জনপদ
|
বাগ ও বাজার |
‘‘সে ভোলানাথ নইরে আমি, সে ভোলানাথ নই।
আমি ময়রা ভোলা হরুর চেলা বাগবাজারে রই।’’
ফিরিঙ্গি কবিয়াল অ্যান্টনির চাপানের উতোরে বলেছিলেন বাগবাজারের কবিয়াল ভোলা ময়রা। ওই ভোলা ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগের লোক। বাগবাজারের পরিচিতি তারও অনেক আগে থেকে। জায়গাটি প্রাচীন সন্দেহ নেই, কিন্তু সমস্যা নামকরণের উৎস নিয়ে। কেউ কেউ মনে করেন, ফার্সি শব্দ ‘বাগ’ অর্থাৎ বাগান এবং আরবি শব্দ ‘বাজার’ অর্থাৎ জিনিসপত্র বিক্রির জায়গা মিলেমিশে ‘বাগবাজার’ নামটি এসেছে। সেই তত্ত্ব অনুসারে ধরে নিতে হয়, ওই অঞ্চলে একটি বাগান ছিল এবং ছিল একটি বাজারও। প্রথমে খোঁজ করা যাক বাগানের। |
|
কলকাতার পুরনো ইতিহাস থেকে দেখা যাচ্ছে, এখন যেখানে বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব হয় সেই জায়গায় ছিল এক বিশাল বাগান। বাগানের মালিক ক্যাপ্টেন পেরিনের নামানুসারে লোকে বলত ‘পেরিন সাহেবের বাগান’। খুব সাজানো সেই বাগান বিস্তৃত ছিল হুগলি নদী পর্যন্ত। নদীপথে সাহেব-মেমরা মাঝে মাঝে ওই বাগানে ফুর্তি করতে আসতেন। কিন্তু ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়।’ পেরিন সাহেবের সুদিনও ফুরিয়ে গেল এক দিন। ঋণের দায় ওই বাগান নীলামে উঠল। ১৭৫২ সালে বাগানটি ২৫০০ টাকায় কিনে নেন জন জেফানিয়া হলওয়েল। কিন্তু মাত্র তিন বছরের মধ্যে তিনি আবার বিক্রি করে দেন প্রথম ফোর্ট উইলিয়ম কেল্লার অধ্যক্ষ ক্যারোলাইন ফ্রেডরিখ স্কটকে। স্কট সাহেব সেখানে বারুদ বা গান পাউডার তৈরির কারখানা খোলেন। অল্প দিন পরে তিনি মারা গেলে ওই কারখানা-সহ বাগানের মালিকানা বর্তায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপরে। কিছু কাল পরে বারুদ কারখানাটিও উঠে যায়।
চার্নক-পূর্ব যুগে তো বটেই তার পরেও দীর্ঘ কাল পুরো সুতানুটি অঞ্চলটাই ছিল বাজার এলাকা। শোভাবাজার, হাটখোলা অঞ্চলগুলির প্রসিদ্ধিই ছিল ‘হাট বাজার’-এর জায়গা হিসেবে। আপজন-এর ম্যাপে (১৭৯৪) ওল্ড পাউডার মিল বাজার নামে একটি বাজারের উল্লেখ রয়েছে। পেরিনের বাগ (বাগান) আর পাশের এই বাজার মিলেই ‘বাগবাজার’ নামের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। কেউ কেউ আবার বলেন, ওই অঞ্চলে হুগলি নদীর একটি বাঁক আছে। বাঁকের তীরে বসা বাজার থেকেও বাগবাজার নামের উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। |
বসুবাড়ি |
গোকুলচন্দ্র মিত্রের দালান |
|
শহর কলকাতার অন্যতম প্রাচীন বাগবাজার অঞ্চল নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এখানকার নাটকের দল ‘বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার’ই ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামে আত্মপ্রকাশ করে ১৮৭২-এ। নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ বাগবাজারেরই বাসিন্দা। মহেন্দ্রনাথ-পশুপতি-নন্দলাল বসুর ‘বাগবাজার বসুবাড়ি’ শুধু রামকৃষ্ণ-রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্যই নয়, স্বদেশি আন্দোলনের অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনার সাক্ষীও। ওই বাগবাজারেই শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য বলরাম বসুর বাড়ি থেকে সূচনা হয়েছিল আজকের ‘শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন’-এর। এই অঞ্চলেই একদা বসবাস করে গিয়েছেন ভগিনী নিবেদিতা। শুধু বাংলা নয় সমগ্র ভারতীয় ভাষার মধ্যে প্রথম কোষগ্রন্থ (এনসাইক্লোপিডিয়া) হিসেবে চিহ্নিত ‘বিশ্বকোষ’ (বাইশ খণ্ডের ওই কোষগ্রন্থের শেষ খণ্ডের প্রকাশকাল ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) গ্রন্থের প্রণেতা নগেন্দ্রনাথ বসু থাকতেন বাগবাজারেই।
