শান্তিনিকেতনের শান্তিদেব
১৯৩৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। অসুখে রবীন্দ্রনাথের চেতনাহীন অবস্থা। উদয়ন বাড়ির একটি বড় ঘরে রাতে গুরুদেবকে দেখাশোনার জন্য আরও কয়েক জনের সঙ্গে দায়িত্ব পেলেন তিনি। রাত তখন ১২টা কি ১টা হবে। ঘরে একটি নীল রঙের বাল্ব জ্বলছে। সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। হঠাত্ তিনি দেখলেন, গুরুদেব খাটের এক পাশে নেমে সম্পূর্ণ অনাবৃত অবস্থায় দাঁড়িয়ে। মনে হল সামনে দাঁড়িয়ে এক জ্যোতির্ময় পুরুষ। মাথা থেকে শুরু করে দেহ ও পা পর্যন্ত বিচ্ছুরিত হচ্ছে উজ্জ্বল শুভ্র জ্যোতি। রবীন্দ্রনাথকে ‘মহাযোগী ঋষি’র এমন অপার্থিব রূপে দেখেছিলেন যিনি এ বারের অতীতের তাঁরায় সেই শান্তিদেব ঘোষ।
৯৩৯ সাল। ‘তাসের দেশ’ পুনরাভিনয়ের প্রস্তুতি চলছে। বীন্দ্রনাথ তখন ‘কোনার্ক’ বাড়িতে থাকেন। সারা দুপুর কয়েকটি গানে সুর দিয়ে, ভৃত্যকে পাঠালেন তাঁর এক ছাত্রের কাছে। ছাত্রটি তখন ছাত্রছাত্রীদের গান শেখাচ্ছিল ক্লাসে। ভৃত্যটিকে দিয়ে সে গুরুদেবকে বলে পাঠাল, “আমি ক্লাস শেষ করেই যাচ্ছি। একটু দেরি হবে।”

গুরুদেবের কাছে ছাত্রটির যেতে প্রায় আধ ঘণ্টা দেরি হয়। গিয়ে সে দেখে, যে ঘরে বসে লিখতেন, সেখানেই লেখার টেবিলের উপরে গানের খাতা খুলে রেখে চুপ করে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। মুখ গম্ভীর। কিছুই বলছেন না, তাকাচ্ছেনও না ছাত্রটির দিকে। কিছু ক্ষণ পর গানের খাতাটি দিয়ে কবি তাঁকে পাশের মোড়াটিতে বসতে বললেন। বিরক্ত যে তিনি হয়েছেন সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কারণ জিজ্ঞেস করতেও ছেলেটির সাহস হচ্ছে না। মোড়ায় বসে সে গুরুদেবের কাছ থেকে একটি কলম ও কয়েকটি কাগজ চেয়ে নিয়ে যখন নতুন গান ক’টি কপি করে নিচ্ছে, তখন কবি গম্ভীর কণ্ঠে অনুযোগ জানালেন, সারা দুপুর নতুন সুর দেওয়া গানগুলি মনে রাখার জন্য গেয়ে গেয়ে ক্লান্ত তিনি। ছেলেটিকে খবর দেওয়া সত্ত্বেও সে এল দেরি করে! ক্লাস থাকলেও কেন সে তা বন্ধ করে আসেনি— তাই গুরুদেবের রাগ হয়েছে ছাত্রটির প্রতি। “সত্যি আমার অন্যায় হয়েছে!” বলে ছাত্রটি গুরুদেবের কাছে সব ক’টি গান শিখে নিয়ে গাইতে শুরু করল। তখন রবীন্দ্রনাথ খুব খুশি। ভৃত্যকে ডেকে ছাত্রটিকে ভাল করে খাইয়ে দিতে বললেন। খেতে খেতে নানা কথা হল দু’জনের মধ্যে।

দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রমা করের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ হাতে লেখা যাবতীয় নতুন গানের কপি যাঁর হাতে প্রথমে ধরিয়ে দিতেন, এ ছাত্রটিই সেই শান্তিদেব ঘোষ, যাঁর পূর্বের নাম ছিল শান্তিময়।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শান্তিদেব। (নীচে বসে)
ম্যাট্রিকুলেশনের গণ্ডি পার না হলেও প্রবল ইচ্ছেশক্তির জোরে শান্তিদেব ভারতীয় নাট্যশাস্ত্র, নৃত্যশাস্ত্র ও সঙ্গীতশাস্ত্রে পারদর্শী হওয়ার পাশাপাশি নিজের চেষ্টায় সংস্কৃত, মালয়লম ও ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। নির্ভরযোগ্য স্বরলিপিকার, সঙ্গীত-শিক্ষক ও অসামান্য গায়ক শান্তিদেব সুরকার হিসেবেও দক্ষ ছিলেন। নৃত্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কখনও কথাকলির সঙ্গে মণিপুরি, কখনও বা ডান্ডিয়া বা জারি নাচ একত্রিত করেছিলেন তিনি।

