দিন আসে, দিন যায়, তার ফাঁকেই ইতিহাসে ঢুকে পড়ে তার চলাচলের খবর। পুরনো দিনের শহুরে খবর দিয়ে চেনা যায় এখনকার
অতি পরিচিত শহরের অতীতটাকে, তার নাগরিক জীবনযাপন থেকে খেলাধুলো, সংস্কৃতি বা কূটকচালি থেকে রাজনীতির হাল।
পঞ্চাশ বছর আগের কলকাতা শহরের গতিবিধি চিনতে ২১ এপ্রিল ১৯৬৩ থেকে ২০ মে ১৯৬৩ এক মাসের কিছু বিশেষ খবর।

রবিবার, ৭ বৈশাখ, ১৩৭০( ১ বৈশাখ, ১৮৮৫ শক) SUNDAY, APRIL 21, 1963
• বাংলার সাহিত্যিকদের বার্ষিক মিলন উত্সব: শনিবার কলিকাতায় এক সাহিত্যিক সমাবেশে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিকট মাইকেলে মধুসূদন এবং বঙ্কিমচন্দ্রের নামে দুইটি সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার অনুরোধ জানান হয়। এইদিন সন্ধ্যায় কলিকাতা তথ্য কেন্দ্রে বাংলার সাহিত্যিকদের বার্ষিক মিলন উত্সব অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৫ সাল হইতে এই উত্সবটি অনুষ্ঠিত হইতেছে। সভাপতিত্ব করেন পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন। তিনি ছয়জন খ্যাতানামা সাহিত্যিককে পুরস্কার বিতরণ করেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, দেশ, অমৃতবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, মৌচাক এবং উল্টোরথ পত্রপত্রিকার পক্ষ হইতে এই পুরস্কারগুলি ঘোষিত হইয়াছিল।
শনিবার কলিকাতা তথ্যকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত সাহিত্যিক মিলন উত্সবের উদ্যোক্তা ও পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিকগণের সহিত মূখ্যমন্ত্রী।
(বাম হইতে) শ্রীবুদ্ধদেব বসু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীকালিদাস রায়, শ্রীতুষারকান্তি ঘোষ, মূখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন,
শ্রীমতী ঊষা রায়, শ্রীঅশোককুমার সরকার, শ্রীরমাপদ চৌধুরী এবং প্রেমেন্দ্র মিত্র।—আনন্দ-চিত্র।
এই বত্সর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মতিলাল ঘোষ পুরস্কার, শ্রীকালিদাস রায় সুরেশচন্দ্র মজুমদার স্মৃতি পুরস্কার, শ্রীবুদ্ধদেব বসু শিশিরকুমার ঘোষ পুরস্কার, শ্রীরমাপদ চৌধুরী প্রফুল্লকুমার সরকার স্মৃতি পুরস্কার, শ্রীমতী ঊষা রায় উল্টোরথ পুরস্কার এবং শ্রীপ্রেমেন্দ্র মিত্র মৌচাক পুরস্কার লাভ করেন। মূখ্যমন্ত্রী শ্রীসেন সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, যাঁহাদিগকে এইবার পুরস্কার দেওয়া হইতেছে, তাঁহারা ইতিমধ্যেই সমস্ত দেশবাসীর অভিনন্দন লাভ করিয়াছেন। তিনি পুরস্কৃত লেখক এবং পুরস্কারদাতা— উভয়কেই অভিনন্দন জানান। তিনি সাহিত্যিক পরিজন সেবা তহবিলে দুই হাজার টাকা দান করেন। প্রারম্ভে অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক শ্রীতুষারকান্তি ঘোষ সকলকে স্বাগত জানান এবং সমাপ্তিতে ধন্যবাদ জানান আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক শ্রীঅশোককুমার সরকার।

মঙ্গলবার, ৯ বৈশাখ, ১৩৭০ TUESDAY, APRIL 23, 1963
• কলেরার করালগ্রাসে কলিকাতা: ব্যাধিমন্দির কলিকাতায় বর্তমানে কলেরার একাধিপত্য। পূর্ব সপ্তাহে এই শহরে মোট ১৫১ জন কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়, ঐ সময়ে ৫৬ জন মারা যায়। বর্তমান সপ্তাহে ঐ সংখ্যা আরও অনেক বাড়িবে বলিয়া আশঙ্কা করা হইতেছে। এই ভয়াবহ অবস্থা রোধের উপায় নির্ধারণকল্পে আজ (মঙ্গলবার) কর্পোরেশনে মেয়রের কক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হইতেছে। বৈঠকে রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্যদপ্তরের পদস্থ অফিসারগণও থাকবেন। বস্তি এবং অনুন্নত এলাকাসমূহে এই রোগের প্রকোপ অত্যন্ত বেশী। ঐ এলাকাগুলি হইতেছে, টালিগঞ্জ, ঢাকুরিয়া, যাদবপুর, মাণিকতলা, উল্টাডাঙ্গা, নারকেলডাঙ্গা, বেলেঘাটা প্রভৃতি। ঐসব এলাকায় কলেরা দমন করিবার ব্যাপারে বিশেষ জোর দেওয়া প্রয়োজন বলিয়া ওয়াকিবহালমহল মনে করেন। এই রোগ বিস্তারের একটি প্রধান কারণ কাটা ফলের অবাধ কেনাবাচা।

— আমি তো টিকা নিয়েছি।
কলিকাতা কর্পোরেশনের পক্ষ হইতে পুলিসের সহায়তায় প্রতি বত্সর কাটা ফলের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হইয়া থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই অভিযান বহ্বারণ্ডে লঘুক্রিয়ায় পর্যবসিত হয়। কয়েকদিন পুলিশের হৈহল্লা ও লরীর দাপট চলে। তারপরই সব ঠাণ্ডা। পুলিসের নাকের ডগায় বিভিন্ন শিক্ষায়তন বড়বাজার, কলিকাতা ময়দান, পার্ক-উদ্যান প্রভৃতি স্থানে অবাধে কাটা ফল, ফুচকা, সরবত্ ইত্যাদি বেচাকেনা চলে। শনিবারই আমি দুইজন পাগড়িধারী পুলিসকে ময়দানে সরবত্ গলাধঃকরণ করিতে দেখিয়াছি।


কোথায় আমরা যাব,
কাজ করতে যাচ্ছি?
• নিয়মের অপ্রত্যাশিত ব্যতিক্রম: সোমবার বিদ্যুত্ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় কলিকাতার কোন অংশে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করিয়া দেওয়া হয় নাই বলিয়া প্রকাশ। কলিকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনের সূত্রে জানান হয় যে, প্রকৃতপক্ষে গত শনিবার হইতেই সরবরাহ পূর্ণমাত্রায় বজায় রাখা হইয়াছে। উক্ত কর্পোরেশনের এজেন্ট মিঃ ডিপিএস কাঙ্গা এই দিন দুপুরে সরকারী দপ্তরখানার পশ্চিমবঙ্গের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী শ্রীতরুণকান্তি ঘোষের সহিত সাক্ষাত্ করেন। মিঃ কাঙ্গা জানান যে, গত সপ্তাহের পর মালগাড়ী সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি দেখা গিয়াছে এবং তাঁহাদের চাহিদা মত উন্নত ধরনের “সাইজ করা” কয়লা সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি দেখা গিয়াছে এবং তাঁহাদের চাহিদা মত উন্নত ধরনের “সাইজ করা” কয়লা সরবরাহ অব্যাহত রাখা হইবে বলিয়া প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়াছে। মিঃ কাঙ্গা আশা করেন, প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ ঠিকমত বজায় থাকিলে বিদ্যুত উত্পাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব হইবে এবং এইদিক দিয়া বিচার করিলে বিদ্যুত সরবরাহে বিঘ্ন নাও ঘটিতে পারে। জনৈক বিদ্যুত বিশেষজ্ঞ এই দিন বলেন পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা সরবরাহকে প্রায় ছাড়াইয়া যাইবার উপক্রম করিয়াছে। এখন যত্র আয় তত্র ব্যয়। মজুত কিছুই নাই। সেই জন্যই কোন কারণে বিদ্যুত উত্পাদনে বিঘ্ন উপস্থিত হইলেই কলিকাতা ও তত্-সন্নিহিত বৃহত্ শিল্পাঞ্চলে বিদ্যুত সংকট উপস্থিত হইতেছে। কলিকাতা ইলেকট্রিসিটি কর্পোরেশনের কাশীপুর উত্পাদন কারখানার তৃতীয় ইউনিট এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দূর্গাপুর তাপ উত্পাদন কেন্দ্র এই বত্সরের শেষ দিক হইতে বিদ্যুত উত্পাদন সুরু করিলে এই সংকট কিছুটা কাটিবে। তবে আগামী বত্সর ব্যাণ্ডেল তাপ উত্পাদন কারখানার কাজ চালু না হওয়া পর্যন্ত ইহা ছাড়া যাইবে না বলিয়াই ওয়াকিবহাল ব্যক্তিরা মনে করেন। আশা করা যায় ব্যাণ্ডেলের তাপ কারখানা ১৯৬৪ সালের শেষ দিকেই উত্পাদন সুরু করিবে।

বুধবার, ১০ বৈশাখ, ১৩৭০ (৪ বৈশাখ ১৮৮৫ শক) WEDNESDAY, APRIL 24, 1963
• কলিকাতার বাজারে মাছের অগ্নিমূল্য: পশ্চিমবঙ্গের মত্স্যমন্ত্রী শ্রীফজলুর রহমান মঙ্গলবার রাইটার্স বিল্ডিংসে সাংবাদিকদের বলেন, পশ্চিমবঙ্গে মাছের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য সরকার সচেষ্ট হইতেছেন। ইতিমধ্যে কলিকাতার বাজারে কিন্তু মাছের দাম হু-হু করিয়া বাড়িয়াই চলিয়াছে। মত্স্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, পাইকারী-খুচরা সকল স্তরেই মাছের দাম বাঁধিয়া দেওয়া হইবে ও মত্স্য-ব্যবসায়ীদের সকলকে লাইসেন্স গ্রহণ করিতে হইবে। কবে হইতে ইহা কাযর্করী হইবে তাহা তিনি জানান নাই। তবে তিনি বলেন : এই ব্যাপারে শীঘ্রই একটি অর্ডিন্যান্স জারী হইতে পারে। মত্স্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের নিকট দৃঢ়কন্ঠে বলেন : এক শ্রেণীর মত্স্য-ব্যবসায়ীর অতিরিক্ত মুনাফাবাজী রোধ করিতে হইবেই। তিনি বলেন, কলিকাতায় বতর্মানে ৬০ জন আড়ত্দার, ২৬৫ জন পাইকারী ব্যবসায়ী ও ১১,৫০০ খুচরা ব্যবসায়ী আছেন। ইহাদের মধ্যে কেবলমাত্র চার হাজার খুচরা ব্যবসায়ীর ব্যবসা লাইসেন্স আছে। তাহা ছাড়া মত্স্য-ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারের হাতে কোন ক্ষমতাই নাই। এই সকল ব্যবসায়ীর উধ্বর্তম দর বাঁধিয়া দিয়া তাহাদের সকলের ক্ষেত্রেই লাইসেন্স চালু করা হইবে।

বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ, ১৩৭০ (৫ বৈশাখ ১৮৮৫ শক) THURSDAY, APRIL 25, 1963
• বিদ্যুত্ শুল্কের হার বৃদ্ধি: বতর্মানে আলো ও পাখার জন্য বিদ্যুত শুল্কের হার ইউনিট পিছু ৩ নয়া পয়সা হইতে ৬ নয়া পয়সা এবং আলো ও পাখা ছাড়া অন্যান্য উদ্দেশ্যে ঐরূপ শুল্কের হার ইউনিট পিছু মাত্র ১ নয়া পয়সা। কলিকাতা গেজেটের এক অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত ১৯৬৩ সালের বঙ্গীয় বিদ্যুত শুল্ক (সংশোধন) আইন প্রবর্তিত হওয়ার ফলে ১৯৬৩ সালের ১লা মে হইতে আলো ও পাখা, গার্হস্থ্য প্রয়োজনের বিদ্যুতশক্তি ও কৃষির উদ্দেশ্য ছাড়া অন্যত্র ইউনিট প্রতি ঐরূপ শুল্ক ১ নয়া পয়সা হইতে বৃদ্ধি পাইয়া ১-০৫ নয়া পয়সা বা প্রত্যেক দুই ইউনিট শক্তি বা উহার ভগ্নাংশের জন্য ৩ নয়া পয়সা হইবে। এইভাবে গৃহকার্যে আগুন জ্বালানো, রান্না করা প্রভৃতির উদ্দেশ্যে শক্তি ব্যবহারের জন্য বিদ্যুত শুল্কের হার ইউনিট প্রতি এক নয়া পয়সাই বজায় থাকিবে, তবে শিল্প প্রভৃতিতে ব্যবহার্য বিদ্যুতের শুল্কের হার ইউনিট পিছু ১-০৫ নয়া পয়সার বৃদ্ধি করা হইবে। কুটির ও ক্ষুদ্র-শিল্প এবং ইলেকট্রোনিটিক পদ্ধতি অথবা বৈদ্যুতিক চুল্লি সমত শিল্পে ইউনিট প্রতি এখন যে ১/৩ নয়া পয়সার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয় তাহা অপরিবর্তিত থাকিবে।

শনিবার, ১৩ বৈশাখ, ১৩৭০ (৭ বৈশাখ ১৮৮৫ শক) SATURDAY, APRIL 27, 1963
• রোগীর মৃত্যুর পর এম্বুলেন্স: সময়মত এম্বুলেন্স না পাওয়ার দরুন কলেরা রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভবপর হয়নি। যখন এম্বুলেন্স পাওয়া গেল, তখন রোগী আর ইহজগতে নাই। শুক্রবার কলিকাতা কর্পোরেশনের সভায় নির্দলীয় সদস্য ডঃ কেপি ঘোষ ঐ মর্মে এক ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার সময় যাদবপুরের কোন একটি অঞ্চলের জনৈক কলেরা রোগীকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করিবার জন্য এম্বুলেন্স গাড়ীর অফিসে খবর দেওয়া হয়। কিন্তু শুক্রবার সকাল বেলায় ঐ এম্বুলেন্স রোগীর বাড়িতে যায়। ডঃ ঘোষ বলেন ততক্ষণে রোগীটির শেষকৃত্য সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। তিনি অভিযোগ করেন যে, অবিলম্বে এম্বুলেন্সের সংখ্যা বৃদ্ধি না করিলেবহু লোক ঐভাবে মৃত্যুর সন্মূখীন হইতে হইবে। ইহা ছাড়া এম্বুলেন্স গাড়ীর জন্য পূর্বে যে পরিমাণ পেট্রোল বরাদ্দ ছিল তাহাও নাকি সম্প্রতি কমাইয়া দেওয়া হইয়াছে বলিয়া তিনি অভিযোগ করেন।

• শহরতলীর বাস ভাড়া বৃদ্ধি: সম্প্রতি কলিকাতা ও চব্বিশ পরগণার বিভিন্ন বাস সমিতির প্রতিনিধিবর্গের এক সভায় বাসের ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত লওয়া হয়। ঐ সভার আহ্বায়ক শ্রীরবীন্দ্রলাল কুণ্ডু এক বিবৃতিতে ঐ সিদ্ধান্তের কথা জানাইয়া বলেন যে, বাসের ‘যত্ কিঞ্চিত’ ভাড়া বাড়ানো ছাড়া তাঁহাদের বাঁচার আর কোন উপায় নাই। পথকর, আয়কর, আবগারী শুল্ক যে ভাবে বর্ধিত হইয়াছে তাহা কল্পনাতীত। মোটর পার্টসের দামও বাড়িয়াছে। এই অবস্থায় ভাড়া কিছু বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে জনসাধারণের সহানুভূতি তাঁহারা পাইবেন আশা করেন। নিম্নলিখিত রুটগুলির ভাড়া বৃদ্ধি করা হইয়াছে, যথা:— ৭২,৭৩,৭৪,৭৫,৭৬, ৭৭,৭৮,৭৯,৮০,৮১,৮২,৮৩,৮৪,৮৫,৮৬,৮৭,৮৮,৮৯,৯০,৯১,৯২,৯৩,৯৫,৯৬,৯৭,৯৯,৩০,৩০এ,৩০সি ও ১২ ও ১২এ।