কলকাতার অন্যতম প্রাচীন এই বাগবাজারে রয়েছে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য। পুরনো কলকাতার ‘ব্ল্যাক জমিনদার’ গোবিন্দরাম মিত্র ১৭৩০-এ প্রতিষ্ঠা করেন এক বিশাল পঞ্চরত্ন মন্দির ও তাকে ঘিরে তিনটি দোচালা ও দু’টি নবরত্ন মন্দির-সহ এক ‘মন্দির কমপ্লেক্স’। সেগুলির মধ্যে একটি নবরত্ন ও একটি দোচালা মন্দির এখনও টিকে আছে চিৎপুর রোডের উপর মদনমোহনতলার কাছে। এর ঠিক বিপরীতেই রয়েছে প্রাচীন সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির। পাশেই সে যুগের আর এক বিত্তবান গোকুলচন্দ্র মিত্রের প্রতিষ্ঠা করা মদনমোহনতলা। সাবেক ২৬/১ দুর্গাচরণ মুখার্জি স্ট্রিটে (বর্তমান নাম ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ অ্যাভিনিউ) রয়েছে জগৎরাম হালদার প্রতিষ্ঠিত দোচালা শিবমন্দির। এই মন্দিরটি শহরের এক মাত্র একক দোচালা মন্দির। |
দোচালা মন্দির |
সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির |
|
এই অঞ্চলের আরও একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকীর্তি হল পঞ্চানন মুখার্জি রোড ও শেঠপুকুর রোডের সংযোগে অবস্থিত ‘ভোসড়ি শাহ’-র মসজিদ। বাগবাজার খালের উত্তরে কাশীপুর-চিৎপুর রোডের পশ্চিম দিকে অবস্থিত এই মসজিদটির নির্মাণ কাল এবং নির্মাতা সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। জনশ্রুতি— পলাশির যুদ্ধের পর সিরাজের দেওয়ান রেজা খাঁ বসবাসের জন্য সপরিবারে চিৎপুর অঞ্চলে আসেন এবং তিনিই মসজিদটি নির্মাণ করেন। পুরনো একটি ফলকে, মসজিদটি ১২১৯ হিজরায় (অর্থাৎ ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ) জাফর আলি কর্তৃক পুনর্নির্মিত হয় বলে উল্লেখ আছে। দেখভালের অভাবে কলকাতার অন্যতম সুন্দর এই মসজিদটি একেবারে জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। মুর্শিদাবাদ ঘরানার স্থাপত্যের মতো তিন গম্বুজযুক্ত এই মসজিদটি যে আটটি চারকোণা মিনার গম্বুজের দু’পাশে ছিল, তার কয়েকটি নষ্টও হয়ে গিয়েছে। ত্রিখিলানযুক্ত প্রবেশপথটিরও ভগ্নদশা। গোটা মসজিদের বাইরের দেওয়াল জুড়ে থাকা পঙ্ক-পলেস্তরার (চুন ও বালি দিয়ে তৈরি অলঙ্করণ) নকশার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কলকাতা পুরসভার ঐতিহ্যবাহী পুরাকীর্তির তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সরকারের তরফ থেকে কোনও দিনই সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ নিজেরা চাঁদা তুলে পরিত্যক্ত এই মসজিদটিকে সংস্কার করলেও অপটু সংস্কারের ফলে মসজিদটির সৌন্দর্য একেবারেই হারিয়ে গিয়েছে।
|
|
খাবার-দাবারের ক্ষেত্রেও বাগবাজারের সুনাম কিছু কম নয়। মিষ্টান্নের ইতিহাস থেকে জানা যায়, রানাঘাটের পালচৌধুরী জমিদারদের রসনার তৃপ্তির জন্যে ফুটন্ত চিনির রসে ছানার গোলা ফেলে নাকি ‘রসগোল্লা’ নামে এক মিষ্টি তৈরি করেছিলেন এক ময়রা। সেই রসগোল্লাকে আরও পরিশীলিত করে ‘স্পঞ্জ রসগোল্লা’য় উন্নীত করেন বাগবাজারের নবীন ময়রা। চিতপুর রোডের উপরে ছিল তাঁর দোকান। এখন আর সেই দোকান নেই, সেখানে উঠেছে বহুতল বাড়ি। বাগবাজারের তেলেভাজার সুনামও কলকাতাজোড়া।
|
তথ্য: গৌতম বসুমল্লিক
ছবি: লেখক ও ফাইল চিত্র |