জন্ম ও ছেলেবেলা
৭ মে ১৯১০, বাংলাদেশের বাজাপ্তি গ্রামে জন্ম শান্তিময়ের। বাজাপ্তি গ্রামটি ছিল চাঁদপুর থেকে ৬ মাইল দক্ষিণে মেঘনা নদীর পূর্ব পাড়ে। ছ’ভাইবোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন শান্তিময়। তিনি ও তার পরের ভাই সাগরময় (সাহিত্যিক ও দেশ পত্রিকার সম্পাদক) ওই গ্রামের বাড়িতেই জন্মেছিলেন। তাঁর ঠাকুরদার কবিগানের দল ছিল। বাবা ছিলেন স্বদেশকর্মী। পরে বাবা কালীমোহন শ্রীনিকেতনের রূপকার হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছিলেন। শান্তিময়ের ছ’মাস বয়সে বাবা কালীমোহন, মা মনোরমাদেবী ও ঠাকুমার সঙ্গে প্রথম তিনি শান্তিনিকেতনে আসেন। ওঁরা তখন থাকতেন নিচুবাংলার ‘দ্বিজবিরাম’-এর পূর্ব দিকে যে রাস্তাটি বোলপুরের রাস্তায় মিশেছে, তার গায়ের একটি বাড়িতে। পরে উঠে আসেন ‘দ্বারিক’ বাড়ির পাশে।

শান্তিনিকেতনে আসার পর রবীন্দ্রনাথ কালীমোহনবাবুকে বলেছিলেন, তাঁর মা-সহ স্ত্রী-পুত্রকে এক বার যেন নিয়ে আসেন। তিনি সকলকে দেখতে চান। কবি তখন ‘দেহলি’ বাড়ির দোতলায় থাকেন। পরের দিন, মা-স্ত্রী-পুত্রকে গুরুদেবের কাছে নিয়ে গেলেন কালীমোহন। নানা অলঙ্কারে সাজানো শিশুটিকে দেখে রবীন্দ্রনাথ কালীমোহনকে বলেছিলেন পুত্রটি নাকি ‘বালকৃষ্ণ’— এ কেষ্টঠাকুরকে কোথায় পেলে! আসলে বাবার মতো ফর্সা ছিলেন না শান্তিময়। অন্য দিকে মোটাসোটাও বটে। তাই কবির এমন বাক্য।

শান্তিনিকেতনে প্রায় এক বছর থাকার পর ফের তাঁরা বাজাপ্তিতে ফিরে গিয়েছিলেন। পুনরায় শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন ১৯১৩ সালে।

শান্তিময় থেকে শান্তিদেব
জন্মের পর কালীমোহন ছেলের নাম রেখেছিলেন শান্তিময়। কালীমোহনের সঙ্গে তখন শান্তিনিকেতনের বেশ আত্মিক সম্পর্ক। জানা যায় শান্তিনিকেতনের পরিবেশই এমন নাম রাখার কারণ। ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি নিজের হাতে লেখা নৃত্য-গীত-আবৃত্তির একটি অনুষ্ঠানের কর্মসূচিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শান্তিদেব নামকরণ করেন। কবি বলেছিলেন এটিই ভাল, এটিই থাকুক। তার পর থেকে শান্তিময় নামটি ধীরে ধীরে মুছে গিয়ে শান্তিদেব হয়ে যায়।

