১৬ আষাঢ় ১৪১৮ শুক্রবার ১ জুলাই ২০১১
আপনার কলমে...


‘আড্রিয়াটিকের রানি’ জলময় ভেনিস
ড্রিয়াটিক সাগরের তীরে প্রায় ১১৮টি দ্বীপ দিয়ে গড়া ভেনিস। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য দ্বীপগুলিতে রয়েছে ক্যানাল। মধ্যযুগে প্রায় তেরোশো থেকে সতেরোশো সাল পর্যন্ত ব্যবসা বাণিজ্যের খাতিরে, রেনেসাঁর সময়, ভেনিস ছিল প্রতিপত্তির শিখরে। ব্যবসা বলতে সিল্ক, মশলা ইত্যাদি। সেই গৌরবময় অতীতকে সোনার খাঁচায় বন্দি করে রেখেছে ভেনিসবাসী।

ভেনিসের মার্কোপোলো বিমানবন্দরে যখন পৌঁছালাম তখন রাত সাড়ে ন’টা। বিমানবন্দর থেকে বাসে করে যেতে হল পিজ্জেল রোমা— ভেনিসের লঞ্চ, স্পিডবোট চলাচলের কেন্দ্রস্থলে। ইউ-রেলের টিকিট কাটতে হবে এখান থেকে। আমাদের পরিকল্পনা ভেনিস থেকে ইউ-রেল ধরে ইউরোপের বিভিন্ন শহর ঘুরে, তার পর প্যারিসে যাব। অমিত একজনকে জিজ্ঞেস করল ‘রেল স্টেশন কোন দিকে?’ ভদ্রলোক প্রথমে বুঝতে পারলেন না, দু’বার জিজ্ঞেস করবার পরে বললেন, ‘ত্রেন?’ এখানে ট্রেন না বলে ওঁরা বলেন ‘ত্রেন’, আর ‘ন’-এর পরে একটা ‘অ’ থাকে বলে উচ্চারণটা অনেকটা শোনায়, ‘ত্রেনো’। ঘাড় দুলিয়ে হ্যাঁ বলায় একটা সেতু দেখিয়ে আমাদের বলা হল, ‘ও-পারে।’ মনে হল, এখন ওখানে যাওয়াটা ঠিক হবে না। থাক, কালই ট্রেনের টিকিট কাটা যাবে!
আড্রিয়াটিক সাগরের তীরে ভেনিস
লঞ্চঘাটের টিকিট কাউন্টারের মহিলা কর্মীটি ইংরেজিতে কথা বললেন। লঞ্চ একটা দাঁড়িয়ে আছে। তার ভেতরে কাঠের পাটাতনে বসার জায়গা। সাধারণ চেহারার কিছু লোকজন ক্লান্ত ও শুকনো মুখে বসে আছেন। ওঁরা দিনের শেষে বাড়ি ফিরছেন। প্রায় পাঁচটা ঘাট পেরিয়ে পৌঁছলাম গন্তব্যে, হস্টেলের ঘাট, ‘জিতেল’। লঞ্চের ইঞ্জিন আর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ— এ ছাড়া কোনও আওয়াজ নেই। আমরা এ-দিক ও-দিক তাকাচ্ছি। ঘাটের ধারে চেয়ারে একজন বসে ছিলেন। বললেন, ‘উস্তেলো ?’ অমিত বেশ উত্সাহিত হয়ে বলল, ‘সি, উস্তেলো।’ ভদ্রলোক সামনের দিকটা দেখিয়ে দিলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। অমিত আমাকে বলল, ‘বুঝলে না? উস্তেলো মানে হস্টেল, এখানে সব শব্দের পরে একটা ও-কার জুড়ে দেয়।’ কিছুটা হাঁটার পরে একটা বাড়ির সামনে একদল ছেলে মেয়েকে দেখতে পেলাম। কেউ সিমেন্টের চাতালের উপর শুয়ে, কেউ বসে, কেউ জলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, উদাসীর মতো। বুঝলাম, এটাই হস্টেল। আমাদের বুকিং আগেই করা ছিল।
পরিবহনের একমাত্র উপায় লঞ্চ আর নৌকা ক্যানাল পাড়ে লঞ্চঘাট
পর দিন সকালে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে, জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নীল জলের উপর সকালের নরম আলো পড়েছে, সূর্য্যের সোনালি আলো মেখে ছোট-বড় ঢেউগুলো শব্দ করে নাচছে, ও-পারে দিগন্তের গায়ে লাল, হলুদ অট্টালিকার সারি, মাঝে মাঝে একটা দু’টো গম্বুজাকৃতি চূড়া আকাশে মাথা তুলে আছে। স্পিডবোটও চলছে এ-দিক ও-দিক। এক ধরণের সাদা পাখি জলের উপরে ভেসে রয়েছে আর ঢেউয়ের সঙ্গে দুলছে। ভেনিসে সূর্যের আলো, নীল-সবুজ জল আর আকাশের নীল রঙের সমন্বয় অতুলনীয়, যা সব সময়ই শিল্পীদের আকৃষ্ট করেছে। ডান দিকে বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি বাড়িগুলো যেন নড়ছে, অবাক হয়ে গেলাম, কি হচ্ছে এটা ! কিছু ক্ষণ পরে দেখি বিশাল বড় একটা জাহাজ আসছে, সাদা রঙের। সে এত উঁচু যে বাড়িগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। সামনে আসার পরে তার নাম দেখা গেল, ‘সান নিকোলো’।

