প্রথমবার কলকাতায় আসার স্মৃতিটা এখনও বেশ মনে আছে আমার। সালটা ১৯৫৯। আমার তখন মাত্র ৬ বছর বয়স। বাবা-মায়ের হাত ধরে যখন আমাদের গ্রামের বাড়ি শ্যামনগর থেকে ট্রেনে উঠেছিলাম তখনও ভাবিনি ছোট্ট মফসসল থেকে সটান গিয়ে একটি জনসমুদ্রের মধ্যে পড়ব। কু ঝিক ঝিক শব্দে ট্রেনটা বেশ ছুটে যাচ্ছিল। ‘অপু’-র মতোই অবাক চোখে ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে চলা ইঞ্জিনটার দিকে। যখন শিয়ালদহ স্টেশনে এসে পৌঁছলাম, চারিদিকে এত লোকজন দেখে রীতিমতো ভয়ই পেয়েছিলাম। সর্ব ক্ষণ মায়ের হাত ধরে ছিলাম, পাছে হারিয়ে যাই! গন্তব্য ছিল বেলেঘাটায় আমার এক মাসির বাড়ি। যাওয়ার পথে আরও এক আশ্চর্যের মুখোমুখি হলাম: দোতলা বাস। ছোট্ট মনে প্রথম প্রশ্ন ছিল, বাস আবার দোতলাও হয়? পরে একে একে মায়ের কাছে অনেক প্রশ্ন করেছিলাম, রিকশা হাতে টানা হচ্ছে কেন? এখানে এত লোক কোথায় থাকে? ইত্যাদি ইত্যাদি। এর পর জীবনের বেশির ভাগ সময় কলকাতায় থাকলেও, প্রথম বার কলকাতা দেখার সেই রোমাঞ্চ আজও আমায় ছ’ বছরের ছোট্ট শিশুতে পরিণত করে।

তবে দ্বিতীয়বার আসার কাহিনি বেশ রোমাঞ্চকর। প্রথম বার আসার দু’ বছর পরের ঘটনা। ১৯৬১ সালে আমার মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাজরার চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এক দিন মা-কে দেখব বলে স্কুলে যাওয়ার নাম করে উঠে পড়লাম ট্রেনে। বয়স তখন মাত্র আট বছর। শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছবার আগে ট্রেনটা বেশ খানিক ক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। সেই সময় ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ি। বিনা টিকিটেই ট্রেনে উঠেছিলাম। ধরা পড়ার ভয় রেল লাইন ধরে হেঁটে জনবহুল রাস্তায় উঠলাম। বাড়িতে বাবা-দাদার মা-কে দেখতে যাওয়ার আলোচনায় বারবার ৩নং বাসের উল্লেখ শুনেছিলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবছি কখন সেই বাসের দেখা পাব। কিছু ক্ষণ পরেই একটি বাস রাস্তা দিয়ে যেতে দেখে পেছন পেছন ছুটতে শুরু করলাম। যত ক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায়, ততটা ছুটে আবার পরের বাসের অপেক্ষা। এই করে অবশেষে হাসপাতালের দরজা অবধি তো পৌঁছোনো গেল, কিন্তু ভেতরে যাব কী ভাবে! অন্য কোনও রাস্তা না দেখে আশুতোষ কলেজের দোতলার বারান্দায় উঠে অপলক নয়নে তাকিয়ে ছিলাম হাসপাতালের দিকে, যদি মা-কে এক বার দেখা যায়। বিকেলে অফিস-ফেরত বাবা এবং অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে মা-কে দেখে বাড়িতে ফিরে যথেষ্ট উত্তম-মধ্যম জুটেছিল। তখন বোঝার বয়স না হলেও এখন বুঝি, কাজটা বেশ বিপজ্জনক ছিল, ঘটতে পারত দুর্ঘটনাও।
সোনার জুটি: মোহনবাগানের ভরসা সুব্রত-সত্যজিত্। নিজস্ব চিত্র।
কলকাতাকে নিয়ে আমার নস্টালজিয়ার একটা বড় অংশ জুড়েই রয়েছে মোহনবাগান, ময়দান আর সিনেমা। আমার থেকে বয়সে সামান্য বড় এক বন্ধু ছিল, নাম বুড়ো। তার হাত ধরে মোহনবাগান মাঠে আমার প্রথম খেলা দেখতে আসা। এখনও মনে আছে, তখন টিকিটের দাম ছিল ৪৫ পয়সা। তবে খেলা দেখার পয়সা আমায় জমাতে হত। আর তার জন্য বাজারে যাওয়া ছিল শ্রেষ্ঠ উপায়। হিসেব করে দেখেছিলাম, একটা ম্যাচ দেখতে খরচ হত ১ টাকা ১০ পয়সা। তখন ফুটবল খেলার সুবাদে বাজারের অনেক লোকই আমায় চিনতেন। ফলে মাঝেমধ্যেই বিনা পয়সায় বাজারের ফল, তরিতরকারি জোর করে দিয়ে দিতেন। আর এই ভাবেই রোজ বাজার থেকে ১০ পয়সা ২০ পয়সা জমিয়ে তবে একটা করে ম্যাচ দেখতে পারতাম। সেটাই তখন ছিল বড় প্রাপ্তি। খেলা দেখতে দেখতে ভাবতাম আমিও এক দিন এই মাঠে খেলব।