অবিচ্ছেদ্য শান্তিনিকেতন
কালীমোহন ঘোষ ১৯০৭-এ প্রথম শান্তিনিকেতনে আসেন। পরে তিনি আবার গ্রামে ফিরে যান। ১৯১০ সালের শেষের দিকে সপরিবারে বছর খানেকের জন্য ফের শান্তিনিকেতনে আসেন তিনি। ১৯১২তে রবীন্দ্রনাথের উত্সাহে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য ও শিশুদের শিক্ষা প্রণালী অনুশীলনের জন্য। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নিজেই সঙ্গে করে শান্তিনিকেতনে ফিরিয়ে আনেন কালীমোহনকে। তাঁকে শিশুবিভাগের সার্বিক দায়িত্ব দেন। পরে পল্লিচিন্তার ধারক ও বাহক হন তিনি। কালীমোহন ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, শান্তিনিকেতনের অক্লান্ত কর্মী ও কবির স্নেহভাজন। লন্ডন থেকে ফিরে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কিছু দিন থাকার পর সে বছরই কালীমোহন মনোরমাদেবী, শান্তিময় ও সাগরময়কে নিয়ে চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। থাকতে শুরু করেন ‘দেহলি’ বাড়ির সংলগ্ন ‘নতুন বাড়ি’র অংশে।
শান্তিনিকেতনের রাস্তায় রিকশায় শান্তিদেব।
ক্রমে গুরুদেবের ‘আশ্রম বিদ্যালয়ে’ লেখাপড়া শুরু হয় শান্তিময়ের। মাধবীকুঞ্জের নীচে আসন পেতে কখনও অঙ্কের ক্লাস, কখনও বা বাংলা ক্লাস চলত। অবসর থাকলে গুরুদেবও চলে আসতেন বাংলা, সংস্কৃত ও ইংরেজি ক্লাস নিতে। চলল বর্ষার খোয়াইয়ে লাল জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার খেলা, কেয়া ফুলের জঙ্গল থেকে ফুল তোলা, সাপের ভয়কে উপেক্ষা করেই। ব্রহ্মচর্যাশ্রমে উপাসনার পাশাপাশি বকুলতলায়, আম্রকুঞ্জে, শালবীথি বা ছাতিমতলায় নেচে-খেলে-গেয়ে-অভিনয় শিখে বড় হয়ে উঠতে লাগলেন শান্তিময়।

১৯৩০ সালে বিশ্বভারতীর সঙ্গীত শিক্ষক নিযুক্ত হন শান্তিদেব। ১৯৩৯-এ সঙ্গীতভবনের পরিচালক হওয়ার পর ১৯৪৫-এ অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর ১৯৫৪তে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নৃত্যের প্রধান অধ্যাপকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন শান্তিদেব। ১৯৭৪ সালে বিশ্বভারতী থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

গান ও শান্তিদেব
রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে থেকে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন শান্তিদেব। দিনেন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র দ্বীপেন্দ্রনাথের ছেলে। ১৯৩৫ সালে তিনি মারা যান। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘রবীন্দ্র জীবনকথা’য় জানিয়েছেন, “দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতায় হঠাত্ মারা গেছেন (৫ শ্রাবণ ১৩৪২)। দিনেন্দ্রনাথ গত বত্সর শান্তিনিকেতন থেকে তাঁর সমস্ত সম্বন্ধ চুকিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। যিনি আশ্রমের সঙ্গে নানাভাবে প্রায় ত্রিশ বত্সর যুক্ত ছিলেন, যিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনের ‘বালকদলের সকল নাটের কাণ্ডারী’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘সকল গানের ভাণ্ডারী’, যিনি কবির অসংখ্য গানের সুর অভ্রান্ত স্মৃতিতে সঞ্চয় করে ও কণ্ঠে ধারণ করে আশ্রমের ছাত্রছাত্রীদের রবীন্দ্রসংগীতে দীক্ষিত ও শিক্ষিত করে দিয়েছেন...”
রবিশঙ্কর, মোহন সিংহ*, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও আমজাদ আলির সঙ্গে শান্তিদেব।
১৯৩৪ সালে রমা কর অর্থাত্ নুটুদির মৃত্যু ও দিনুবাবুর চলে যাওয়ার পর একটানা কবির রচিত নানা পর্যায়ের নতুন গান, নাটকের গান, নৃত্যনাট্যের গান শিখতে হয়েছিল শান্তিদেবকে। হাতে লেখা যাবতীয় নতুন গানের কপি ‘শান্তি’র হাতে ধরিয়ে দিতেন রবীন্দ্রনাথ। দিনুবাবুর মতোই গলার স্বর না চড়িয়ে গানটির সুর মনে ধরে নেওয়ার চেষ্টা করতেন শান্তিদেব। যখন মনে করতেন তাল, লয়, সুর মনে বসে গিয়েছে তখন গুরুদেবের সুরে সুর মিলিয়ে গাইতেন। ভীমরাও শাস্ত্রীর কাছে শিখেছিলেন হিন্দুস্থানী সঙ্গীত। এস্রাজ ও বীণায় পারদর্শী ছিলেন রবীন্দ্র সংস্কৃতির ধারক ও বাহক শান্তিদেব।