হস্টেল থেকে বেরিয়ে প্রথমে গেলাম রেল স্টেশন, ইউরোপের বাকি জায়গাগুলোয় যাওয়ার টিকিট কাটব বলে। কিন্তু এখানে খালি সুইত্জারল্যান্ডের ইন্টারল্যেকেন পর্যন্ত টিকিট পাওয়া গেল। পরিষেবা ততটা উন্নত নয়। তাই বাকি টিকিট সুইত্জারল্যান্ডে গিয়েই কাটতে হবে। রেল স্টেশনটা ছোট্ট। স্টেশন ঘাটে ভালই ভিড়, দোকানপাট আর চার ধারে কোলাহল।

ক্যানালটা এই জায়গাটাতে খুব বেশি চওড়া নয়। সেতু পেরিয়ে এ-পার ও-পার করা যায়। ভেনিসে পরিবহণ ব্যবস্থার প্রধান উপায়টির নাম ‘গ্র্যান্ড ক্যানাল’— এখানকার প্রায় ১১৮ টি ক্যানালের মধ্যে সবথেকে বড়। লম্বায় প্রায় ৫ কিলোমিটার, আর গভীর প্রায় সাড়ে চার মিটার। দুই তীর অসাধারণ সব অট্টালিকায় সজ্জিত হয়ে অশ্বখুরাকৃতি ভঙ্গিমায় ভেনিস লেগুনকে যেন বেড়ি দিয়ে রেখেছে। আশেপাশের বাড়িগুলোর কারুকার্য, দেওয়ালে আঁকা ছবি দেখলে বোঝা যায় যে, এক কালে এখানকার বাসিন্দারা স্থাপত্য আর ভাস্কর্যের মস্ত বড় পৃষ্ঠপোষক ছিল।
ক্যানাল আর তার পাড়ের বাড়ি বাড়িগুলোর কারুকার্য চোখে যেন আটকে থাকে বাড়ির গায়ে অলঙ্করণ
গ্র্যান্ড ক্যানাল ভেনিসের হাইওয়ে। যানবাহন বলতে শুধু নৌকা আর লঞ্চ। ভাবলেই অবাক লাগে কি করে জলের মধ্যে এই সব ইট-পাথরের বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আসলে বহু দিন আগে ভেনিসের অধিবাসীরা আল্পস থেকে আনা বড় বড় পাইন গাছের গুঁড়ি ভেনিসের নরম পলিমাটির মধ্যে ঠেসে পুঁতে রেখেছিল। কালের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি জমে শক্ত হয়ে গেছে। তার উপরে গাছের গুঁড়ি বিছিয়ে আর পাথর দিয়ে আজকের এই বাড়িগুলির ভিত্তি স্থাপিত হয়। তবে ভেনিসের নতুন প্রজন্ম লেগুন ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে বসবাস করতে পছন্দ করে।

