেডিট কার্ডে’ খাবারের দাম নিচ্ছে। খাবারের মধ্যে বিশেষ মনে রাখার মতো হল, পাশের পুকুর থেকে ধরা তাজা চিংড়ি মাছ নারকেল গুঁড়ো দিয়ে ভাজা, যা পরম উপাদেয়। সেই সঙ্গে ভাত, অল্প ঝোল সমেত কিছু সেদ্ধ তরকারি এবং খোসা সমেত আনারসের বড় টুকরো। শামিয়ানার নীচে টেবিল-বেঞ্চিতে বসে সমুদ্রের ঢেউ দেখতে দেখতে খাওয়াটা খুবই মনোরম।

এর পরে বাস থামল একটি বিশাল অর্কিডের বাগানে। এটা একটা দোকানও বটে। অর্কিড প্রধানত পরগাছা জাতীয় উদ্ভিদ, যদিও এর চাষ মাটিতেও হয়। অর্কিড সাধারণ ভাবে দুষ্প্রাপ্য, কিন্তু এর ফুল এত মনোরম যে এর কদর সারা পৃথিবী জুড়ে। অর্কিডের জন্য চাই অনেক আলো, যদিও সরাসরি সূর্যালোক বেশি হয়ে গেলে মুশকিল। জলের বদলে ফুলের টবে সপ্তাহে একটি করে বরফের কিউব দিলে ভাল হয়। এই দোকানে এত বিভিন্ন রকমের অর্কিড আছে যা দেখলে মাথা খারাপ হবার জোগাড় এবং লোভ সামলানো মুশকিল। পর্যটকরা কিনছেনও খুব। এমনিতে গাছপালা সঙ্গে নিয়ে আমেরিকাতে ঢোকা বারণ, কিন্তু এই দোকানে অর্কিড কিনলে ওরা আইন মেনে সরাসরি পাঠিয়ে দেবে আমেরিকাতে (যাকে এখানকার লোকেরা বলে ‘মেনল্যান্ড’) আপনার বাড়ির ঠিকানায়।

ষষ্ঠ দিন
অনেকে মনে করেন যে হাতে যদি সময় কম থাকে তা হলে শুধু মাউই দেখুন, কারণ হাওয়াইয়ের বিভিন্ন দ্বীপের যা যা বিশেষত্ব তার প্রায় সবই এই মাউইয়ে দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের বেড়ানোর শেষ দু’দিন কাটালাম মাউইয়ে। বিগ আইল্যান্ড থেকে মাত্র চল্লিশ মিনিটের উড়ানে পৌঁছলাম মাউইয়ের প্রধান শহর কাহুলুই-এ।

সকাল বেলায় বাসে চেপে চললাম মাউই ঘুরতে। প্রথমে গেলাম ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি হালিয়াকালার শিখরে, যা দশ হাজার ফুট (৩০০০ মিটার) উঁচু। অত্যন্ত খাড়া পাহাড়ি রাস্তা ঘুরে ঘুরে পৌঁছলাম সেখানে। এই শিখরকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘সূর্যদেবের ঘর’। শুনেছি এখান থেকে সূর্যোদয় দেখা দারুণ ব্যাপার, তবে আমাদের সে সুযোগ হল না, কারণ তখন বেলা এগারোটা বাজে। এখান থেকে নীচের দিকে তাকালে প্রথমেই চোখে পড়বে অনেক মেঘ ভেসে যাচ্ছে, কেন না আমরা মেঘের চেয়ে উঁচুতে আছি যে। এখানে একটি পর্যটককেন্দ্র আছে, যেখান থেকে খালি চোখে ৪০-৫০ মাইল দূরের বিগ আইল্যান্ড পর্যন্ত দেখা যায়। হঠাৎ করে তাপমাত্রা খুব কমে যায় এই শিখর এলাকায়, তাই সঙ্গে একটা হাল্কা জ্যাকেট রাখা দরকার। একদম উপরে আছে মার্কিন সেনার মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, তবে সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ।