শান্তিনিকেতনে নির্বাচিত গানের দলে যখন শান্তিদেব স্থান পেয়েছিলেন, তখন তাঁর পাঁচ-ছয় বছর বয়স। তিনিই ছিলেন দলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। সবাই দাঁড়িয়ে গাইত আর দিনুঠাকুর বাজাতেন। শান্তিদেবের মুদ্রাদোষ ছিল বার বার মাথা চুলকানো। আর তা নিয়ে কতই না মজা!

রবীন্দ্রনাট্যে শান্তিদেব
ছোট্টবেলা থেকেই নাটকের মহড়া দেখেছেন শান্তিদেব— ফাল্গুনী, অরূপরতন, ডাকঘর। কিন্তু তিনি যখন ৯ বছর বয়সে পা দিয়েছেন ১৯১৯ সালে, ‘শারদোৎসব’ নাটকটিতে বালকদের দলে মঞ্চ পরিক্রমা করলেন তিনি। এর পরে ‘ঋণশোধ’ নাটকেও তিনি নাচের দলে ছিলেন। ১৯২৩-এর মার্চ মাসে কলকাতায় ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যে ‘ওরে পথিক, ওরে প্রেমিক’ গানটিতে গুরুদেবের সঙ্গে নাচে যোগ দিয়েছিলেন ১৩ বছরের শান্তি। ‘অরূপরতন’ ও ‘ডাকঘর’-এ ঠাকুরদা, ‘ফাল্গুনী’তে বাউল, ‘তাসের দেশ’-এ রাজপুত্র, ‘শাপমোচন’-এ রাজা, ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় বাল্মীকি, ‘চিত্রাঙ্গদা’য় অর্জুন, ‘চণ্ডালিকা’য় প্রহরী বা রাজদূত, ‘শ্যামা’-য় কোটাল চরিত্রে তিনি অনন্য হয়ে উঠেছিলেন। এ সবই সম্ভব হয়ে উঠেছিল গুরুদেবের সম্মতিক্রমে।

১৯৩৩ সালে ‘তাসের দেশ’ নাটকটি লেখার পর মঞ্চস্থের জন্য নানা চরিত্র বাছাই করার কথা ভাবছেন রবীন্দ্রনাথ। কবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী রাজপুত্রের চরিত্রে সুদর্শনা একটি ছাত্রীর কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু কবি পছন্দ করলেন শান্তিদেবকে। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুও কবির প্রস্তাবে একমত হয়েছিলেন। নন্দলাল বসু নিজের হাতে তাঁকে এমন ভাবে সাজিয়ে দিয়েছিলেন যাতে রাজপুত্রের ভূমিকায় মোটেই তাঁকে বেমানান না লাগে!

১৯৩৫ সালে শেষবারের মতো ‘শারদোৎসব’ নাটকটির অভিনয় করান কবি। রবীন্দ্রনাথ এ নাটকে আগের মতোই সন্ন্যাসীর চরিত্রে অভিনয় করেন। আর ঠাকুরদার ভূমিকায় রেখেছিলেন শান্তিদেবকে। গুরুদেবের পাশে তিনি মোটেও বেমানান ছিলেন না।

নৃত্যে শান্তিদেব
১৯২০ সালে শান্তিদেব মণিপুরি নাচ শেখা শুরু করেন, শান্তিনিকেতনে বুদ্ধিমন্ত সিংহের কাছে। তার পর ১৯২৯ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত তাঁর নাচ শেখায় কোনও ছেদ পড়েনি। কেরল থেকে কথাকলি, চার বার শ্রীলঙ্কায় গিয়ে ক্যান্ডি, গুজরাতের গরবা ও ডান্ডিয়া রাসনৃত্য, মায়ানমারে রামপোয়ে, জাভা ও বালি দ্বীপের নাচ তিনি শিখেছিলেন অত্যন্ত আগ্রহ ভরে। নতুন নতুন নাচ শেখার প্রয়োজনে নানা জায়গায় ভ্রমণের জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁকে খুবই উত্সাহিত করতেন।