আমাদের তালিকার প্রথমে আছে মিউজিয়াম,‘গ্যালারি দেল আকাদেমিয়া দি ভেনেজিয়া’— বাইজানটাইনীয়, গথিক আর ভেনিসীয় চিত্রকলার সব থেকে বড় সংগ্রহশালা। এখানে ভেনিসের বড় বড় শিল্পী— যেমন, জিওভান্নি বেলিনি, তিতিয়ান-এর আঁকা ছবি আছে। রেনেসাঁর আগের সময়কার ছবিগুলির প্রধান বিষয় ছিল যিশুখ্রিস্ট আর তাঁর জীবন। কাঠের প্যানেলের উপর আঁকা ছবির অনেকগুলোতে সোনার রং করা। মিউজিয়ামের কয়েকটা ‘ফ্লোরে’ জানলাগুলো হাট করে খোলা, ঘরগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়, মনে হয় যেন অনাদরে রয়েছে।
ডজের প্রাসাদের সামনে

এর পর আমরা গেলাম ‘পিয়াজ্জা সান মার্কো’তে। ওখানে ভেনিসের ‘ডজ’ অর্থাত্ ইতালির ডিউকের প্রাসাদ। গির্জা ছাড়া আরও অনেক কিছইু আছে। নেপোলিয়ন ‘পিয়াজ্জা সান মার্কো’র নাম দিয়েছিলেন ‘ইউরোপের ড্রয়িং রুম’। ছবির মতো সাজানো জায়গা। শুধু মানুষের কলরব, জলের শব্দ আর ভিড় করা পায়রার ডানার শব্দ। প্রায় নবম শতকে এই জায়গাটা তৈরি হয়েছিল সেন্ট মার্ক ব্যসিলিকার সামনে একটা ছোট জায়গা নিয়ে। এখনকার ‘পিয়াজ্জা সান মার্কো’তে এক দিকে ডিউকের প্রাসাদ, সেন্ট মার্ক ব্যসিলিকা, বেল টাওয়ার, তিন তলা ইংরেজি ‘ইউ’ আকৃতির বিশাল অট্টালিকা, ‘প্রোকিউরেটি’ রয়েছে। ‘প্রোকিউরেটি’ তখনকার সরকারি পদস্থ কর্মীদের অফিস আর বাড়ি ছিল। এখন এখানে পুরাতাত্ত্বিক মিউজিয়াম, পাঠাগার, ভেনিসের ছাপাখানা, আর অনেকগুলো রেস্তোরাঁ আছে। পৌঁছে দেখি পর্যটকদের প্রবল ভিড়। টিকিট কেটে ডজের প্রাসাদে ঢুকলাম। ইতালীয় ভাষায় এর নাম ‘পালাজ্জো দুকাল দি ভেনিজিয়া’। গথিক স্থাপত্যের এই প্রাসাদটাতে ডজের বাসস্থান ছাড়াও নেপোলিয়ানের অধীন ভেনিসীয় প্রজাতন্ত্রের অফিস ও গণ আদালত ছিল। ভেনিস তখন পরিচালিত হত অভিজাত সম্প্রদায় দ্বারা, কিন্তু সাধারণের অভিযোগ সংগ্রহের জন্যও একটা ঘর ছিল। প্যালেসের মধ্যে ঢোকার পরে সামনে পড়ল বর্গাকৃতি বিশাল চত্ত্বর, ইট দিয়ে বাঁধানো। তার মাঝে পাথরের বাঁধানো কুয়ো, ব্রোঞ্জের কারুকার্য করা। চার দিকে তিন তলা বাড়ি।

