পুজোয় কলকাতায় যাই না অনেক বছর। ইচ্ছে করেই। কলকাতার কিছু স্মৃতি না হয় থাকল অমলিন! পুজো তো এখন বারোয়ারি হয়ে গিয়েছে। পুরস্কারের উচ্চনাদ, ধাক্কাধাক্কি, ভিড়, এক হাতে ঘামে ভেজা রুমাল, অন্য হাতে এগরোল, লাউডস্পিকারের অহেতুক ঘোষণা। মা দুর্গার সঙ্গে প্রতি প্যান্ডেলে সাক্ষাত্ সাকুল্যে দু’মিনিটেরও কম! নাহ্, এ পুজো আমার নয়!
আমার ছেলেবেলার কলকাতার পুজো ছিল বড়ই আপনার। মহালয়ায় তখন সকালে একটু হিম থাকত বাতাসে— বিছানায় মায়ের পাশে শুয়ে শুনতাম ঠাকুরমার মারফি রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের উদাত্ত গলা। ঘুমচোখে নীচে নেমে দেখতাম বাড়ির লাগোয়া শিউলি গাছের তলায় শেষরাতের তারা ভরা আকাশের মতো এক রাশ নরম সাদা ফুল— ভেজা মাটিতে মুখ গুঁজে মাটির ঘ্রাণ নিচ্ছে। ওদের কোমল বোঁটায় টলটল করছে শিশিরের ফোঁটা। ফ্রকের কোঁচড় ভরে যেত এক আশ্চর্য আলোয়। তত ক্ষণে রেডিওতে আগমনী শুরু হয়েছে— কোন মা তাঁর মেয়েকে দেখার জন্য আকুল— সে গানের মর্ম বোঝার বয়স তখনও হয়নি, তবে দুঃখ বুঝতে শিখেছি— “যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, উমা আমার কেমন রয়েছে” শুনে কেন জানি আমার কোনওদিন না দেখা আঠাশ বছর বয়সে অকালপ্রয়াত দিদিমার জন্য একরাশ কষ্ট বুকের মধ্যে মোচড় দিত— আহা, জীবনে কত সাধ অপূর্ণ থেকে গিয়েছে তাঁর। তাঁর কি মা ছিল? দিদিমা থাকলে আমার মাকে কি এমনি করে দেখতে চাইত? বিষাদের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ বোধহয় এই ভাবেই— কোনও এক আনন্দের মহালয়ার ভোরে।
পুজো তখন এ রকম দু’সপ্তাহব্যাপী এলাহি ব্যাপার ছিল না। পুজো হত সপ্তমী থেকে নবমী, দিন মেপে। দশমীর দিন যোধপুর পার্ক আর সেলিমপুরের মাঝ বরাবর বড় রাস্তায় দাঁড়াতাম গিয়ে, বিসর্জনের ঠাকুর দেখতে। শহর তখন অনেক বেশি সভ্য ছিল যে! একচিলতে যে জমিতে বাঁশের খুঁটি বেঁধে, সামিয়ানা খাটিয়ে তখন পুজো হত, এখন সেখানে রাস্তার উপর থেকেই সটান একটা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে। আমাদের পাড়ার পুজো এখন পুরস্কার বিজয়ী নব্যকুলীন, পুরনো দিনের সেই সাদামাটা দিনগুলো মিলিয়ে গিয়েছে জলছবির মতো।
মিলিয়ে গিয়েছে আরও অনেক কিছুই। গলির শেষে একটা খাটাল ছিল। ভোরে হিন্দুস্তানি গোয়ালারা প্লাস্টিকের জুতোয় খটাখট শব্দ তুলে হাতে লোহার বালতিতে খড় চাপা দুধ নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেত। হরিণঘাটা অনেকদিন চালু হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আমরা তখনও মাঝে মাঝেই দুধ রাখতাম পুরনো লোক হরিমতির কাছ থেকে। স্টিলের কাপে পোয়া মেপে ফেনা তোলা দুধ ‘পাস্তুরাইজেশন’-এর তোয়াক্কা না করে বাধাঁনো উনুনে, গুলের আগুনে, লোহার কড়াইতে জ্বাল দিয়ে দিব্যি খেত সবাই। একটু পরে যেত ফুলঝাড়ুওয়ালা— “ফুলঝাড়ু...” হাঁক দিয়ে। বর্ষাকালে আবর্জনা আর ভেজা কংক্রিটের গন্ধের সঙ্গে মিশে যেত চাঁপা আর মাধবীলতার সুবাস— জমা জলে ছপছপ করে “মাছ লাগবে নাকি মাছ... ভাল তোপসে, মৌরলা, ইলিশ আছে বাবু” বলে চলে যেত মাছওয়ালা। কালীপুজোর আগেই এসে যেত ধুনকরের দল। তুলো ধুনবার জন্য হাতে থাকত বিশাল ধনুকের মতো যন্ত্র। আমি কল্পনা করতাম যেন রাম এসেছে বনবাস থেকে, বা মহারাজ দুষ্মন্ত। আর ছিল আমাদের সবার ‘লং ক্লথ’ দাদু। বোধহয় লন ক্লথ বিক্রি করতেন শীর্ণকায় ওই খর্বাকৃতি বৃদ্ধ। কাঁধে করে সাদা কাপড়ের থান নিয়ে ঘুরতেন, আর বাচ্চাদের আবদারে গান করতেন, ঘুরে ঘুরে গলা খাঁকারি দিয়ে, প্রত্যেক লাইনের শেষে বলতেন— “হুম।” বিক্রি কী হত কে জানে! অবশ্য তখন তো সাউথ সিটি বা সিটি সেন্টার ছিল না। পুজোয় একই ছিটের কাপড় কিনে পরম যত্নে আমাদের দু’বোনের জামা বানিয়ে দিত ন’পিসি।
কলকাতার বর্ষা কোনও দিন পছন্দ ছিল না আমার, কারণ বাসে করে স্কুলে যেতাম। রেইনকোটের ভিতরে ঘেমে উঠেছি, সামনে যিনি দাঁড়িয়ে তাঁর ছাতার থেকে জল ঝরছে আমার জুতোয়, নর্দমা উপছে যত রাজ্যের নোংরা ভেসে চলেছে, বাস থেকে নামতেই একটা গাড়ি আপাদমস্তক ভিজিয়ে জল ছিটিয়ে চলে গেল, স্কুলে গিয়ে ভেজা জুতো-মোজা খুলে বসেছি, ভিজে শার্টে পিঠ সেঁটে আছে —এই আমার বর্ষার স্মৃতি। রবি ঠাকুরের বর্ষার গান ভাল লাগতে অনেক দিন লেগেছে। আর তত দিনে একটা গাড়ি এসেছে বাড়িতে। স্কুল তখনও জেঁকে বসেনি জীবনে। স্মৃতির একেবারে গোড়ায়, স্বপ্নের মতো মনে পড়ে এক সন্ধ্যার কথা— বাইরে অবিরাম জল ঝরছে, লোডশেডিং, জোলো হাওয়ায় মোমবাতির আলো কাঁপছে, বিচিত্র ছায়ার খেলা দেওয়ালে, রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁকছ্যোঁক আওয়াজ আসছে, ব্যাঙের ডাক অবিশ্রান্ত। সেই জমাট অন্ধকারে বর্ষার শব্দে কোলাহলহীন কলকাতা ছিল রূপকথার রাজ্য।
শীতের মুখে কালীপুজো। ছোটজেঠু বাজার থেকে নিয়ে আসত ছোট-বড় সাইজের চল্লিশ-পঞ্চাশটা তুবড়ির খোল, তাদের জলে ভিজিয়ে শুকানো হত দু’দিন ধরে। সোরা-গন্ধক-কাঠকয়লা হামানদিস্তায় গুঁড়ো করে কাপড়ে ছাঁকা হত। তাতে মেশানো হত অ্যালুমিনিয়াম আর তামার গুঁড়ো। কালীপুজোর দিন সারা দুপুর আমরা সবাই মিলে চিলেকোঠায় জড়ো হয়ে খোলে মশলা ভরতাম। প্রথমে মশলা, তার পর বালি, শেষে মাটি দিয়ে খোলের মুখ বন্ধ করতে হত। সে এক দারুণ উত্তেজনা! এক একটা তুবড়ি উঠত ন’দশ হাত উঁচু হয়ে, জ্বলতো অনেক ক্ষণ, এখনকার বাজারি তুবড়ি তার কাছেই লাগে না!