১৯৩১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে বীরভূমের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ব্রতচারী আন্দোলনের প্রবর্তক গুরুসদয় দত্তের আয়োজনে সিউড়িতে লোকনৃত্যের সম্মেলন হয়। শান্তিদেব কলাভবনের কয়েক জন ছাত্রের সঙ্গে সেখানে এই সম্মেলনে গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি রায়বেশে ও জারি গানের সঙ্গে পুরুষনৃত্য দেখেন। পরের মার্চেই দোল উত্সবে গুরুদেবের নির্দেশে শান্তিদেব বাউলের ঢঙে নাচ রচনা করে প্রদর্শন করেন। এর পর কবির কাছে তিনি আবেদন করেন রায়বেশে শেখার। গুরুসদয় দত্তকে বলে সে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এর পর থেকে শান্তিদেব যুক্ত হয়ে পড়েন গুরুদেবের গানের সঙ্গে নৃত্য রচনায়। এবং সে কারণেই তিনি দেশবিদেশের নানা আঙ্গিকে নৃত্য শিখতেও থাকেন।

‘শান্তি’র বিরুদ্ধে ‘অভিযোগে’ উদ্বিগ্ন গুরুদেব
শান্তিনিকেতন
কল্যাণীয়েষু শান্তি,

কেবল দুটি উপদেশ আমার আছে। এই আশ্রমেই তুই মানুষ। সিনেমা প্রভৃতির সংস্পর্শে কোনও গুরুতর লোভেও নিজেকে যদি অশুচি করিস তাহলে আমার প্রতি ও আশ্রমের প্রতি অসম্মানের কলঙ্ক দেওয়া হবে।
দ্বিতীয়, আমার গানের সঞ্চয় তোর কাছে আছে— বিশুদ্ধভাবে সে গানের প্রচার করা তোর কর্তব্য হবে। আমি তোর পিতার পিতৃতুল্য। আশা করি আমার উপদেশ মনে রাখবি। ইতি
২১/১/৪১
শুভার্থী
রবীন্দ্রনাথ
মৃত্যুর প্রায় আট মাস আগে তাঁর ভৃত্যকে দিয়ে এই চিঠিটি রবীন্দ্রনাথ পাঠিয়েছিলেন শান্তিদেবকে। কিন্তু কেন?
তাঁর ‘জীবনের ধ্রুবতারা’য় শান্তিদেব লিখছেন, “কলেজের তরুণ অধ্যাপকগণ চেষ্টা করেছিলেন আমাকে তাঁদের দলে টানতে। তাঁদের কার্যকলাপে, তাঁদের প্রতি প্রথম থেকেই আমি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতাম। এই কারণে ওই দলটি আমার বিরুদ্ধে গুরুদেবের কাছে হামেশাই নানাপ্রকার অভিযোগ পেশ করতেন। গুরুদেব আমার বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগের কথা শুনে বিশেষ আমল দিতেন না। আমাকে ডেকে তিনি সব বলতেন এবং আমার কথা শোনার পর আমাকে সর্বদাই উপদেশ দিতেন, আমি যেন নিজের মতো কাজ করে যাই। ... গুরুদেবের মৃত্যুর মাস আষ্টেক পূর্বে, অর্থলোভে আমি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করব, আমি সিনেমায় যোগ দেব, এইরূপ এক মিথ্যা অভিযোগ গুরুদেবের কাছে এমনভাবে পেশ করা হয়েছিল যে, গুরুদেব তা বিশ্বাস করে এবারে আমাকে আর ডেকে পাঠালেন না।”

সে দিন রবীন্দ্রনাথের ওই চিঠি পড়ে তাঁর কাছে উদভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়েছিলেন শান্তিদেব। চিঠিটি দেখিয়ে ‘অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে’ বললেন, “আমাকে এভাবে আপনি কেন অবিশ্বাস করলেন?” অনেক কথার পর কবি শান্তিদেবকে বলেছিলেন, সত্ পথে থেকে কর্মজীবন চালিয়ে যেতে। তা হলে কোনও অশুভ শক্তি কোনও প্রকার ক্ষতি করতে পারবে না। গুরুদেব শান্তিদেবের মাথায় হাত রেখে সে দিন আশীর্বাদও করেছিলেন।

রেকর্ড, গ্রন্থ ও সম্মান
প্রথম রেকর্ডিং হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল পার্টির হয়ে ‘জনগণমন’ ও ‘যদি তোর ডাক শুনে’। পরে সেনোলায় রেবা মজুমদারের সঙ্গে ‘আমার প্রাণের মানুষ’ ও ‘বাকি আমি রাখব না’। রবীন্দ্রপ্রয়াণের পরে এইচ এম ভি থেকে তাঁর ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ ও ‘বসন্তে কি শুধু’-সহ বহু গান বিখ্যাত হয়ে আছে বাঙালি মনে।