• স্বর্ণ রিফাইনারী বন্ধ: কলিকাতা স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ দপ্তর মহানগরীর স্বর্ণ রিফাইনারীগুলি বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। ফলে বৃহস্পতিবার হইতে রিফাইনারীগুলিতে পুরানো সোনা গলাইয়া পাকা সোনা তৈরী হইতছে না। কলিকাতায় অবস্থিত প্রায় ৩২টি রিফাইনারীকেই স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ দপ্তর হইতে জানান হইয়াছে যে, বৈদ্যুতিক শক্তির সাহায্যে চালিত রিফাইনারীগুলিকেই শুধু লাইসেন্স দেওয়া হইবে। যাহাদের বৈদ্যুতিক পাখা উনুনের অন্তর্গত শুধু তাহারাই ঐ পর্যায়ে পড়ে। ঐ রিফাইনারীগুলি বৈদ্যুতিক শক্তির সাহায্যে চালিত পর্যায়ে পড়ে না বলিয়া তাহাদের লাইসেন্স নামাঞ্জুর করা হইল। যদিও ঐ রিফাইনারীগুলি বৈদ্যুতিক পাখার সাহায্যেই কাজ চালান কিন্তু স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের মতে ঐ পাখা পৃথক করা হয়। সুতরাং কলিকাতার রিফাইনারীগুলি আর ব্যবসা চালাইতে পারিবেন না। স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ দপ্তর হইতে ২২শে এপ্রিল হইতে নির্দেশ জারী করা হইয়াছে। বৃহস্পতিবার রিফাইনারীর মালিকরা ঐ নির্দেশ পাইয়া মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়েন। স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ বিধি চালু হওয়ার আগে কোন কোন রিফাইনারীতে দৈনিক ৫০০ তোলা বা বেশী পাকা সোনা বাহির হইত। এই বিধির পরেও অনেক গহনার দোকানের মালিক এইসব রিফাইনারী মারফৎ সোনা বিশুদ্ধ করিতেন। বহুবাজারে এই ধরনের তিনটি রিফাইনারীর সব কয়টিই বৃহস্পতিবার বন্ধ দেখিলাম। বন্ধ দোকানের মধ্যে বৃদ্ধ মালিক তাঁহার খাতা দেখাইলেন—স্বর্ণ আইনের পরেও টুকটাক কাজ চলিয়াছিল। ‘এখন একেবারে বেকার হইলাম।’ এই নতুন নির্দেশের ফলে বৃহস্পতিবার বহুবাজারে গহনা দোকানের অনেক মালিকের মধ্যেই দারুন হতাশার সৃষ্টি হয়।

• ১৪ ক্যারেট সোনার গহনার প্রদর্শনীতে বিক্ষোভ প্রদর্শন: শুক্রবার বহুবাজারে একটি নামকরা গহনার দোকানে ১৪ ক্যারেট সোনার গহনার গহনার প্রদর্শনী উদ্বোধন করা হয়। একদল লোকের বিক্ষোভের ফলে পশ্চিমবঙ্গের অথর্মন্ত্রী শ্রীশঙ্করদাস ব্যানার্জি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করিতে পারেন নাই। পুলিস এ সম্পর্কে তিন জনকে গ্রেপ্তার করে। আমরা পুলিসের নিকট হইতে জানিতে পারিয়াছি তাহাদের কেহই স্বর্ণশিল্পী নন। গোলমালের সময় কিছু ইটপাটকেল বর্জিত হয়। বিকাল সাড়ে চারটার সময় অথর্মন্ত্রী শ্রীশঙ্করদাস ব্যানার্জির এই প্রদর্শনী উদ্ভোধন করার কথা ছিল। বিকাল ৪টার আগে হইতেই দোকানের সামনে ভিড় জমিতে সুরু করে। অথর্মন্ত্রীর গাড়ি আসার সময় ভিড়ের মধ্য হইতে কেহ কেহ স্লোগান দেন ‘১৪ ক্যারেট চলবে না’ ‘দোকান খোলা চলবে না।’
গোলমালের মধ্যে শ্রীব্যানার্জি গাড়ি হইতে না নামিয়া চলিয়া যান। পরে তিনি দোকানের কর্তৃপক্ষের নিকট একটি বাণী পাঠাইয়া তাঁহাদের উদ্যোগের প্রশংসা করেন। মুচিপাড়া থানা হইতে জানিতে পারি, বিকাল ৪-১০ মিনিটে তাঁহারা লালবাজার কন্ট্রোল হইতে সংবাদ পান যে, ঐ দোকানের সামনে ভিড় হইয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁহারা ঘটনাস্থলে যান। এক সময়ে তিনজন লোকের পিছু ধাওয়া করিয়া তাঁহারা পাশের গলি পর্যন্ত ছুটিয়া যান।

শুক্রবার কলিকাতার একটি বিখ্যাত গহনার দোকানে অনুষ্ঠিত
১৪-ক্যারেট সোনার গহনার প্রদর্শনীর সন্মুখে বিক্ষোভ।—আনন্দ-চিত্র।

কলিকাতার একটি বিখ্যাত গহনার দোকানে ১৪ ক্যারেট
সোনার গহনার প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়।—আনন্দ-চিত্র।

রবিবার, ১৪ বৈশাখ, ১৩৭০ (৮ বৈশাখ ১৮৮৫ শক) SUNDAY, APRIL 28, 1963
• ডিসেম্বর মাসে কলিকাতায় সবর্ভারতীয় মহিলা সম্নেলন: স্বামী বিবেকানন্দ শতবার্ষিক উত্সব উপলক্ষে এই বত্সরের ১৯শে ডিসেম্বর হইতে ২২শে ডিসেম্বর কলিকাতায় একটি সবর্ভারতীয় মহিলা সম্নেলন অনুষ্ঠিত হইবে। গোয়ালিয়রের মহারানী ইহার উদ্ভোধন করিবেন। এই মহিলা সম্নেলনের প্রস্তুতি উপলক্ষে শনিবার সন্ধ্যায় মহাবোধি সোসাইটি হলে এক ভক্ত মহিলা সম্নেলন হয়। লেডী ব্রেবোর্ন কলেজের অধ্যক্ষা ড: রমা চৌধুরী সভানেত্রীর আসন গ্রহণ করেন। বিভিন্ন বক্তা প্রস্তাবিত মহিলা সম্নেলনকে সাফল্যমণ্ডিত করিবার জন্য অকুন্ঠ অর্থ ও সামর্থ্য নিয়োগের জন্য নারীদের উদ্দেশে আবেদন জানান। মহিলা সাব-কমিটির সহকারী সম্পাদিকা শ্রীমতী সরস্বতী গৌরীশঙ্কর প্রস্তাবিত সম্নেলনের উদ্দেশ্য বিবৃত করেন। তিনি জানান, ইহাতে ভারতের সকল রাজ্য হইতে মহিলা প্রতিনিধিদের যোগ দিবার জন্য আমন্ত্রণ জানান হইয়াছে।
সম্নেলনে স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা ও আদর্শের পটভূমিকায় নারীসমাজের উপর ক্রমবধর্মান শিল্পায়নের প্রভাব এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা হইবে। দ্বিতীয় দিন শ্রীমতী লক্ষ্মী মেনন সভানেত্রীত্ব করিবেন। ডা: রমা চৌধুরীকে সভানেত্রী এবং প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণাকে সম্পাদিকা করিয়া একটি মহিলা সাব-কমিটি গঠিত হইয়াছে। এই উপলক্ষে যে অভ্যর্থনা সমিতি গঠিত হইয়াছে তাঁহাদের পক্ষ হইতে কলিকাতার মহিলাদের উদ্দেশে অধিক সংখ্যায় অভ্যর্থনা সমিতির সদস্যা হওয়ার জন্য আবেদন জানান হইয়াছে। সদস্যা হওয়ার ন্যুনতম ফী পঁচিশ টাকা। অধ্যাপিকা সান্ত্বনা দাশগুপ্ত স্বামীজীর উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাইয়া বলেন, ভারতের নারীসমাজের উপর তিনি বিপুল আস্থা প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার সাম্য দর্শনের তাত্পর্য হইল শ্রেণীহীন দেবমানব সমাজের প্রতিষ্ঠা।