ডজের প্রাসাদের দেওয়ালে স্থাপত্য
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলাম, এখান থেকে গাইড আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চললেন। ভেতরে কোনওটাতে ডজের বসার ঘর, তাতে ব্যবহার্য-সামগ্রী রাখা, দেওয়াল জুড়ে কারুকার্য, আর বড় বড় ছবি। অস্ত্রাগারে বিশাল বিশাল তরবারি আর নানা রকম অস্ত্রশস্ত্র। বিরাট হলঘরের মধ্যে সিনেট অফিস ‘সালা দেল সিনেটো’। তার দেওয়াল আর ছাদ জুড়ে আঁকা তিন্তোরেত্তো’র অসাধারণ ছবি, ‘দ্য ট্রিয়াম্ফ অফ ভেনিস’। নানা রকম কাল্পনিক দেব দেবীরা সমুদ্র থেকে উঠে আসা নানা সম্পদ ভেনিসের বাসিন্দাদের দিচ্ছেন। তার বিশালত্ব আর নিখুঁত অলংকরণ অবর্ণনীয়।

ডজের প্রাসাদের সামনে বেল টাওয়ার, প্রথমে তৈরি হয়েছিল ষোড়শ শতকে। উচ্চতা প্রায় ১০০ মিটার। এলিভেটরে চড়ে উপরে যাওয়া যায়। তখন এটা ছিল ভেনিসের বাতিঘর এবং পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। এতে পাঁচটা ঘন্টা রয়েছে, ‘মেলিফিসিও’, ‘নোনা’, ‘ত্রোত্তিয়েরা’, ‘মেজ্জা-তেরজা’ আর ‘মারাঙ্গটা’। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সময় সেগুলো বাজানো হত। যেমন, মেলিফিসিও ঘন্টা বাজত যখন কোনও অপরাধীকে জনসমক্ষে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। নোনা বেল দ্বিপ্রহর ঘোষণা করত। ত্রোত্তিয়েরা বাজলে সম্ভ্রান্তদের ঘোড়া সাজত, ডজের প্রাসাদে মিটিং-এ যাওয়ার জন্য। মেজ্জা-তেরজা বাজলে সবাই বুঝত যে সিনেটের সভা বসেছে। আর মারাঙ্গটা আজও বাজে মধ্য রাত্রে।
সেন্ট মার্ক ব্যাসিলিকা
এর পরে সেন্ট মার্ক ব্যাসিলিকা। প্রায় নবম শতকে তৈরি এই ব্যাসিলিকায় নানা অলঙ্করণ আর সম্পদ সংযোজিত হয়েছে ধীরে ধীরে। কথিত আছে যে, সব ভেনিসীয় জাহাজই ভেনিস প্রত্যাগমনের সময় সেন্ট মার্ক ব্যাসিলিকায় সংযোজনের জন্য পাথরের থাম, মোজাইক, কাঠের কারুকার্য, ইত্যাদি নিয়ে আসত। তার ফলে এই ব্যাসিলিকায় মার্বেল পাথর, মোজাইক ইত্যাদির এমন সব নিদর্শন রয়েছে যেগুলি ব্যাসিলিকার থেকেও প্রাচীন। পাঁচটি গম্বুজ সমন্বিত বাইজানটাইনীয় ঘরানার এই ব্যাসিলিকা ভেনিসের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রধান কেন্দ্র। চার্চে ঢোকার কোনও প্রবেশমূল্য নেই, তবে চার্চের মিউজিয়াম, ট্রেজারিতে ঢোকার জন্য টিকিট লাগে। আমরা লাইন দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ক্যাথলিকদের গির্জা। হঠাত্ দেখি এক ভদ্রলোক বেছে বেছে মহিলাদের একটা করে কাপড় দিচ্ছেন। কি ব্যাপার? একটু পরে বুঝলাম। বাইরে উজ্জ্বল দিন, তার উপর ঝকঝকে রোদ্দুর, সবাই বেড়াতে এসেছে। যে দিকেই দেখি খোলামেলা পোশাকের মহিলার ছড়াছড়ি— স্ট্র্যাপ টপ, শর্টস, নিরাভরণ কাঁধ। ইতালির ক্যাথলিকরা খুব রক্ষণশীল। ওই রকম খোলামেলা পোশাকের মহিলা চার্চে ঢুকতে গেলেই একটা কাপড় ধরিয়ে দিচ্ছেন, আসলে ‘নিজেকে আবৃত কর’। খুবই অবাক হলাম। একেবারেই অপ্রত্যাশিত। আমাকে কিছু করতে হল না, কারণ আমি একটা শার্ট পরেছিলাম। চার্চের ভেতরে তখন মাস চলছে। চার্চের প্রধান বেদিটি বিখ্যাত ‘পালা দি-ওর’ বা ‘গোল্ডেন পাল’— মণিমুক্তো খচিত সোনার তৈরি প্যানেল, তাতে সেন্টদের প্রতিকৃতি, লিপি আঁকা। বাইজানটাইনীয় স্বর্ণকারেরা ৯৭৬ শতকে তৈরি করেন। নেপোলিয়ন যখন ভেনিস অধিকার করেন, তখন কিছু মণিমুক্তো লুঠ হয়।