রেকর্ডের পাশাপাশি তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়— রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচিত্রা, জাভা ও বালির নৃত্যগীত, রূপকার নন্দলাল, ভারতীয় গ্রামীণ সংস্কৃতি, রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাদর্শে সঙ্গীত, নৃত্য ও অভিনয়ের স্থান, মিউজিক অ্যান্ড ডান্স ইন রবীন্দ্রনাথ টেগোর’স এডুকেশনাল ফিলজফি, জীবনের ধ্রুবতারা।

পদ্মভূষণে সম্মানিত, ললিতকলার অ্যাকাডেমির ফেলো, প্রবন্ধ সাহিত্যে আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্ত শান্তিদেব কবিগুরুর স্নেহধন্য ছিলেন। রাশিয়ার পদক, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম, বর্ধমান ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আলাউদ্দীন পুরস্কার, টেগোর রিসার্চ সোসাইটির ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন শান্তিদেব ঘোষ।

শেষের সে দিন
বার্ধক্যজনিত কারণে শান্তিদেব ঘোষের মৃত্যু হয় ১ ডিসেম্বর ১৯৯৯ কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। স্ত্রী ইলা দেবীর ইচ্ছানুযায়ী শান্তিনিকেতনে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় তাঁর।

স্মৃতিচারণ
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় (লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার): যখন সাংসদ ছিলাম তখন ওঁর কাছে যাওয়ার সুযোগ ঘটে। পরে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন পর্ষদের চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদেও সৌভাগ্য হয়েছিল শান্তিদেববাবুকে আরও কাছে পাওয়ার। উনি এবং ওঁর স্ত্রী ইলাদি প্রায়ই বলতেন ওঁদের বাড়ি যেতে। ওখানে গেলে যেতামও। মানুষকে আপন করে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল শান্তিদার। গুরুদেবের কাছের এই মানুষটি ছিলেন একেবারেই নিরহঙ্কারী। সামান্যতম আত্মভণিতা ছিল না। সাধারণ জীবনযাপন করা এ রকম মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। শান্তিনিকেতনের কাছাকাছি গ্রামে আমি একটি জলপ্রকল্প করেছিলাম, যেটার উদ্বোধন করেছিলেন শান্তিদা। ওঁর জন্মদিনে আমি ফুল-মালা-খাবার নিয়ে বাড়িতে যেতাম। উনি কিছুতেই আসতে দিতেন না। যখন খোয়াই নিয়ে অপপ্রচার চলছে তখন আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন উনি। ওঁর সঙ্গে এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমার। আমাকে কাছে বসিয়ে গানও শুনিয়েছেন। এত প্রতিভা! ব্যক্তিগত ভাবে আমার জীবনের সম্পদ মনে করি ওঁকে। শান্তিদেববাবু চলে যাওয়ায় বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।


গোরা সর্বাধিকারী (সঙ্গীতশিল্পী): রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছিল কথাকলি ও মণিপুরি নৃত্য। আর গুরুদেবের ইচ্ছেতেই নাচ শিখেছিলেন শান্তিদেব ঘোষ। শান্তিদাকে ১৯৩৪ সালে গুরুদেব সাউথ ইস্ট এশিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। ৪০ জন সদস্য নিয়ে গিয়ে শান্তিদা প্রথম ভারতীয় ধারায় ‘শাপমোচন’ করেন ওখানে। পরে একা শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলেন ক্যান্ডি ডান্স শেখার জন্য। নানা ধারার নাচ শিখে তিনি কখনও ‘চিত্রাঙ্গদা’র অর্জুন চরিত্রে, কখনও বা ‘শ্যামা’র কোটাল চরিত্রে, কখনও ‘চণ্ডালিকা’য় প্রহরীরূপে আবার রাজদূতরূপেও অভিনয় করেছেন। স্বরক্ষেপ, চলন এবং হাতের মুদ্রায় আলাদা হয়ে যেত তাঁর অর্জুন, বাউল অথবা কোটাল।
সঙ্গীতভবনে শান্তিদার অধীনে ভর্তি হই। কাঁধের উপরে এস্রাজ ফেলে গান শেখাতেন। উনি যে ঘরে গান শেখাতেন সেই ঘরের দেওয়ালে নবনীদাস বাউলের ছবি টাঙানো থাকত। ওঁর ছিল বাউলমন। বলিষ্ঠ উচ্চারণে আজ ওঁর গাওয়া যে গানগুলি মনে পড়ছে— ‘ওই আসন তলে’, ‘তোমার কাছে শান্তি চাব না’, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’, ‘হে নূতন দেখা দিক আর বার’, ‘নৃত্যের তালে তালে’ ইত্যাদি। তার গান ছিল খোলা উচ্চারণের সরল সূক্ষ্ম রবীন্দ্রসঙ্গীত।