ফেরার সময়ে মনোরম হানা হাইওয়ে ধরে আমাদের বাস চলল, যার পথের দু’ধারে অজস্র দ্রষ্টব্য— সুন্দর অরণ্য বিশেষ করে ইউক্যালিপ্টাসের, অনেক জলপ্রপাত, বিভিন্ন গিরিখাত, জায়গায় জায়গায় পিকনিক স্পট। মনে হচ্ছিল বাস থেকে নেমে ওই সব জায়গায় কাটাই অনেক ক্ষণ। সন্ধেবেলায় গেলাম কাহুলুই শহরের কা’আহুমানু সেন্টার দেখতে, যা আসলে একটি আধুনিক মল এবং এটা রানি কা’আহুমানু-র নামে। রানির একটি পূর্ণাঙ্গ মূর্তিও আছে এখানে। রানি কা’আহুমানু ছিলেন রাজা কামেহামেহার পত্নী। ১৮১৯ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি প্রধান মন্ত্রী হিসাবে রাজ্য শাসন করেন এবং তাঁর ছেলে রাজা দ্বিতীয় কামেহামেহার শাসনকালে তিনি রাজমাতা হিসাবে রাজার সঙ্গে সমমর্যাদা পেতেন। বলাই বাহুল্য, তিনি ছিলেন রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী। তিনি স্ত্রী স্বাধীনতার দিক থেকেও ছিলেন একজন অগ্রণী।

এই মলে কিছু দোকান আছে যারা হাওয়াইয়ের বিশেষত্ব জিনিস বিক্রি করেন, যেমন হাওয়াই চপ্পলের ডিজাইনের গলার হারের লকেট, গুলঞ্চ ফুলের ডিজাইনের কানের দুল, আনারসের ডিজাইনের বিবিধ জিনিস। একটি দোকানে জল ভরা পাত্রে অনেক জ্যান্ত ঝিনুক রাখা আছে যাদের ভিতরে আছে সত্যিকারের মুক্তো, কিন্তু খুলে দেখা যাবে না যত ক্ষণ না আপনি কিনছেন। কিনলে সেই ঝিনুক খুলে যে মুক্তো বেরোবে, তাই দিয়ে কানের দুল বানিয়ে দেবে কয়েক মিনিটের মধ্যেই।

হাওয়াইয়ের আদি বাসিন্দারা নানা ধরনের দেবদেবী বিশ্বাস করতেন, যেমন আগ্নেয়গিরির দেবতা ‘পেলে’ যাকে ভয় এবং শ্রদ্ধা করা হত। এ ছাড়া ছিল অনেক ‘টিকি’ দেবতা। তাদের মধ্যে চার জন বিখ্যাত— ‘কু’ যিনি যুদ্ধের দেবতা, ‘লোনো’ উর্বরতা ও শান্তির দেবতা, ‘কানে’ আলো ও জীবনের দেবতা, এবং ‘কানাওলা’ সমুদ্রের দেবতা। পর্যটকরা প্রচুর কেনেন কাঠের তৈরি এই সব ‘টিকি’ দেবতাদের মূর্তি, বিশেষ করে ‘লাকো ওয়াই ওয়াই’-এর, যিনি সম্পদের দেবতা।

অবশেষে বন্দরের কাল হল শেষ, নোঙর তোলার দিন এল! এমন জায়গা ছেড়ে কি ফিরতে ইচ্ছে করে? কিন্তু, চাকরিরে তুঁহু মম শ্যাম সমান, ফিরতে যে হবেই! তবে সময় ও সুযোগ থাকলে এখানে পুনরাগমনায়-চ।

এক কথায়: হাওয়াই-এ গেলে সত্যিই হাওয়া বদল হয়।
 
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। কর্মসূত্রে এবং ভ্রমণ পিপাসায় পৃথিবীর বহু দ্রষ্টব্য জায়গা দেখার সুযোগ পেয়েছেন। ছেলেবেলা কেটেছে বীরভূম জেলায়। কলেজ জীবন দুর্গাপুর আরইসি এবং খড়্গপুর আইআইটি। কর্মসূত্রে ভারতের ভোপাল, নাগপুর, পুণে প্রভৃতি শহরে বাস করেছেন। গত ১৮ বছর ধরে আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে বাস। লেখার অভ্যাস অনেকদিনের, তবে তা প্রধানত ইংরেজিতে। দু’টি কলেজপাঠ্য ইঞ্জিনিয়ারিং বইয়ের লেখক। বাংলা পড়ার অভ্যেস বরাবরই।
ছবি: লেখক ও ইন্টারনেট (*)
এই লেখকের আরও ভ্রমণকথা



রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল স্বাদবদল • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