বাইরে এসে অমিত কয়েকটা ছবি তুলল— চার্চের প্রধান ফটক, ক্লক টাওয়ারের চূড়ার ওপর সোনালি দেবদূতের মূর্তি, সেন্ট মার্ক স্কোয়ারের উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা, অট্টালিকার সারি, আর অগুণতি মানুষ। বাতাসে উৎসবের আমেজ, এ-দিক ও-দিক থেকে গানের সুর ভেসে আসছে, অর্কেস্ট্রা বাজছে চার দিকে। পায়রাগুলো মানুষের ভিড়ে এতটাই অভ্যস্থ যে হাত থেকে খাবার খাচ্ছে, কেউ আবার কাঁধের উপর পায়রাকে বসিয়ে ছবি তুলছে। গানের সুর যে দিক থেকে আসছিল, আমরা সে দিকে এগিয়ে গেলাম। আসলে এটা একটা কাফে, বাইরে সুন্দর টেবিল চেয়ার পেতে দিয়েছে। গ্রাহকদের মনোরঞ্জনের জন্য ধোপদুরস্ত পোশাক পরা এক দল বাদক ঘুরে ঘুরে বাদ্যযন্ত্র বাজাছে। শুধু ওই কাফের গ্রাহকরাই নয়, আমাদের মতো বাকি সবারই মনোরঞ্জন হচ্ছে। কাফের পাশে সারি সারি দোকান, বেশ কয়েকটা সোনার, হীরের গয়নার দোকান। সাজানো রয়েছে আংটি, বালা, নেকলেস ইত্যাদি। ভেনিসীয় কাচ বা ‘মুরানো গ্লাস’ খুব বিখ্যাত। শতাব্দী ধরে মুরানোর কাচ শৌখিন কাচের জগতে একাধিপতিত্ব বজায় রেখেছিল। কয়েকটা কাচের দোকানে দেখলাম নানা রকম রঙিন পেপার ওয়েট, ফুলদানী, অলংকার, আরও নানা রকম সামগ্রি। দামও সে রকম। পিয়াজ্জা সান মার্কো থেকে বেরিয়ে এসে লঞ্চ ধরলাম, যাব রিয়াল্টো মার্কেটে।
গন্ডোলা চলছে ক্যানাল দিয়ে
ক্যানাল দিয়ে গন্ডোলা চলছে। গন্ডোলা দেখতে সরু সরু ছিপের মতো, পাতলা, কিন্তু সুন্দর কারুকার্য করা। একাদশ শতক থেকে এই গন্ডোলাগুলো চলছে। তখনকার সময়ে সেতু ছিল না কাজেই গন্ডোলাই এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাতায়াতের প্রধান বাহন। এখন গন্ডোলা হল লাক্সারি। গন্ডোলা চালকদের প্রথাগত পোশাক আছে— সাদা শার্ট,‌ সাদা জুতো, কালো ট্রাউজার, মাথায় লাল ফিতে জড়ানো শোলার টুপি। গন্ডোলাগুলো আগে বেশ উজ্জ্বল রং দিয়ে সাড়ম্বরে সাজানো হত। পরে ভেনিসের সিনেট ডিক্রি জারি করল যে ওটা অতিরিক্ত বিলাসিতার লক্ষণ আর সম্পদের অপব্যবহার। তার পর থেকে কালো গন্ডোলা চালু হল, কিন্তু সেই উজ্জ্বল গন্ডোলাগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার ফিরে এসেছে। “ছিপখান তিনদাঁড়, তিনজন মাল্লা, চৌপর দিনভর দেয় দূর পাল্লা”— কবিতাটা মনে পড়ে গেল।
রিয়াল্টো সেতু রিয়াল্টো মার্কেট
পরিষ্কার ঝকঝকে দিন, নীল জলের ওপরে সূর্যের আলো পড়ে ঝিলমিল করছে। জলের দু’ধারে সারিবদ্ধ বাড়ি। অনেক বাড়িতে নৌকা বাঁধা রয়েছে, আমাদের দেশে যেমন বাড়িতে বাড়িতে একটা সাইকেল অন্তত থাকে। কোনও কোনও বাড়ির দেওয়ালে সুন্দর ছবি আঁকা, বাড়ির সিঁড়ি নেমে গেছে জলের মধ্যে। কোথাও দেখি কাচের মতো স্বচ্ছ জলে পড়া সূর্যের আলোর প্রতিফলন পড়েছে পাড়ের সাদা বাড়ির উপরে, আর বাড়িটাকে আরও ধপধপে সাদা করে তুলেছে। রিয়াল্টো মার্কেটে যেন মেলা বসেছে। ভিড়ের মধ্যে প্রায় আশি শতাংশ পর্যটক। এখানে ক্যানালটা সরু, রিয়াল্টো সেতু পেরিয়ে এ-দিক ও-দিক যাওয়া যায়। সেতুর পাশে সিমেন্টের চাতাল জলে নেমে গেছে, সেখানে সুন্দর সুন্দর বড় ছাতার নীচে চেয়ার টেবিল পাতা। তার তলায় লোকেরা অলস মেজাজে পানীয়-গ্লাস হাতে বসে আছে জল আর নৌকার দিকে তাকিয়ে।