কলকাতার শীত আমার কাছে সব চাইতে মধুর— সে দিনও, আজও। কী বিশাল ছিল নীল আকাশটা— সকালের নরম রোদ গায়ে মেখে এক ঝাঁক পায়রা উড়ে যেত এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। আবার আকাশের শেষ সীমানা থেকে ডানায় ঝিলিক তুলে ফিরে আসত আমার পৃথিবীতে। ষুদ্ধপ্রান্তরের মতো বড় ছাদটার পাঁচিল ঘেঁষে ছিল গাঁদা, জিনিয়া, দোপাটি। পড়ন্ত দুপুরে কমলালেবু আর গল্পের বই হাতে উঠে যেতাম চিলেকোঠার ছাদে। চিত হয়ে শুয়ে চেয়ে দেখতাম আকাশটাকে— আমার আর আকাশের মধ্যে কিচ্ছুটি নেই— অনন্তের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। অনেক উঁচুতে ভ্রাম্যমান বিন্দুর মতো একটা একাকী ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে সেই আমার প্রথম উত্তর খোঁজা— জীবন কী, মৃত্যু কী, কোথায় শুরু, কোথায় শেষ— হঠাত্ বড় হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া। মাঝে মাঝে একটা প্লেন ক্ষীণ বাষ্পরেখা টেনে চলে যেত উত্তরে, দমদম বিমানবন্দরের দিকে— কোন এক জগতের লোকেদের নিয়ে, যাদের সঙ্গে আমার কোনও পরিচয় নেই, যারা জানে না একটা ছোট্ট মেয়ে তাদের দিকেই চেয়ে আছে! ভেবে শিহরিত হতাম। বইমেলা, চিড়িয়াখানা, পিকনিক, ঝুপ করে নামা সন্ধেতে বন্ধ ঘরে ধুনোর ধোঁয়া আর বেগন স্প্রে-র গন্ধ, লেপের সঘন আলিঙ্গনে দূর থেকে ভেসে আসা গানের রেশ আর ঢাকুরিয়া রেল লাইনের ট্রেনের হুইসেল, মশারির গায়ে পেটমোটা মশাদের দল, পাশে মায়ের মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দ— পরম আশ্বাসের মতো। আমার সমস্ত বয়সি ভাল লাগা, ভালবাসা এবং বেদনা ধরা আছে কলকাতার কত শীতের দুপুরে ও রাতে।
কলকাতা কি কেউ কখনও ছেড়ে যায়? না যাওয়া যায়? জানুয়ারি মাসের উড়ে যাওয়া বরফ কুচির দিকে চেয়ে কত দিন কলকাতার কালবৈশাখীর কথা মনে করেছি। বুকের মধ্যে বসত করে শহর কলকাতা। পুরনো প্রেমিকের মতো তার সব দোষ চেনা, ভাল লাগা আলগা হয়ে গিয়েছে অধিক পরিচয়ে— তবু যখন দূরে থাকি, তখন রাতে বালিশে মুখ লুকিয়ে প্রণয়ীর মতো বলি, “আমার শহর, আমার কলকাতা। কলকাতা, ভালবাসি, বোঝ না?”
বাল্যকাল ও কৈশোর কেটেছে কলকাতায়। প্রথম যৌবনও। কম্পিউটার সায়েন্সে বি-টেক করে প্রথম শহর ছাড়া চাকরিসূত্রে। প্রথমে দিল্লি, পরে এমবিএ মুম্বইতে। কিছু দিন বেঙ্গালুরুতেও। ‘ইনফর্মেশন টেকনোলজি’র কাজ। থাকাও হয়েছে বহু দেশে— সিঙ্গাপুর, জার্মানি, ইউ কে। আজ বেশ কয়েক বছর নিউ ইয়র্ক শহরের বাসিন্দা। লেখার প্রতি তুমুল ভালবাসা— লেখালেখি ইংরেজি ও বাংলাতে। বেশ কিছু পত্র পত্রিকায় বেরিয়েছে সেই শখের লেখা। অবসর সময়ে লেখা হয়েছে ছোট গল্পও।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.