স্বামী বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী উত্সব উপলক্ষে শনিবার মহাবোধি সোসাইটি হলে এক ভক্ত
সম্নেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্নেলনে নগরীর বহু বিশিষ্টা মহিলা যোগ দেন।—আনন্দ-চিত্র।

বুধবার, ১৭ বৈশাখ, ১৩৭০ (১১ বৈশাখ, ১৮৮৫ শক) WEDNESDAY, MAY 1, 1963
• কলিকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে জমির দাম গগনস্পর্শী: কলিকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে জমির দাম এবং বাড়ীর দাম গত এক বত্সরে শতকরা একশত ভাগেরও বেশী বাড়িয়া গিয়াছে। অবস্থা অনেক দিন আগেই মধ্যবিত্ত নাগরিকদের নাগালের বাহিরে চলিয়া গিয়াছিল। অবিলম্বে হস্তক্ষেপ না করিলে অচিরকালের মধ্যেই সরকারেরও আয়ত্তাতাঁত হইয়া যাইবে বলিয়া সংশ্লিষ্ট মহল উত্কন্ঠা বোধ করিতেছেন। দেশ বিভাগের পর হইতেই কলিকাতার জমি এবং বাড়ির দাম চড়িতে শুরু করে। ১৯৫৫-৫৬ সনের পর দামের এই ঊর্ধুগতি দুত্রতর হয়। গত এক বছরে এই দাম আকাশ ছোঁয়া হইয়াছে। অবশেষে স্বর্ণনিয়ন্ত্রন বিধি চালু হইবার পর জমির দাম বর্তমানে সম্পূর্ণ বল্গাহীন। কলিকাতার ব্যস্ততর এলাকায় কাঠা প্রতি জমির দাম অনেক আগেই লক্ষের কোঠা ছাড়ইয়াছে। কিন্তু দক্ষিন কলকাতায় গত বত্সরেও যে জমি দশ হাজার টাকায় বিকাইয়াছে বর্তমানে সে জমি বিশ হাজার টাকায়ও দুষ্প্রাপ্য। এমনকি গোবরা, বদিয়াডাঙ্গা, তিলজলা, বেলিয়াঘাটা অঞ্চলেও বর্তমানে কাঠা প্রতি আট হাজার টাকার কমে জমি পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু কলিকাতার উপকন্ঠের কয়েকটি তথাকথিত অভিজাত পাড়া ইহার উপরেও টেক্কা মারিয়াছে। যোথপুরপার্ক নাম ধারন করিয়া জাতে উঠিবার পরেও এককালের গোবিন্দপুরে এক হাজার হইতে দুই হাজার টাকায় এক কাঠা জমি সহজেই পাওয়া গিয়াছে। বর্তমানে সেখানে কাঠা প্রতি জমির নিন্মতম দাম পনেরো হাজার। উপরে স্হানীয় একজন অধিবাসীই জানাইলেন, ‘যার ছুড়িতে যত ধার!’

বৃহস্পতিবার, ১৮ বৈশাখ, ১৩৭০ THURSDAY, MAY 2, 1963
• রাজপথ দিয়া হাঁটিলে আদালতে যাইতে হইবে: আগামী ১০ ই মে হইতে ডালহৌসী ও চৌরঙ্গী এলাকার কোন পথচারী ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করিলে তাহাকে আদালতে অভিযুক্ত করা হইবে। এই আইনভঙ্গের শাস্তি পাঁচ টাকা হইতে পাঁচশত টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড। এ সম্পর্কে কলিকাতা ট্রাফিক পুলিশের জনৈক মুখপাত্র বলেন, দেখা গিয়াছে কলিকাতার শতকরা ৭০ ভাগ পথ-দুর্ঘটনার কারণ পথচারীদের যত্রতত্র রাস্তা পার হওয়ার অভ্যাস। ১৯৫৮ সালের কলিকাতা পুলিশ আইনের ৯২ বি ধারায় ইহা দন্ডনিয় অপরাধ বলিয়া গন্য করা হইয়াছিল। কিন্তু সেই আইন প্রয়োগ হয় নাই। ১০ই মে হইতে পরীক্ষামূলকভাবে এই আইনের প্রয়োগ হইবে।
এই আইন অনুসারে কলিকাতার পথচারীর পক্ষে এখন নিন্মলিখিত বিষয়গুলি দন্তনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে।
(ক) ফুটপাথ ছাড়া রাজপথ দিয়া হাঁটা।
(খ) যখন সবুজ আলো জ্বলিবে তখন রাস্তা পার হওয়া।
(গ) চিহ্নিত স্থানগুলি ছাড়া রাস্তা পারাপারের চেষ্টা করা।
বর্তমানে বিবেকানন্দ রোড হইতে মিশন রো পর্যন্ত, চিত্তরঞ্জন এভিন্যু, লোয়ার সার্কুলার রোড পর্যন্ত ও ডালহৌসী স্কোয়ার এলাকার এই আইন কার্যকরী হইবে।

শনিবার, ২০ বৈশাখ, ১৩৭০ (১৪ বৈশাখ, ১৮৮৫ শক)
• কলিকাতা ও চারটি জেলায় কলেরা মহামারী: কলিকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের আরও ৪টি জেলায় কলেরার প্রকোপ কিছুতেই কমিতেছে না দেখিয়া রাজ্য সরকার বিশেষ উদ্বেগ বোধ করিতেছেন। শুক্রবার মহাকরণে অফিসার পর্যায়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে কলেরা প্রতিরোধ ব্যবস্থা যথাসব্ভব জোরদার করিবার ব্যবস্থা লওয়া হয়। এজন্য স্বাস্থ্য বিভাগীয় সংশ্লিষ্ট সকল কর্মচারীগে কতগুলি জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হইতেছে। কলিকাতা ছাড়া মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, চব্বিশ পরগণা ও হাওড়া জেলায় কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়াছে। স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী উভয়প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার উপরেই গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে। স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থা হিসেবে পরিস্রুত জলের সরবরাহ বৃদ্ধি, অপরিশ্রুত মল ক্লোরিন দ্বারা পরিশুদ্ধকরণের ব্যবস্থা এবং সরকারী টীকাদার, ডাক্তার, ছাত্র প্রভৃতির সাহায্যে টীকাদান ব্যবস্থাকে আরও ব্যাপক করিবার সিদ্ধান্ত হয়। ইহা ছাড়া যেসব এলাকায় এখনও রোগ ছড়ায় নাই সে সব এলাকায় কড়াকড়িভাবে রোধ প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হইতেছে। দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা হিসেবে কলিকাতার পরিশুদ্ধ জল সরবরাহের পরিমান ৯ কোটি গ্যালন হইতে বাড়াইয়া ১৫ কোটি গ্যালন করিবার একটি পরিকল্পনার জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ হইতে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট পক্ষে লেখা হইয়াছে। ঐ পরিকল্পনা কার্যকরী করিবার ব্যাপারে ২৫ লক্ষ টাকার বিদেশী মুদ্রার প্রয়োজন হইবে বলিয়া প্রকাশ। বর্তমানে ঐ পরিকল্পনাটি কেন্দ্রীয় সরকারের বিবেচনাধীন রহিয়াছে।