রিয়াল্টো মার্কেটে বেশ কয়েকটা টাটকা ফলের দোকান দেখলাম। কাটা ফল সুন্দর প্লাস্টিকের বাক্সে ভরে বিক্রি হচ্ছে। এক দোকানে দেখি দোকানিরা নিজেদের মধ্যে বাংলাতে কথা বলছে, বুঝলাম ওঁরা বাংলাদেশের। আমরা ওঁদের দোকান থেকে দু’টো ফলের বাক্স কিনলাম, স্ট্রবেরি, তরমুজ, আনারস, আর আমের টুকরো ভরা। এখানে স্টলগুলোতে দেখি নানা সাইজের আর রঙের যেমন, গাঢ় লাল, হালকা হলুদ লঙ্কা থোকা থোকা ফুলের মতো করে সাজিয়ে রাখা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, এর কোনও বিশেষ কারণ আছে নাকি!’ একজন হেসে বললেন, ‘একটা কথা আছে না দিদি, শখের তোড়া, আশি টাকা। সেই ব্যাপার।’ আমিও হাসলাম। তাই তো, শখ করে, সাধারণ জিনিসকেই কত আসাধারণ করে তোলা যায়। দোকানগুলোতে শুকনো টোম্যাটো, মশলাপাতি বা শুকনো ফলও আছে। ভেনিসের তথা মেডিটারেনিয়ানের রোদ খুব বিখ্যাত। বহু দিন থেকেই এই রকম রোদে শুকনো জিনিস সংরক্ষণ করে রাখার প্রথা এঁদের মধ্যে।