যে সব চিত্রাভিনেতাদের রুপোলি পর্দায় দেখেছি, খেলার সুবাদে পরবর্তী কালে এঁদের অনেককে খুবই সামনে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। বর্তমানে বেশ কয়েক জনের সঙ্গে আমার সম্পর্কও বেশ ভাল। তেমনই নিয়মিত জলসায় যাওয়ার সুবাদে সংস্পর্শে এসেছিলাম অনেক নামকরা গায়ক-গায়িকার। এঁদের মধ্যে যাঁদের নাম না বললেই নয় তাঁদের মধ্যে প্রথম জন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। তিনি আমায় নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করতেন। একজন এত বড় মাপের শিল্পী অথচ কি অমায়িক ব্যবহার। দ্বিতীয় জন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনিও আমায় খুব ভালবাসতেন। আমায় ভাগ্নে বলে ডাকতেন।

১৯৭৪ সালে মোহনবাগানে খেলা চলাকালীন মেসে থাকতাম। তখন কলকাতাকে অন্য রকম ভাবে দেখতে শিখলাম। অনুভব করলাম কলকাতার উষ্ণতা। শহরের প্রাণচঞ্চল রূপটা তখন উপভোগ করতাম তারিয়ে তারিয়ে। তখনকার মানুষের মনের মতোই শহরটা অনেক পরিষ্কার ছিল। রাস্তাঘাট এত নোংরা ছিল না। কলকাতায় এসে প্রথম দেখা জিনিসগুলোর মধ্যে দোতলা বাস আর দেখা যায় না, হাতে টানা রিকশা খুবই কমে গেছে, শহরের সামান্য অংশেই চলে, ঘোড়ায় টানা গাড়ি আজ ভিক্টোরিয়া দেখার সঙ্গে সমার্থক হয়েছে, আর ট্রামও হয়তো উঠে যেতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে রুচিবোধও এখন ‘প্রাচীন’ কলকাতার বাসিন্দা। তখন মাঠে খেলা চলাকালীন কেউ গালাগাল দিলে বা ইট ছুঁড়লে তার সদস্যপদ বাতিল করা হত। এখন দর্শকরা অনেক বেশি হিংসাত্মক। নির্বিকার চিত্তে গালাগাল দিতে আজ তাদের আটকায় না। তখনও হত, তবে এখন খেলার মাঠ নিয়ে যে রাজনীতি হচ্ছে তার প্রভাব খেলোয়াড় থেকে দর্শক সবার মনেই পড়েছে। আমি ছোটবেলায় বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্ল সেন-এর মতো রাজনীতিবিদদের কথা শুনে বড় হয়েছি। আজকের রাজনীতি বড্ড বেশি কদর্য। এসব দেখে মাঝে মাঝে বেশ কষ্ট হয়। তখন পথে এত গাড়ি চলত না, যাতায়াত ব্যবস্থা এতটা সুগম হয়নি, রাস্তায় এত আলো বসেনি, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণ তৈরি হয়নি, ঝা চকচকে শপিং মল ছিল না, অনেক কিছুই ছিল না। এখন এ সব কিছুই হওয়ার পরেও কয়েকটা জিনিসের অভাব খুব বেশি করে বোধ হয়, আন্তরিকতা, সততা। তবে দিনের শেষে আমি কলকাতাকে ভালবাসি। এটা আমার শহর। এখনও যখন ইলিশ-চিংড়ির যুদ্ধে ফুটবল জেতে, দর্শকরা মাঠে গিয়ে গোওওওওলললল... বলে চিত্কার করে, তখন মনে হয় — কলকাতা আছে কলকাতাতেই।

 
 

 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.