সোমবার, ২২ বৈশাখ, ১৩৭০ MONDAY, MAY 6, 1963
• দশ হাজার টাকায় একখানা শাড়ী: একটি শাড়ীর দাম কত? পাঁচশ, হাজার, দেড় হাজার! না, তারও অনেক বেশী— দশ হাজার! এই বালুচর শাড়ীটি নিলামে কিনিয়াছেন একজন বাঙালী ব্যবসায়ী। কিছুদিন আগে রাজ্যপাল শ্রীমতী নাইডু জাতীয় প্রতিরক্ষা তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহের নিমিত্ত বাংলার বিভিন্ন শহর ও গ্রাম সফর করেন। বাঁকুড়া গেলে বিষ্ণুপুর (বাঁকুড়া) সিল্ক খাদি সেবা মণ্ডলের পক্ষ হইতে প্রাচীন বস্ত্র শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই বালুচর শাড়ীটি তাঁহাকে অর্পণ করা হয়।

রবিবার রাজভবনে প্রতিরক্ষা তহবিলে অর্থ সংগ্রহের জন্য এই
বালুচর শাড়ীটি নীলামে দশ হাজার টাকায় বিক্রয় হয়। —আনন্দ-চিত্র।

রবিবার রাজভবনের মার্বেল হলে ঐ শাড়ী এবং অন্যান্য বহুবিধ দ্রব্যের নিলাম-বিক্রয়ের ব্যবস্থা হয়। মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন এই নিলাম-বিক্রয় পরিচালনা করেন। শাড়ীটির জন্য প্রথম ডাক উঠে দুই হাজার টাকা। শেষে উহা ক্রয়ের জন্য দস্তুরমত প্রতিযোগিতা পড়িয়া যায়। দাম বাড়িতে বাড়িতে ঊর্দ্ধে দশ হাজার পর্যন্ত উঠে। বালুচর শাড়ীটি ক্রয় করেন শ্রীবৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য।

বুধবার, ২৪ বৈশাখ, ১৩৭০ WEDNESDAY, MAY 8, 1963
• আনন্দবাজার পত্রিকার আপীল মঞ্জুর: সুপ্রীম কোর্ট আজ কলিকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা (প্রাইভেট) লিমিটেড-এর একটি আপীল মঞ্জুর করেন এবং পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় শ্রম আদালত ঐ কোম্পানীর একজন কর্মচারীকে পুনরায় নিয়োগ করা হউক বলিয়া যে রায় দিয়াছিলেন তাহা বাতিল করিয়া দেন। আনন্দবাজার পত্রিকার চীফ রিপোর্টার শ্রীশিবদাস ভট্টাচার্য ছুটি নেন। তাহার অনুপস্থিতির সময় শ্রী ভট্টাচার্য তাহার স্থলে ১৯৫৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর হইতে কাজ করিবার জন্য শ্রীমধুসূদন চক্রবর্তীকে মনোনীত করেন। রিপোর্টার শ্রীপুলকেশ দে সরকার এই ব্যবস্থায় আপত্তি জানান। তিনি ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে জানান যে, তিনি এই ‘ভেজাল চিঠি’ মানিয়া লইবেন না এবং নিজের অধিকার ও উত্কর্ষের উপর ভিত্তি করিয়া তিনি তাহার কাজ নিজেই স্থির করিবেন। অস্থায়ী চীফ রিপোর্টার শ্রী সরকারের জন্য যে কাজ নির্দিষ্ট করেন শ্রী সরকার তাহা করেন না। শ্রী সরকারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়, তিনি ইচ্ছা করিয়া নির্দেশ অমান্য করিতেছেন। হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদক এই সম্পর্কে তদন্ত করার পর শ্রী সরকারের চাকুরীর অবসান ঘটান হয়। বিরোধীয় বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় শ্রম আদালতে পেশ করা হইলে আদালত এই মর্মে রায় দেয় যে, শ্রী ভট্টাচার্যের শ্রী চক্রবর্তীকে অস্থায়ী চীফ রিপোর্টার পদে নিয়োগ করার কোন ক্ষমতা ছিল না সুতরাং আদালত শ্রী সরকারকে পুনরায় কর্মে নিয়োগ করার নির্দেশ দেন।

বৃহস্পতিবার, ২৫ বৈশাখ, ১৩৭০ THURSDAY, MAY 9, 1963
• রেডক্রশ শতবার্ষিক পূর্তি উত্সব: বুধবার কলিকাতায় রেডক্রশ শতবার্ষিক পূর্তি উত্সব পালন করা হয়। এই উপলক্ষে প্রেরিত এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ এইরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, ‘‘গত একশত বত্সরে যেখানেই মানুষ কষ্টের মধ্যে পড়িয়াছে— তাহা মনুষ্যজনিত অথবা প্রাকৃতিক বা যে কোন কারণেই হউক না কেন— আন্তর্জাতিক রেডক্রশ দুর্গত মানুষের ত্রাণকার্যে আগাইয়া আসিয়াছে। এই মহত্ মানবিক দায়িত্ব পালনের সময় রেডক্রশ জাতি, ধর্ম ও রাজনীতির ঊর্দ্ধে থাকিয়াছে। সন্দেহ, লোভ ও হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে রেডক্রশ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্বের একটি মহান দৃষ্টান্ত।’’ রাষ্ট্রপতি আরও বলেন যে, ভারত সরকার আন্তর্জাতিক রেডক্রশের আদর্শে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। জেনেভা কনভেনশনে স্বীকৃত দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর আন্তর্জাতিক নীতিতে তাঁহার আস্থা অবিচলিত।’’ এই দিন কলিকাতায় রেডক্রশের পশ্চিমবঙ্গের কেন্দ্রীয় অফিসে এক অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী শ্রীতরুণকান্তি ঘোষ বলেন যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ বৈষম্যের, ঊর্দ্ধে মানবসেবার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত হইয়া রেডক্রশ অগ্রসর হইতেছে।

শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ, ১৩৭০ (২০ বৈশাখ, ১৮৮৫ শক) FRIDAY, MAY 10, 1963
• আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা ভাষা চালু, মুখ্যমন্ত্রী শ্রীসেনের আনন্দ প্রকাশ: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ জন্মদিন ২৫শে বৈশাখ বৃহস্পতিবার হইতে পশ্চিমবঙ্গের সরকারী কাজকর্মে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা ভাষা চালু করা হয়। কবিগুরুর জন্মদিবস উপলক্ষে এইদিন রাজ্য সরকারের অফিসগুলি ছুটি ছিল। তত্সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন পূর্বাহ্নে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে যান এবং সেখানে প্রায় তিন ঘন্টাকাল সরকারী নথিপত্র দেখেন। শ্রী সেন উহাদের কোন কোনটিতে বাংলা ভাষার নির্দেশ মন্তব্যাদি লিপিবদ্ধ করেন ও স্বাক্ষর করেন। এইভাবে রাজ্য সরকারের কাজকর্মে এইদিন হইতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা ভাষা চালু হয়।
সকালের দিকে তাঁহার বাসভবনেও তিনি বিভিন্ন নথিপত্রে বাংলাভাষায় নির্দেশ ইত্যাদি দেন ও সহি করেন। এইদিন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী সেন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিনিধির নিকট এক বিবৃতিতে বলেন, কবিগুরুর শুভ জন্মদিনে এই রাজ্যের প্রশাসনিক কাজকর্মে তাঁহারা যে বাংলা ভাষার মাধ্যম ব্যবহারের সূচনা করিয়া কবিগুরুর স্বপ্ন ও সাধনাকে একটা রূপ দিতে পারিয়াছেন সেজন্য তাঁহারা গৌরবান্বিত বোধ করিতেছেন। তিনি আরও বলেন. ‘‘আমরা যে সরকারী কাজ-কর্মে বাংলা ভাষার মর্যাদা দিতে পারিতেছি তজ্জন্য আমি আনন্দিত।’’

শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ, ১৩৭০ (২০ বৈশাখ, ১৮৮৫ শক) FRIDAY, MAY 10, 1963