আর একটা দেখার জিনিস হল ভেনিসের মুখোশ— নানা ধরণের, নানা রঙের, দামি বা সস্তা, ছোট বা বড় মুখোশের সম্ভার এখানকার দোকানে। কথিত আছে, মধ্যযুগ থেকেই উত্সবে ওই সব মুখোশে নিজেদের আড়াল করে ভেনিসের সম্ভ্রান্ত মানুষজন নানা কাজ করে বেড়াতেন। এক ধরণের মুখোশ দেখতে পাখির লম্বা ঠোঁটের মতো। বহু দিন আগে ভয়ংকর প্লেগ রোগে ভেনিসের বহু লোক আক্রান্ত হয়, তখন ডাক্তাররা ওই ধরণের মুখোশ পরতেন রোগী দেখার সময়, দুর্গন্ধ এড়াতে। রিয়াল্টো মার্কেট ছাড়িয়ে গলি দিয়ে ঘুরতে লাগলাম, ভাল খাবারের দোকান খুঁজতে। পাওয়া গেল একটা— পিজ্জা, ইতালীয় রুটি, দুধ, দই ইত্যাদি। হস্টেলে ফিরতে ফিরতে রাত, আর তার পরে ঘুম।

পর দিন যথারীতি সকাল সকাল উঠে জলের ধারে গিয়ে বসলাম। এ দিকটায় ভিড়ভাড় নেই, লোকেরা অলস মেজাজে ঘুরছে। একটা সিগাল ঢেউয়ের উপরে বসে দোল খাচ্ছে। আজ দুপুরে ভেনিস ছেড়ে চলে যাব। হাঁটতে হাঁটতে একটা সরু ক্যানালের পাড় ধরে অন্য প্রান্তে চলে গেলাম। বাড়িগুলো আমাদের দেশের মতো ইটের তৈরি, কার্নিশে জামা কাপড় শুকোচ্ছে। ইটের রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছে এক ছোট্ট পার্কে। গাছের সারি দিয়ে পার্কের সীমানা, আর তারপরে দিগন্ত বিস্তৃত নীল জল, একটা দু’টো সাদা বোট ভাসছে দূরে। বহু দূরে বুঝি এক সবুজ দ্বীপের আভাস।
আড্রিয়াটিকের তীরে সূর্যাস্ত
ভেনিজিয়া সেন্ট লুসিয়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরলাম, সুইত্জারল্যান্ডের উদ্দেশে। কত সবুজ প্রান্তর, আঙুরের খেত পার হয়ে গেলাম। ঘন্টাখানেক পরে এল ভেরোনা। আমরা ট্রেন থেকে প্লাটফর্মে ‘ভেরোনা’ লেখা দেখেই নিজেদের ক্ষান্ত করলাম। মনে আছে ভেরোনা? শেক্সপিয়রের রোমিও-জুলিয়েটের গল্পে জুলিয়েটের শহর, ইতালির সুন্দর শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। জুলিয়েটের বাড়ি আর ব্যালকনি, যেখানে রোমিও আসত দেখা করতে, তা দ্রষ্টব্য করে রাখা হয়েছে। রোমান সাম্রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার জন্য ভেরোনাকে ‘পিক্কোনা রোমা’ বা ‘ক্ষুদ্র রোম’ বলা হত। ১৩০০-১৪০০ খ্রিস্টাব্দে ভেরোনার প্রতিপত্তি শিখরে পৌঁছায়, তখন পারিবারিক বিবাদ আর হানাহানি লেগেই থাকত। শেক্সপিয়রের রোমিও-জুলিয়েটের গল্পে তারই প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। মিলান সেন্ট্রাল স্টেশনে ট্রেন বদল করলাম সুইত্জারল্যান্ডের জন্য, তখন দিনের শেষ, সূর্যদেব অস্ত গেছেন।

এক কথায়: ভেনিসে সূর্যের আলো, নীল-সবুজ জল আর নীল আকাশের সমন্বয় অতুলনীয়।
 
জন্মসূত্রে পূর্ব মেদিনীপুরের মেয়ে। বিবাহসূত্রে এখন আমেরিকায় বসবাস। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। কাজের ফাঁকে ফাঁকে রবীন্দ্রসংগীত শোনা আর সুযোগ পেলেই তুলি হাতে ছবি আঁকা। মাঝে মাঝে অল্পবিস্তর লেখালেখি। ভাল কোনও জায়গা থেকে ঘুরে এসে তা লিখে ফেলাটা এক অদম্য অভ্যাস।
ছবি: লেখক


এই লেখকের আরও ভ্রমণ-কথা



রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল স্বাদবদল • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