৩০ আষাঢ় ১৪১৮ শুক্রবার ১৫ জুলাই ২০১১



 
আমআনন্দের আমকাহন
সন্তের বাতাসটুকুর মতো...। আরে না না। সে চলে গেল না, বরং বলতে পারি সে এল। এসেছে। মন জয় করেছে। তার সুবাস ছড়িয়েছে গলির টুকরো মোড় থেকে ব্র্যান্ডেড মার্কেটে। উহুঁ, বাদ পড়েনি খাটের তলা থেকে ডাবলডোরের ঠান্ডাঘরের ছাদে সুসজ্জিত ফলের ঝুড়িতেও।

কে?

কে আবার সেই যে ফলের রাজা! থুড়ি, রানি। এইরে ঝগড়া লাগল বলে। রানি কেনই বা নয়। হতেই হবে। আরে বাবা যার এমন কামরাঙা রূপ, ভরা যৌবন, মাতাল করা গন্ধে কান্তা-কুন্তলীনি হার মেনে যায়। আম-বাদশা, আম-বাঙালি, আম-বিদেশি মনে মনে এমন পাগলিনীকে ভাল না বেসে থাকতে পারে? সে তো রানিই বটে।

আর আমাদের রবিবাবু তো কত গানই লিখে ফেললেন। এক একটা লাইন তুললেই লেখা আমার শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু না আজ আমরা আমে মাতব। ‘পুলকিত আম্রবীথি ফাল্গুনেরই তাপে/মধুকর গুঞ্জরণে ছায়াতল কাঁপে’। অথবা ‘উদাসী হাওয়ার পথে’ ‘আমি আমের মঞ্জরী’ তোমায় ডাক দিয়েছি। তুমি এসো এই আম্রকুঞ্জে। এই আম্রবীথি, আম্রকুঞ্জ, আমের মঞ্জরী ফাল্গুনের দুপুরে কী যেন নেই একটা হালকা গরম পরিবেশে! আর বিকেল থেকে সন্ধের বাতাসে আমের মুকুলের গন্ধে ম ম পরিমণ্ডল। মুকুল থেকে টিপ টিপ ঝরছে মধু।
‘আহা আজি এ বসন্তে’ রাধাচূড়ায় আকাশ হলুদ, কৃষ্ণচূড়ায় আকাশ লাল। এরই মাঝে কালচে আমগাছ থেকে ঝুলছে একটি কাঁচা আম। একটি বৃন্তে একটি মিঠাই— একটি সাদাটে সবুজ আম। আমআনন্দে আমজনতা মেতে থাকেন বসন্তের আবহে, ‘সেকি এল’। গ্রীষ্ম-বর্ষা আমময় হয়ে থাকে। একটি শাখায় ভরা যৌবন নিয়ে কিসের ইঙ্গিত? কবির ভাষায় ‘ঢেলা মেরে বেল পেড়ে নেব’র জায়গায় ঢেলা মেরে আম পাড়ার হিড়িক চলে, অনুসঙ্গ হিসেবে থাকে টকঝাল শব্দবন্ধ।

সেই কাঁচা আমে পড়ে ভালবাসার কামড়। মনে পড়ছে সেই সব আমের কথা। পাঠক মনে করুন সেই যুবতী আমের মাদকতা। আম্রপালী, সুন্দরী, তোতাপুলি, বোম্বাই, পেয়ারাফুলি, গোলাপখাস, চৌসা, পিয়াপসন্দ্, দসেরা, ক্লাসিক ল্যাংড়া, হিমসাগর, ফজলি। তবে শোনা যায় নবাবের বাগানের মালিরা নানা জোড়কলমের ফল-ফুল সৃষ্টি করতেন। জাদু দেখাতেন প্রায় প্রতি বরষে। চম্পা আম, চন্দনকোষা, বাদশাপসন্দ্, কিষাণভোগ, রানিপসন্দ্, কোহিতুল, কালাপাহাড়...। আর এই সব আমের রসনায় যখন বদলে যায় জিভের স্বাদ, তখন মনে করিয়ে দেয় বেশ কয়েকটি পদ।
মনে করা যাক আমের স্ফটিক ঝোল। গরমকালে এই পদটি সত্যিই উপাদেয়। কাঁচা আমের খোসা ছাড়িয়ে টোকো ভাব কাটানোর জন্য রোদে এক দিন রাখতে হবে। কড়াইতে সামান্য সরষে ফোড়ন দিয়ে আমগুলো দিয়ে নুন, হলুদ আর অল্প মিষ্টি দিয়ে পাতলা ঝোল। একে ফাটকা ঝোলও বলা যেতে পারে।