—গানের বাকীটা আর একদিন শোনাব।
অনেক জায়গায় বায়না নিয়েছি...
• মহানগরী কলিকাতায় কবিগুরুর শুভ জন্মদিবস উদযাপন: পঁচিশে বৈশাখ, বৃহস্পতিবার। রবীন্দ্রনাথের ১০২তম এই ‘চির-নূতন’ জন্মদিনটিতে মহানগরী কলিকাতা বিভিন্ন উপচারে কবি-প্রণাম জানায়। এইদিনেই সাম্বাত্সরিক কবিপক্ষের শুরু এবং এবারের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের সরকারী কাজে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি। কবির জন্মে পূত ও কর্মে চিহ্নিত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি এইদিন তীর্থমন্দিরের রূপ লয়। সেখানে সকাল হইতে অধিক রাত্র পর্যন্ত তীর্থযাত্রীদের আনাগোনার বিরাম ছিল না। সকাল আটটায় রবীন্দ্রভারতীতে ছিল বিশেষ অনুষ্ঠান। নিখিল ভারত রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলন, রবীন্দ্রমেলা, বৈতানিক, সুরঙ্গমা প্রভৃতি অন্যান্য বহু প্রতিষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক সংস্থাও গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার মতো রবীন্দ্র কবিতা ও রবীন্দ্র সঙ্গীত দিয়া শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। রবীন্দ্র কাননে রবীন্দ্রমেলা কর্তৃক আয়োজিত শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্বলিত এক মেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি শ্রীঅতুল্য ঘোষ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। দ্বাদশদিনব্যাপী উত্সবের উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন। উদ্বোধনী ভাষণে শ্রীসেন বলেন, কবি রবীন্দ্রনাথ সকলের আপন লোক হইতে চাহিয়াছিলেন। এই মেলায় তাঁর সে-ইচ্ছাই রূপ-পরিগ্রহ করিয়াছে।

• নাট্যানুষ্ঠান বিলের প্রতিবাদে সত্যজিত্ রায় ও মন্মথ রায়ের বিবৃতি: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রস্তাবিত নাট্যানুষ্ঠান বিল বিভিন্ন মহলে বিতর্কের সৃষ্টি করিয়াছে। শ্রীসত্যজিত্ রায় এক বিবৃতিতে বলেন, এই বিল আইনে পরিণত হইলে পেশাদারী ও অপেশাদারী অভিনয় প্রচেষ্টার পথে বাধার সৃষ্টি করিবে। তাঁহার মতে য়ে-কোন শিক্ষিত লোকের কর্তব্য এই বিল প্রতিরোধ করা। পশ্চিমবঙ্গ নাট্যকার সংঘের সভাপতি শ্রীমন্মথ রায় আর একটি বিবৃতিতে বলেন, এই বিলে পুলিস ও জেলাশাসকদের হাতে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে শেক্সপীয়ার হইতে শুরু করিয়া মাইকেল, দীনবন্ধু, গিরিশ, দ্বিজেন্দ্রলাল এবং রবীন্দ্র পরবর্তী নাট্যকারদের সকল নাটক অভিনয়ের ভাগ্য এবং হরণ করা হইয়াছে যাত্রাদল হইতে শুরু করিয়া প্রতিটি পেশাদার ও অপেশাদার নাট্যসংস্থার অভিনয় অধিকার। তাঁহার মতে কিছু অবাঞ্ছিত নাট্যাভিনয় দমন করিতে গিয়া সরকার দেশের নাট্যলক্ষ্মীকেই হনন করিতে উদ্যত হইয়াছেন।

রবিবার, ২৮ বৈশাখ, ১৩৭০ SUNDAY, MAY 12, 1963
• কলিকাতায় চক্ষু ব্যাঙ্ক স্থাপনের প্রস্তাব: মৃতব্যক্তির চক্ষুর অচ্ছোদপটল (কার্নিয়া) জমা রাখার জন্য কলিকাতার চক্ষু-ব্যাঙ্ক স্থাপনের প্রস্তাব হইয়াছে। ইতিপূর্বে চক্ষুরোগের ক্ষেত্রে শল্য চিকিত্সার জন্য বিদেশ হইতে ‘কার্নিয়া’ আমদানি করার ঘটনাও ঘটিয়াছে। ঐ বিষয়ে সরকারী পরিকল্পনার মোটামুটি উদ্দেশ্য এই: যেসব ব্যক্তি মৃত্যুর তাঁহাদের অচ্ছোদপটল দান করিয়া যাইবেন মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ঐগুলি তুলিয়া লইয়া ব্যাঙ্কে জমা রাখা হইবে। জন্মান্ধ অথবা কার্নিয়ার ব্যধিগ্রস্থদের চোখে অস্ত্রোপচার করিয়া ঐ ‘সুস্থ কার্নিয়া’ জুড়িয়া দিলে তাঁহারা দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়া পাইবেন, এমন সম্ভাবনা থাকে। শুক্রবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে ঐরূপ ‘কার্নিয়া গ্রাফটিং’ ব্যবস্থাকে আইনসিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে এক বিল আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আইনসঙ্গত অধিকার স্থাপিত হইলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঐ ব্যাপারে হাসপাতাল স্থাপন ও শিক্ষণ ইত্যাদির ব্যবস্থা করিতে পারবেন। ইতিমধ্যেই মহারাষ্ট্র, মাদ্রাজ ও বিহারে উহা আইনসিদ্ধ হইয়াছে। সরকারী এক মুখপাত্র বলেন, আইনের অনুমতি না থাকিলে শুধু কোন সহৃদয় ব্যক্তির সম্মতিতে মৃত্যুর পর তাঁহার ‘কার্নিয়া’ তুলিয়া লওয়ার হাঙ্গামার আশঙ্কা থাকে। তাই আইনের উদ্যোগ হইতেছে।

মঙ্গলবার, ৩০ বৈশাখ, ১৩৭০ (২৪ বৈশাখ ১৮৮৫ শকাব্দ) TUESDAY, MAY 14, 1963
• পরলোকে শ্রীসুকুমার সেন: ভারত সরকারের ভূতপূর্ব নির্বাচন কমিশনের এবং দন্ডকারণ্য উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান শ্রীসুকুমার সেন সোমবার অপরাঙ্ন তিন ঘটিকা নাগাদ কলিকাতায় পরলোকগমন করেন। তাঁহার মৃত্যুতে একজন অতি সুযোগ্য ও সত্ প্রশাসনিক অফিসারের অভাব ঘটিল। দন্ডকারণ্যের উদ্বাস্তুগণও একজন দরদী শুভানুধ্যায়ীকে হারাইলেন। গত মার্চের শেষ ভাগে তিনি সামান্য অসুস্থ হইয়া পড়েন। যথাসাধ্য তাঁহার চিকিত্সা করা হয়। কিন্তু সঠিক রোগ কিছু ধরা পড়ে নাই। অকস্মাত্ সোমবার দুপুরের দিকে তাহার দ্রুত অবনতি ঘটে এবং তিনটার সময় লোক গার্ডেনসে তাঁহার ভ্রাতা ডাঃ অমিয়কুমার সেনের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে শ্রীসেনের বয়স ৬৩ বত্সর হইয়াছিল। তিনি সহধর্মিণী শ্রীমতি গৌরি সেন, দুই পুত্র— শ্রীদীপক সেন, বার-এট-ল ও রাহুল সেন, দুই কন্যা শ্রীমতি জয়ন্তী সেন ও শ্রীমতি পূরবী ওয়ার্ড এবং বহু আত্মীয়স্বজন রাখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার অন্যতম ভ্রাতা শ্রীঅশোককুমার সেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী। শ্রী সেনের মৃত্যু সংবাদে কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি মহলে গভীর শোকের ছায়াপাত হল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন ও অন্যান্য মন্ত্রীগণ এবং অনেত পদস্থ অফিসার ও বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি লেক গার্ডেনস্থ বাসভবনে যান এবং মৃতের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন।

