: শহরের নদী-ঘাট
|
প্রিন্সেপ ঘাট |
গাড়ি চলল নেতাজি ইন্ডোরের দিকে। বাঁ দিকে ফুটবলার গোষ্ঠপালের মূর্তি। জ্যৈষ্ঠের আকাশে শ্রাবণের ঘনঘোর মেঘ। ডান দিকে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের মূর্তিকে রেখে গাড়ি ঘুরল প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে। দূরে বিদ্যাসাগর সেতু।
বিকেলটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। হয়তো দিনটা মেঘলা বলে! সামনে প্রমথেশ বড়ুয়া সরণিতে গাড়ি যাতায়াতের ব্যস্ততা। মাঝে বিশাল এলাকা নিয়ে জেম্স প্রিন্সেপের সৌধ। স্কুলের ছাত্ররা ঘুরছে, ছবি তুলছে। সৌধের সামনে পিছনে সুন্দর করে ছাঁটা গাছ। |
|
জেম্স প্রিন্সেপের নামে এই ঘাট। প্রিন্সেপের জন্ম ইংল্যান্ডে, ১৭৯৯-এর ২০ অগস্ট। পিতা জন প্রিন্সেপের আট পুত্র। সকলেই কৃতী হলেও সপ্তম সন্তান জেম্স তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কীর্তিমান। তিনি ২০ বছর বয়সে ভারতবর্ষে এসেছিলেন কলকাতার টাঁকশালের সরকারি ধাতু-পরীক্ষক (অ্যাসে মাস্টার) হয়ে। ১৮৩০-এ কলকাতার টাঁকশালে ডেপুটি অ্যাসে মাস্টার ও ১৮৩২-এ অ্যাসে মাস্টার হন। এই পদে তিনি ১৮৩৮ পর্যন্ত কাজ করেন। শোনা যায় অতিরিক্ত মানসিক পরিশ্রমের ফলে ১৮৪০ সালের ২২ এপ্রিল মাত্র ৪১ বছর বয়সে কলকাতায় মারা যান জেম্স প্রিন্সেপ।
কলকাতায় থাকাকালীন ‘গ্লিনিংস অব সায়েন্স’ নামে একটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটিই পরে বাংলায় এশিয়াটিক সোসাইটির মুখপত্র হয়ে দাঁড়ায়। জেম্স প্রিন্সেপ ১৮৩২ থেকে ১৮৩৮ সন পর্যন্ত এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক ছিলেন। কলকাতায় থাকার সময় তাঁর ছোট ভাই, বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্সদের ক্যাপ্টেন টমাস প্রিন্সেপ হুগলি নদীকে সুন্দরবনের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য একটি খাল কাটতে শুরু করেন। ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুতে জেম্স প্রিন্সেপ সেই অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন। সেই খালটিই সার্কুলার খাল।
ঘাটের কাছেই ১৯৮১ সালে ইন্দিরা গাঁধীর হাতে দ্বিতীয় হুগলি সেতু অর্থাত্ বিদ্যাসাগর সেতুর শিলান্যাস হয়। অন্য দিকে বন্দরগামী মালগাড়ির যাতায়াত তো ছিলই, শুরু হয় উল্টোডাঙা থেকে প্রিন্সেপঘাট পর্যন্ত চক্ররেলের চলাচল। ক্রমে বিশাল উঁচু উড়ালপুল প্রিন্সেপ ঘাটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ায় চক্ররেলকে তখনকার মতো এখানেই থেমে যেতে হয়। |
|