আধ সেদ্ধ মুসুরডালের সঙ্গে মেশাতে হবে ফালি ফালি কাঁচা আমের টুকরো। পুরো সেদ্ধ হয়ে গেলে কড়াইতে জিরে ও শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে সাঁতলাতে হবে।

শোলমাছের চাকা তেলে হালকা করে ভেজে তুলতে হবে। গরম তেলে পাঁচফোড়ন, শুকনো লঙ্কা দিয়ে কাঁচা আম কষে নুন, সামান্য মিষ্টি, হলুদ মেশাতে হবে। জল দিয়ে আমের ঝোল ফুটলে তাতে মাছের টুকরো দিয়ে ফোটাতে হবে। সুগন্ধ ছাড়লে ও সামান্য জল মরলে নামিয়ে ঠান্ডা করুন।

এ ছাড়া আছে ঝুরো আমের মোরব্বা। কিসমিস-কাজুবাদাম দিয়ে আমের চাটনি। সামান্য চিনি দিয়ে দুধ ঘন করে ঠান্ডা করতে হবে। পাকা আম চটকে, আম ও দুধ মিশিয়ে ফ্রিজিং করুন।
ঠান্ডা দুধে কার্স্টাড পাউডারের মিশ্রণ তৈরি করে ঘন ফুটন্ত দুধে মেশাতে হবে। নামিয়ে ঠান্ডা করে তাতে অনায়াসে মেশানো যেতে পারে নানা জাতের আমের টুকরো।

এ তো গেল কাঁচা ও পাকা আমের কথন। আমাদের শহরের রাজপথে আমের বাহার বাদ দিলে চলবে না। ‘আসা যাওয়ার পথের ধারে’ মহানগরের রাজপথে, গলির খাঁজে উঁকি মারে সাবেক ঠাটের মাটির কলস। গলায় পরানো পুদিনাপাতার মালা, অঙ্গে জড়ানো লাল শালু। জলে ভিজে একবারে লেপ্টে আছে কলসের ভূষণ। তৃষ্ণা আর হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে মনে করতে ওষ্ঠ ভেজান আম-পুদিনার জলীয় মিশ্রণে। আর যদি মাটির কাছাকাছি থাকতে ইচ্ছে না করে তা হলে হাতে তুলে নিন কর্পোরেট আমপান্না।

গিন্নিমায়েরা যদি এক হন তা হলে বুঝিয়ে দেবেন কত রকম ভাবে আম কাটা যায়। কুচি, কুরো, ফালা, তেরচা, ডুমো। গরম ভাতের জন্য আছে আম-কাসুন্দি, আমবাটা। আমশুকনো আছে সারা বছরের গুপ্তধন হয়ে।
সেই ফাল্গুনের তাপে আম্রবীথির রমরমা শুরু হয়ে যায়। তার আমোদ চলে আষাঢ় পর্যন্ত। এটা প্রকৃতির দান। আর কর্পোরেটের কল্যাণে সারা বছর। লেসের বটুয়ার মধ্যে অথবা মসৃণ অঙ্গে নামী স্টিকার অ্যালফ্যান্সো।

শুধু এখানেই শেষ নয! ফিল্মি আম খাওয়া পর্বে মনে করতে পারি সেই ‘পথের পাঁচালি’ থেকে আজকের টিভি সিরিয়াল ‘বউ কথা কও’-তে। কচি আমের টুকরো অপু-দুর্গার হাতে দেখা গিয়েছে। আবার হাল-আমলের সিরিয়ালে মৌরি-নিখিলও কাঁচা টোকো আম খেয়ে চোখ মুখ কুঁচকেছে। আম গাছের ছাল থেকে নাকি ভেষজ ওষুধ তৈরি হয়। আবার আমপাতাও নানা মাঙ্গলিক কাজে ব্যবহৃত হয়। আহা যদি একটা আস্ত আম গাছ পাওয়া যেত...

আমার বাড়ির উত্তর দিকে একটি আমগাছ আছে। প্রতি বছরের মতো এ বারও দেখলাম পর্বে পর্বে তার সেজে ওঠার মুহূর্তগুলো। কিন্তু কেউ আম পাড়ল না। সেই গাছে নানা পাখির সংসার। ছোট্ট ছোট্ট শরীর নিয়ে সকালে কিংবা পড়ন্ত বেলায় আম ঠুকরে সোনা বের করেছে সেই পাখিরা। সোনারং মিশে যেতে দেখেছি সূর্যোদয়ের ছটায়।

এক দিন দেখি এক সকালে ডাল কাঁপিয়ে এল হনুমানের দল। ‘আহা কি আনন্দ আকাশে-বাতাসে!’
নিজস্ব চিত্র


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল স্বাদবদল • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