বুধবার, ৩১ বৈশাখ, ১৩৭০ (২৫ বৈশাখ ১৮৮৫ শকাব্দ) WEDNESDAY, MAY 15, 1963
• মুখ্যমন্ত্রী কর্তৃক মোহনবাগান ক্লাবের নতুন তাঁবুর ভিত্তি স্থাপন: শুচিশুভ্র পরিবেশ এবং মাঙ্গলিক সানাইয়ের সুরের মধ্যে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন মঙ্গলবার অপরাহ্নে কলকাতা ময়দানে মোহনবাগান ক্লাবের নতুন তাঁবুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। ইডেন উদ্যানের দক্ষিণে এবং কিংসওয়ে সংলগ্ন অঙ্গনে নতুন ক্লাব গৃহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন মোহনবাগান ক্লাব ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। সুদীর্ঘ ৭৪ বছর আগে উত্তর কলকাতার ফড়েপুকুর ও আপার সার্কুলার রোডের সংগমস্থলে পরলোকগত কীর্তি মিত্রের অক্ষয়কার্তি প্রাসাদোপম অট্টালিকা মোহনবাগান ভিলার মাঠে যে ক্লাবের প্রথম অঙ্কুর উদ্গম হয়েছিল—দু’বছর পরে পরলোকগত মহারাজা দুর্গাচরণ লাহার শ্যামপুকুর মাঠে (বর্তমানে শ্যাম স্কোয়ার) যে ক্লাবের শৈশব কেটেছে—১৯০০ সাল থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত ময়দানের প্রেসিডেন্সি মাঠে (বর্তমান বঙ্গবাসী ও আশুতোষ কলেজের মাঠ) যে ক্লাবের কৈশোর উত্থাপন করেছে—১৯১৬ সাল থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের দিকের মাঠে যে ক্লাবের সুমহান ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, খেলোয়াড়দের ক্রীড়াচ্ছটার উজ্জবল আলোকে উদ্দীপ্ত হয়েছে ভারতীয় ক্রীড়াক্ষেত্র, আজ সেই ক্লাব নতুন অঙ্গনে এসেছে নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে।

পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন কর্তৃক স্থাপিত
মোহনবাগান ক্লাবের নতুন তাঁবুর ভিত্তিপ্রস্তর। —আনন্দ চিত্র।
বাংলার পরলোকগত মুখ্যমন্ত্রী পুরুষসিংহ ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, ১৯১১ সালে গোলপোস্টের পিছনে দাঁড়িয়ে আই এফ এ শিল্ডের ঐতিহাসিক ফাইনাল খেলায় মোহনবাগানের জয়ের মধ্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ দেখেছিলেন—আজকের জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন, মোহনবাগান তাঁবুর ভিত্তি-স্থাপন করতে এসে খেলাধূলার ক্ষেত্রে দেখেছেন আগামী দিনের নতুন আলো।

• কলিকাতায় কলেরার দাপট, গত সপ্তাহে দুইশত জনের প্রাণহানি: মহানগরীতে কলেরার দাপট সমানেই চলিয়াছে। গত সপ্তাহে দুইশতজনের গত সপ্তাহে দুইশতজন কলেরা রোগে মারা যায়। এ বছর একটি কলেরা রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ইহাই সর্বাধিক। ঐ সপ্তাহে ৬২০ জন কলেরা রোগাক্রান্ত হয় বলিয়া প্রকাশ। ইহার আগের সপ্তাহে (২রা মে) ৫৭১ জন কলেরা রোগাক্রান্ত হয় এবং ঐ সময়ের মধ্যে ১৩৬ জন মারা যায়। এদিকে কলেরা রোগীর ক্রমবর্ধমান চাপে বেলেঘাটার সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হিমসিম খাইতেছেন।
সঙ্কট কিছুটা লাঘবের জন্য রাজ্য সরকার ঐ হাসপাতালে দুইশত নতুন শয্যার ব্যবস্থা করিয়াছেন। ইহা লইয়া ঐ হাসপাতালে কলেরা ওয়ার্ডে শয্যাসংখ্যা দীঁড়াইল নয়শত। ইহা ছাড়া সরকার ঐ হাসপাতালে ২৫ জন নতুন নার্স এবং চারজন অতিরিক্ত ডাক্তারও পাঠাইয়াছেন।

বৃহস্পতিবার, ১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭০ (২৬ বৈশাখ ১৮৮৫ শকাব্দ) THURSDAY, MAY 16, 1963
• বিমান বন্দর সম্প্রসারণার্থ ক্রীত জমি দখলকারীদের কবল হইতে উদ্ধার: দমদম বিমান বন্দর সম্প্রসারণের জন্য বহুদিন হইল গৌরীপুরে যে জমি কিনিয়া রাখা হইয়াছিল বুধবার দুপুরে দুইটি বুলডোজার ও এক বিপুল সংখ্যক পুলিশবাহিনী দখলকারীদের উচ্ছেদ করিয়া সে জমি উদ্ধার করিয়াছে। সরকারি সূত্রে প্রকাশ, দমদম সন্নিহিত গৌরীপুর এলাকায় সুবিস্তৃত এক ভূমিখণ্ড কিনিয়া লওয়া হইবে বলিয়া আগেই স্থানীয় অধিবাসীদের জানাইয়া দিয়াছিলেন। ১৯৬২ সনের গোড়ার দিকে জমি এবং সম্পত্তির জরীপ আর মূল্য নির্ধারণের কাজও সমাধা হয়। ঐ বত্সর মার্চ মাসের মধ্যে সরকার জমির মালিকদের ৩২ লক্ষ টাকাও দিয়াছেন। তারপর জমি খালি করিয়া দিবার জন্য সরকার একাধিক নোটিশ দিয়াছেন। কিন্তু কাজ হয় নাই।
জবরদখলকারীদের উচ্ছেদের কাজ সম্পন্ন বুধবার দমদম বিমান বন্দরের কর্তৃপক্ষ
পুলিশের সহায়তায় তাঁহাদের জমির দখল লইতেছেন। —আনন্দ চিত্র।
অতএব বুধবার দুপুরে এই সাজোয়া অভিযান। আজ, বৃহস্পতিবার গৌরীপুরে চালের হাট বসিবার কথা। কিন্তু বসিবে কোথায়? বুধবার সেখানে উপস্থিত হইয়া দেখিতে পাই বুলডোজারের প্রতাপে হাটের সব চালাঘর তাসের বাড়ির মতো ধবসিয়া পড়িতেছে। আগে হইতে সরকারি কঠোর মনোভাবের সংবাদ পাইয়া যে সকল ব্যবসায়ী নিজেদের জিনিসপত্র সরাইয়া ফেলিয়াছিলেন তাঁহারা অনেকে ঝামেলার হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইয়াছেন। দুই চারিজনক শেষ মুহূর্তে জিনিসপত্র সামলাইবার জন্য বেসামাল হইতে দেখা যায়।

শুক্রবার, ২ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭০ (২৭ বৈশাখ ১৮৮৫ শকাব্দ) FRIDAY, MAY 17, 1963
• ডাক্তার বি সি রায় শিশু হাসপাতালের জন্য জমি স্মৃতি সমিতির নিকট অর্পণ: বৃহস্পতিবার ১১১, নারিকেলডাঙ্গা মেন রোডে এক অনুষ্ঠানে মাল্যভূষিত ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের একখানি আবক্ষ প্রতিকৃতির সম্মুখে মঙ্গলশঙ্খধবনির মধ্যে ডাক্তার বি সি রায় শিশু হাসপাতালের জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ হইতে প্রায় ২০ বিঘা জমি ডাঃ বি সি রায় স্মৃতি সমিতির পক্ষ হাতে অর্পণ করা হয়। সমিতির সভাপতি শ্রীতুষারকান্তি ঘোষ মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেনের হাত হইতে অর্পণপত্র গ্রহণ করেন। জমির মূল্য ২ হইতে ১৫ লক্ষ টাকার মত বলিয়া জানানো হয়। আগামী পয়লা জুলাই প্রস্তাবিত হাসপাতালের ভিত্তিপ্র্তর স্থাপন করিবেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীজওহকলাল নেহরু। প্রারম্ভে সমিতির সম্পাদক শ্রীঅতুল্য ঘোষ জানান য, সম্ৃতি তহবিলে এ পর্যন্ত মোট ৪৮ লক্ষ টাকা সংগৃহীত হইয়াছে। তিনি এই আশা প্রকাশ করেন যে, শীঘ্রই তাঁহারা অর্থপরিমাণ ৫০ লক্ষ টাকায় দাঁড় করাইতে পারিবেন। শ্রীঘোষ জানান যে, সর্তানুসারে এই জমিতে হাসপাতালের জন্য বাড়ী নির্মাণের পর রাজ্য সরকারের হাতে জমি ও হাসপাতাল বাড়ী প্রত্যর্পণ করা হইবে। হাসপাতাল সংলগ্ন জমিতে পাঠাগার ও শিশু উদ্যান নির্মাণেরও প্রস্তাব আছে। মূখ্যমন্ত্রী শ্রীসেন বলেন যে, ১৫ লক্ষ টাকা মূল্যের জমি দিয়া তাঁহারা পুণরায় কমিটির নিকট হইতে ৬০/৬৫ লক্ষ টাকার জমি সহ ঘরবাড়ী ফেরত্ পাইবেন।

শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭০ (২৮ বৈশাখ ১৮৮৫ শকাব্দ) FRIDAY, MAY 18, 1963
• বাড়িভাড়ার বাড়াবাড়ি: ১৯৪২ সনের সেপ্টেম্বর মাসের কয়েকটি বিজ্ঞাপনঃ আলিপুরে ১৪/এ, রাজা সন্তোষ রোডে তিন ঘর ফ্লাট। বারান্দা, বড় বাগান, টেনিস লন। মাসিক ভাড়া ২৪০ টাকা। ২২ ল্যান্সডাউন রোডে পাঁচখানা বড় ঘরের ফ্লাট। প্রচুর আলো-হাওয়া। গ্যারাজ। ভাড়া ১৪০ টাকা। ১০, সুবারবন স্কুল রোডে প্রচুর আলো-হাওয়াযুক্ত তিনতলা বাড়ি। ভাড়া ১৪০ টাকা। আট বছর পরে ১৯৫০ সনের মে মাসের কয়েকটিঃ জগুবাবুর বাজারের নিকট ৪টি বড় ঘরের ফ্লাট। গ্যারাজ। ভাড়া ২২৫ টাকা। শোভাবাজারে দুইখানা ঘর। স্বতন্ত্র জলকল। ভাড়া ১২০ টাকা। আলিপুরে চারঘরের আধুনিক ফ্লাট। ভাড়া ৬৫০ টাকা। আর বর্তমান পরিস্থিতিঃ গিরীশ পার্কের কাছে দক্ষিণ খোলা ৩টি শয়নকক্ষের ফ্লাট। ভাড়া ৬০০-৭০০ টাকা। বালিগঞ্জ প্লেস বন্ডেল রোড মোড়ে তিন ঘরের ফ্লাট। দক্ষিণ ও পূর্ব খোলা। ভাড়া ৩০০ টাকা। নিউ আলিপুরে ‘ও. ব্লকে দোতলায় তিন কোঠার ফ্লাট। সংলগ্ন বাথরুম। ডাইনিং হল। গ্যারাজ। ভাড়া ৬০০ টাকা। গত কুড়ি বছরে কলিকাতার বাড়ীভাড়া কি হারে বাড়িয়াছে তাহার কোনও নির্ভরযোগ্য হিসাব নাই। উদ্ধৃত বিজ্ঞাপনগুলি হইতে কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় মাত্র—কিন্তু পাকাপাকি কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছান সম্ভব নহে। এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। কেহ বলেন বৃদ্ধির হার শতকরা ৩০০ ভাগ, কাহারও বা অভিমত কম করিয়াও ৪০০ ভাগ।


জনারণ্য। আচার্য্য বিনোবা ভাবের সভায় জনতার ভিড়। — আনন্দ চিত্র।

• ইস্ট বেঙ্গল অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন: শুক্রবার ক্যালকাটা-মোহনবাগান মাঠে হকি লীগের শেষ খেলা এবং চ্যাম্পিয়নশিপ মীমাংসার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ১-০ গোলে গতবারের লীগ বিজয়ী মোহনবাগান ক্লাবকে পরাজিত করিয়া অপরাজিত থাকিবার কৃতিত্ব-সহ তৃতীয়বার লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ লাভের গৌরব অর্জন করিয়াছে। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ইস্টবেঙ্গলের সহিত শেষ মরশুমের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মোহনবাগান ক্লাব আদৌ তাহাদের খ্যাতি অনুযায়ী খেলিতে পারে নাই এবং চমত্কার যোগাযোগপূর্ণ ক্রীড়াধারার মাধ্যমে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব যোগ্য দল হিসাবেই বিজয়ীর সম্মান অর্জন করিয়াছে। মোহনবাগান ভাল খেলিতে পারে নাই বলিলে খেলার অবস্থার যথাযথ পরিচয় দেওয়া হয় না—বলা উচিত মোহনবাগানের খেলায় প্রাণের সাড়া মেলে নাই। প্রতিপক্ষের ক্ষিপ্র গতিবেগের নিকট মোহনবাগানের স্লথ গতিও দুই দলের ক্রীড়াধারায় পার্থক্যের কারণ। অপরদিকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব হয়তো পূর্ব দিনের বেটন ফাইনালের পরাজয়ের কথা স্মরণে রাখিয়া সূচনা হইয়া অনমনীয় দৃঢ়তা এবং জয়লাভের উগ্র বাসনা লইয়া খেলা আরম্ভ করে এবং উন্নত ক্রীড়ধারায় দর্শক মনে ছাপ আঁকিতে সক্ষম হয়। খেলার ধারা অনুযায়ী ইস্টবেঙ্গলের একাধিক গোলে জয়লাভ করা উচিত ছিল, কিন্তু প্রতিপক্ষ গোলরক্ষক থাপার দৃঢ়তা এবং পুরোভাগের খেলোয়াড়দের লক্ষ্য ভ্রষ্টতার জন্য একটির বেশী গোল হয় নাই।

রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭০ (২৯ বৈশাখ ১৮৮৫ শকাব্দ) SUNDAY, MAY 19, 1963
• পৃথক এমার্জেন্সী হাসপাতাল স্থাপনের পরিকল্পনা: আকস্মিক রোগের চিকিত্সার উদ্দেশ্যে কলিকাতায় সম্পূর্ণ পৃথক একটি এমার্জেন্সী হাসপাতাল স্থাপনের পরিকল্পনা হইয়াছে। শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল কিংবা শেঠ সুখলাল কারনানী হাসপাতাল প্রাঙ্গণে উহার জন্য বহুতলবিশিষ্ট গৃহ নির্মাণের কথা আছে। শনিবার রাজ্যের স্বাস্থ্যদপ্তরের এক মুখপাত্র সংবাদটি জানাইয়া বলেন, এই ধরনের হাসপাতাল ভারতে ত নয়ই, এশিয়ার কোথাও নাই। কেবলমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকগণ প্রস্তাবিত হাসপাতালটিতে হঠাত্ অসুস্থ কঠিন রোগীদর চিকিত্সা করিবেন। সেই সঙ্গে আকস্মিক রোগ সম্পর্কে ডাক্তার এবং নার্সদের বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হইবে। উক্ত মুখপাত্র ইহাও জানান যে, প্রস্তাবিত হাসপাতালটি সম্পেকে বিস্তারিত পরিকল্পনা রচনার জন্য এরটি কমিটি নিয়োগ করা হইয়াছে। কমিটিতে রাজ্য স্বাস্থ্যদপ্তরের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার ছাড়াও শহরের তিনজন বিশিষ্ট সার্জন এবং একজন ফিজিসিয়ান আছেন। পরিকল্পনাটি রূপ লইতে কিছু সময় লাগিতে পারে।

আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এই সকল সংবাদের বানান ও ভাষা অপরিবর্তিত।
 
 


 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.