অলকানন্দা রায় (নৃত্যশিল্পী, ওডিশি): যখন আমার ১৫-১৬ বছর বয়স, তখন কলকাতার একটা অনুষ্ঠানে শান্তিদেব ঘোষকে দেখেছি— রবীন্দ্রনাথের ‘ফাল্গুনী’তে বাউলের বেশে। ওই রকম বয়স্ক মানুষ, অথচ সমস্ত ভঙ্গিমা এত সাবলীল, আমার মন ছুঁয়ে যায়। গান গেয়ে গেয়ে নাচছিলেন। আমি আজও ভুলতে পারি না। উনি বিভিন্ন ঘরানার নাচ শিখেছিলেন। সেই ঘরানা ভেঙে রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন আমাকে খুব অবাক করেছিল!
মনে পড়ছে, এক বার ‘নটরাজ’ গোষ্ঠীর সঙ্গে আমি ‘ফাল্গুনী’তে শান্তিদার সঙ্গে নেচে এতটাই আপ্লুত যে, লাফিয়ে লাফিয়ে ওঁর সঙ্গে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। মনে ছবি হয়ে আছে শান্তিদার সেই বাউলরূপের ‘ওপেন লুক’টা। আর এক বার জামশেদপুরের রবীন্দ্রভবনে শান্তিদার গানের অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম— মন্দিরা, এস্রাজ বাজছে, আর উনি আসন করে বসে খালি গলায় দুলে দুলে গাইছেন ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’। ওই রকম স্বাভাবিক অথচ দৃপ্ত মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।


মোহন সিংহ খাঙ্গুরা (সঙ্গীতশিল্পী): ১৯৬৭তে আমি শান্তিদেব ঘোষকে প্রথম দেখি। উনি তখন সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন। পায়ের সমস্যার কারণে আমার আসা-যাওয়ার অসুবিধে দেখে উনি সঙ্গীতভবনের সিঁড়িগুলি ঢালু করে দিয়েছিলেন। হস্টেলে থাকতাম। প্রথম দিন সেখান থেকে দেখলাম শান্তিদা সঙ্গীতভবনের ঘরে রেওয়াজ করছেন। আমি অবাক হয়ে শুনছি। রেওয়াজ করতে করতে উনি শুরু করলেন ‘আমার মল্লিকাবনে’। আমি তখন গানের শব্দ বুঝতে পারিনি, কিন্তু সুরটা আমার আজও মনে গেঁথে আছে। কী অপূর্ব গান গাইতেন! মনে পড়ছে ১৯৬৯, ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের মহড়ায় নিজে উপস্থিত থেকে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন গানের লয়— লয়ের উপরে নির্ভর করে গান নিষ্প্রাণ না প্রাণবন্ত, প্রত্যেক গানের নিজস্ব লয়ধর্ম আছে, ইত্যাদি। লয় সম্বন্ধে তাঁর যা ধ্যানধারণা পরবর্তী কালে আর কারও মধ্যে দেখিনি।
সত্তরের দশকে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় বাল্মীকি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ওঁর ভাই সুবীরময়ও ভাল নাচতেন। ‘তাসের দেশ’-এ রাজা ও রাজপুত্র চরিত্রে শান্তিদা অসাধারণ নাচ করতেন। শান্তিদার কাছে গান শিখেছি। তবে তিনি বার বার বলতেন, যে স্বরলিপি পড়তে জানে সে নিজে নিজেই গান তুলতে পারে। আর আমি ওটা ভাল জানতাম বলে উনি উৎসাহ দিতেন। নানা গানের মধ্যে ওঁর অনবদ্য ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ গানটি। তবে শুধু গানের মাঝেই আমাদের সম্পর্ক সীমাবদ্ধ ছিল না। উনি প্রায়ই বলতেন— তুমি কেমন করে রেওয়াজ করো এক দিন দেখতে যাব। সকাল বেলাতেই চলে আসতেন, থাকতেন দশটা-সাড়ে দশটা পর্যন্ত। যাওয়ার সময় আমার স্ত্রীর কাছ থেকে একটি পান চেয়ে খেয়ে বলতেন, “তোমার বৌদি যেন জানতে না পারেন।” গোরাদার তত্ত্বাবধানে আমার একটি ক্যাসেটের গান শুনে বলেছিলেন, “রবীন্দ্রসঙ্গীত কোনও দিন ছেড়ো না।”
প্রশাসক হিসাবে শান্তিদাকে দেখেছি, তিনি ভীষণ সত্যবাদী। অকাট্য সত্যবাদী হওয়ার জন্য বিশ্বভারতীর নিন্দুকেরা তাঁর সমালোচনা করতে ছাড়েননি। কিন্তু তাঁর গুণমুগ্ধ লোকজনও ছিলেন সেই সময়ের শান্তিনিকেতনে।


শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায় (মণিপুরি নৃত্যশিল্পী, বিভাগীয় প্রধান রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, নৃত্যবিভাগ): রবীন্দ্রনাথের নৃত্য ভাবনার দেহবিন্যাসের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য নাম শান্তিদেব ঘোষ। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যপ্রসূত দৃশ্যকাব্যের মাধ্যম ছিল দেহের সৌন্দর্যবর্ধক অঙ্গসঞ্চালন। এই অঙ্গসঞ্চালনের ভাষার জন্য তিনি তাকিয়েছেন আমাদের লোক আঙ্গিকের পাশাপাশি অন্য রাজ্যের শাস্ত্রীয় নৃত্য আঙ্গিকগুলির দিকে। তার মধ্যে মণিপুরি ও কথাকলির নাম সর্বাগ্রে করা হয়। শান্তিদেব ঘোষ সর্বপ্রথম মণিপুরি আঙ্গিক শিখতে শুরু করেন বুদ্ধিমন্ত সিংহ ও নবকুমার সিংহের কাছে, শান্তিনিকেতন আশ্রমে। কেরলে গিয়ে কথাকলি নৃত্য শিক্ষাও করেন। শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিনৃত্যের তালিমও তিনি নিয়েছিলেন। এ সবই হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু শান্তিদেব ঘোষের নাম কখনওই এক জন মণিপুরি নৃত্যশিল্পী বা কথাকলি অথবা ক্যান্ডি নৃত্যশিল্পী হিসেবে আলোচিত হয় না। তাঁর শরীরকে নৃত্যোপযোগী করার প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথ এই সব নৃত্যের তালিম করিয়েছিলেন এবং এই ‘শিক্ষিত’ দেহকে ব্যবহার করছিলেন তার নাট্য, নৃত্যনাট্য ও গানের দৃশ্যকাব্য তৈরিতে। শান্তিদেব ঘোষের নৃত্যনাট্যের চরিত্র চিত্রায়ণ তাই রবীন্দ্রনাথের নৃত্য ভাবনার ভাবধারাকেই প্রতিষ্ঠা করে।
বাংলায় রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত নৃত্যের যে যুগান্তকারী ‘এক্সপেরিমেন্ট’— যা পরবর্তীতে বাংলার ঐতিহ্যপূর্ণ নৃত্যধারা ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে— সেই ‘এক্সপেরিমেন্ট’-এর ‘ইনস্ট্রুমেন্ট’ রূপে শান্তিদেব ঘোষের নাম উজ্জ্বল। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে তিনি বিশ্বভারতী প্রযোজিত নৃত্যনাট্যগুলির উপদেষ্টা হয়ে রবীন্দ্র ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। আজীবন তিনি রবীন্দ্রনাথের নৃত্যভাবনার সংরক্ষণের প্রতি দায়িত্ববদ্ধ ছিলেন শান্তিদেব ঘোষ।


তথ্য ও সাক্ষাৎকার: পাপিয়া মিত্র।
ঋণ: জীবনের ধ্রুবতারা (আনন্দ পাবলিশার্স), পশ্চিমবঙ্গ (রবীন্দ্রসংখ্যা, ১৪০৭), আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় (আমার ছেলেবেলা, ৮ আষাঢ়, ১৩৯২)।
নিজস্ব চিত্র ও *মোহন সিংহ খাঙ্গুরার সৌজন্যে।
 
 

 
 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.