জেম্স প্রিন্সেপের সৌধ থেকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেই হুগলি নদী। নদী ও স্মৃতিসৌধের মাঝে ঘাট সংলগ্ন চক্ররেল স্টেশন— তার নামও প্রিন্সেপ ঘাট। প্ল্যাটফর্মে চা ও চানা বিক্রি করছে ফেরিওয়ালা। রেল লাইন টপকে ঐতিহাসিক ‘গঙ্গার ঘাট’। ঘাট থেকে কিছুটা দূরে নৌকায় দ্বিপ্রাহরিক কাজে ব্যস্ত মাঝি-মাল্লা। কেউ জল তুলছেন, কেউ বা ভাত রাঁধছেন, আবার তাঁদের কেউ কেউ গিয়েছেন দূরে জাল ফেলতে।
নদীর ঘাটের কাছে
নৌকা বাঁধা আছে
নাইতে যখন যাই
দেখি সে জলের ঢেউয়ে নাচে
কবির সে মানসচোখ এখন আর নেই। নৌকা বাঁধা আছে ঠিকই কিন্তু সেই নৌকার মাঝি এখন এই অবেলায় স্নানে ব্যস্ত। আছে উজ্জ্বল সবুজ গাছ আর হাল্কা আগাছার বন্ধুত্ব।
প্রিন্সেপ ঘাটটি সম্ভবত ১৮৪৩-এ তৈরি। ১৮৪৪-এর জুলাই, বড়লাট লর্ড এডিনবরা যখন এ দেশ ত্যাগ করেন তখন চাঁদপাল ঘাটের পরিবর্তে প্রিন্সেপ ঘাট থেকে তিনি জাহাজে চেপেছিলেন। তার পর থেকে যত রাজা ও রাজ-প্রতিনিধি এসেছেন সকলেই এই প্রিন্সেপ ঘাটে নেমেছেন ও এখান থেকে ফিরে গিয়েছেন।
লর্ড কার্জনই প্রথম প্রতিনিধি যিনি প্রিন্সেপ ঘাট থেকে জাহাজ না নিয়ে হাওড়া স্টেশন থেকে রেলে চেপে মুম্বই যান। সময় ১৯০৫-এর নভেম্বর মাস। জলপথে যাবেনই বা কী করে? ইতিমধ্যে প্রিন্সেপ ঘাট থেকে নদী যে দূরে সরে গিয়েছে। সামনে নতুন স্ট্র্যান্ড রোড তৈরি হয়েছে। তখন নতুন হাওড়া স্টেশনের কাজ সবে শেষ হয়েছে। কার্জন সাহেব যাওয়ার কয়েক মাস পরেই ১৯০৬ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে হাওড়া স্টেশনের উদ্বোধন হয়। তার পর থেকে সকল রাজপুরুষই রেলপথে যাতায়াত করতেন। |
|
শব্দের আঘাতে এখানেও নদীর সঙ্গে ঘাটের সুখ-দুঃখের কথা হয়। তবে সব কথা শোনা যায় না হয়তো নাগরিক ব্যস্ততায়!
সম্প্রতি আলোয় সেজেছে গঙ্গা তীরবর্তী শহরের ঐতিহ্যশালী প্রিন্সেপ ঘাট। সেখানে তৈরি করা হয়েছে মনোরম পরিবেশে ঘুরে বেড়ানোর সরণি ও বিশ্রামের জায়গা, আবহে রবীন্দ্রসঙ্গীত। বহু বছর আগে সন্ধ্যার ইডেন গার্ডেন্সে সেনাবাহিনীর ব্যান্ডের বাজনা শুনতে ভিড় হত। সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে শনি-রবির সন্ধ্যায় প্রিন্সেপ ঘাটে বসবে কলকাতা পুলিশের ব্যান্ডের আসর— এমন আশ্বাসও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এ সবের ভিতর দিয়েই নতুন ভঙ্গিমায় গড়ে উঠল শহরের বুকে আরও একটি পর্যটনকেন্দ্র। সৌধের সঙ্গে যেখানে একই সঙ্গে দেখা যাবে চক্ররেল ও গঙ্গার ঘাট। চড়াও যাবে ট্রেন বা নৌকায়, ইচ্ছে মতো।
|
তথ্য: পাপিয়া মিত্র
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
|