শহরের সৌন্দর্য বাড়ুক কিন্তু ‘উচ্ছেদ’ করে নয় কৌশিক সেন (নাট্য নির্দেশক-অভিনেতা)
যত যাই বলি না কেন, কলকাতা আমার সব চেয়ে প্রিয় শহর। যাঁরাই এখানে থেকেছেন তাঁরাই এই শহরের প্রেমে পড়ে গিয়েছেন। তবে, হাজারো সমস্যা বা সমালোচনার পরেও কলকাতা থাকবে কলকাতাতেই। নানা অব্যবস্থায় অনেকেরই হয়তো খুব রাগ হয়। কিন্তু সেটা সাময়িক। এটা বুঝি যখন নানা কাজে কলকাতার বাইরে যাই। সেখানে গেলে ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট বা সাজানো শহর দেখলে তৎক্ষণাৎ ভাল লেগে যায়। কিন্তু না, কয়েক দিন পর থেকেই কলকাতার জন্য মন কেমন করে!
আমার ছোটবেলা কেটেছে ভবানীপুরে। ওখানে একটা বনেদিয়ানা আছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে কত দ্রুত বদলে যাচ্ছে সব কিছুই। ভাবুন, এক সময়ে অধিকাংশ বাঙালি ওখানেই থাকত। কিন্তু এখন? শহরতলিতে পা বাড়িয়েছেন আমারই চেনাজানা কত জন— বারুইপুর বা সোনারপুর, কেউ কেউ তো আরও দূরে। আমি খুব অবাক হই, যখন দেখি মাত্র দেড় যুগের ব্যবধানে ভবানীপুরে অবাঙালিদের সংখ্যা কী দ্রুত হারে বেড়েছে! স্বভাবতই পরিবেশটাও অনেক বদলে গিয়েছে। কিছুতেই আমি আমার ছোটবেলার সেই সব স্মৃতি আর খুঁজে পাই না। কোথায় গেল আমার খেলার মাঠ? কোথায় গেল পুজোর সেই দিনগুলোর নস্টালজিক অনুভূতি? কেন হারিয়ে গেল বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিজয়ার প্রণাম করার রেওয়াজ? কালের অভিশাপ। সব কিছুর পরিবর্তনই বোধহয় এমন ভাবেই হয়।
এই শহরের ভাল ও মন্দ দু’টি রূপই আমার বড় চেনা। এখানে ভাল বলতে শহর দ্রুত আধুনিক হচ্ছে। আর মন্দ বলতে আধুনিকতার নামে উচ্ছেদ, যা অবশ্য জরুরি হয়েই পড়ে।
আমি যখন শাঁখারিপাড়া বা কাঁসারিপাড়া পেরিয়ে এলগিন রোডের দিকে যাই, মনে হয় অন্য শহরে চলে এসেছি— শপিং মল থেকে আধুনিক শহরের সব সরঞ্জামই হাতের নাগালে পাওয়া যায় এখানে— পরিবর্তন এনেছে আধুনিকতার ছোঁয়া! ইদানীং এ সব আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হয়। অথচ এই অনুভূতিটাই বদলে যায় শহরের অন্য প্রান্তে যখন যাই।
শহর তার গতি বাড়াতে ফ্লাইওভারে ডানা মেলছে, গাড়ির গতি বাড়াতে রাস্তাও চওড়া হচ্ছে। চওড়া রাস্তা মানে বহু মানুষের অস্তিত্ব বিলীন হওয়া। এই নিয়ে এক এক সময়ে অনেক কিছু ভেবে ফেলি। উচ্ছেদ হওয়ার পরে ওরা কোথায় গেল? কোথাও না কোথাও তো আছেই। বেঁচে আছে হয় তো— প্রাণকে মেরে ফেলা কষ্ট। সরকার বা পুলিশ সাহায্য না করলেও ওরা কোথাও না কোথাও ঠাঁই খুঁজে নেবে নিশ্চয়ই। একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। এক দিন চারু মার্কেটের পাশ দিয়ে আসছিলাম। দেখি পর পর দশ-বারোটি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। অসহায় কিছু মানুষের জটলা— ছেঁড়া কাঁথা-কম্বল, হাঁড়ি-ঘটি-বাটি নিয়ে সব ট্রাকে উঠছে। ওই অসহায় মুখগুলো কিছুতেই আমার মন থেকে মুছে যায় না।
এখন আমি কালিকাপুরের ‘পূর্বালোক’-এ থাকি। পাশেই নোনাডাঙা। সেখানে কত মানুষের অসহায় মুখ দেখেছি। উচ্ছেদ আমাকে চিরকালই ব্যথিত করে। মনে হয়, ওদের মুখের এই যন্ত্রণা আমাকেও যেন বিদ্ধ করছে প্রতিনিয়ত।
আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, এই শহর বিবেচনাহীন ভাবে বড্ড বেশি দাপাদাপি করে। কখনও কখনও খেলা নিয়ে হামেশাই এমন হয়। আবার দেখুন, এই শহরেই ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের একটি টিকিটের জন্য কাউন্টার খোলার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই লাইন পড়ে যায়। অর্থাৎ, কলকাতা এমন একটি শহর যেখানে সব আছে। ভাল জিনিসকেও কখনও ব্রাত্য করে না বা করেনি।
এই শহরই আবার বিবেকের তাগিদে পথে নামে। ১৯৭৮ সালের সেই বন্যায় ভবানীপুরের হরিশ মুখোপাধ্যায় রোডের ওই জলে পার্টি কমরেডরা যে ভাবে পথে নেমেছিলেন তা এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তখন বয়সে খুব ছোট হলেও ওই মানুষগুলোকে শ্রদ্ধা না করে পারিনি।
আসলে এই শহরের একটা নিজস্বতা আছে, সৌন্দর্য আছে। ত্রিফলা আলো দিয়ে শহরকে সাজানো যায় না। বরং আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত, শহরের জলে আর্সেনিকের প্রভাব বাড়ছে কি না। বা সরকারি হাসপাতালগুলোতে মানুষ আরও বেশি সেবা পাচ্ছেন কি না।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.