আসতে দেরি, যেতে নয়, কর্মসংস্কৃতির বদল নেই নবান্নেও
কাল সাড়ে ১১টা নাগাদ রবীন্দ্র সদনের সামনে এসে দাঁড়াল সরকারি বাস। সামনে লেখা ‘নবান্ন যাইবে’। জনা তিরিশেক যাত্রী বসে রয়েছেন। তার মধ্যে ২৫ জনই সরকারি কর্মী। সকলেই যাবেন হাওড়ার মন্দিরতলায়, রাজ্য প্রশাসনের নতুন সদর দফতরে।
বাস যখন পৌনে ১২টায় নবান্নে পৌঁছল, কন্ডাক্টর হাঁক মেরে বললেন, নেমে পড়ুন। সেই শুনে কার্যত আড়মোড়া ভেঙে সিট থেকে উঠে দাঁড়ালেন কয়েক জন। কিন্তু এত বেলায় নবান্নে! নির্দিষ্ট সময়ে অফিস পৌঁছনোর নিয়ম-কানুন কি উঠে গেল? মুখ খুললেন এক জন। নাম না লেখার শর্তে অর্থ দফতরের ওই প্রবীণ কর্মী বললেন, “ঢুকেই প্রথমে বেশ ক’টা জলের পাউচ নিতে হবে। এখানে জলের যা মান তাতে মুখে তোলা যায় না। তার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হবে। এর পরে লিফটে যেতে হবে ১২ তলায়। সেখানেও আবার লাইন।” ওই কর্মী সাড়ে ১২টার আগে দফতরে পৌঁছতেই পারলেন না। তাঁর মতোই ওই বাসের অন্য সরকারি কর্মীদেরও।
তা হলে কর্মসংস্কৃতির এত ঢক্কানিনাদ কোথায় গেল?
নবান্নের একাধিক অফিসারের অভিজ্ঞতা, যাতায়াতের সমস্যা ও নতুন ভবনে পরিকাঠামোগত গাফিলতির অভিযোগ তুলে সরকারি কর্মীদের একাংশ কাজে ফাঁকি দিচ্ছেন। তাঁরা আসছেন দেরিতে, চলে যাচ্ছেন তাড়াতাড়ি। তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের এক কর্তা শুক্রবার বলেন, “আমি রোজই ১০টার মধ্যে অফিসে ঢুকি। লিফটেই উঠি। কিন্তু তখন লিফটের সামনে ভিড় থাকে না।” অর্থাৎ, ওই অফিসারের কথা অনুযায়ী, অফিসে ঢোকার নির্দিষ্ট সময়ের পরেই লিফটের জন্য লাইন দীর্ঘ হয়। তবে, নবান্নে যে পরিকাঠামোগত সমস্যা যথেষ্টই, তা-ও মানছেন একাধিক অফিসার। তাঁদের এক জন বলেন, “সেই কারণেই হাজিরার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি শিথিল করা হয়েছে। সাড়ে ১২টায় অফিসে ঢুকলেও লাল কালি দাগ পড়ে না।” কিন্তু এ নিয়ম যে দিনের পর দিন চলতে পারে না, তা মনে করেন একাধিক দফতরের পদস্থ কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, “হাজিরা নিয়ম শিথিল করার সুযোগ নিচ্ছেন কর্মীদের একাংশ।”
শুধু দেরিতে অফিসে ঢোকাই নয়, বেলা ৪টে বাজলেই অফিস ছাড়ার ধূম পড়ছে নবান্নে। শুক্রবার ভবন লাগোয়া বাস টার্মিনাসে দাঁড়িয়ে কৃষি দফতরের এক মহিলা কর্মী বলেন, “আমি গড়িয়া যাব। আগে মহাকরণ থেকে বেরিয়েই বাস পেতাম। কিন্তু এখানে একটা বাস চলে গেলে এক ঘণ্টার আগে পরের বাস মেলে না।” তাঁর অভিযোগ, কলকাতা ও শহরতলির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে সংখ্যক বাস নবান্নে যাতায়াত করবে বলে সরকার বলেছিল, বাস্তবে তা মিলছে না। কিন্তু এটা কি অফিস ফাঁকির কারণ হতে পারে? জবাব না দিয়ে হনহন করে বাস ধরতে এগিয়ে গেলেন ওই মহিলা কর্মী।
অথচ, সরকারি অফিসে ঢোকা ও বেরোনোর নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। সকাল ১০টায় ঢোকা, সাড়ে ৫টায় বেরোনো। সওয়া ১০টার পরে ঢুকলে ‘লেট মার্ক’। পৌনে ১১টার পরে ঢুকলে অনুপস্থিত। কিন্তু সেই নিয়মের ধার ধারছেন না কেউ। কর্তৃপক্ষ হাজিরার নিয়ম অনেকটা শিথিল করেছেন। কর্মীদের অবশ্য যুক্তি, হাজিরায় কড়াকড়ি করে কী লাভ? এখনও অনেক দফতরে মহাকরণ থেকে বয়ে আনা ফাইলভর্তি গাঁটরি খোলা যায়নি! বৃহস্পতিবার গোটা নবান্ন পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখার সময় সেই ছবি নজর এড়ায়নি মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের। নবান্নের এক কর্তার কথায়, “মুখ্যসচিব পুরো ভবন ঘুরে দেখার পরে শুক্রবার থেকে একাধিক দফতরে গাঁটরি খোলার কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু তাতে বিপত্তি বেড়েছে বই কমেনি।” কেন?
ওই কর্তা জানান, প্রথমে বলা হয়েছিল, মহাকরণের সব পুরনো আসবাব নবান্নে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। নতুন কেনা হবে। কিন্তু পরবর্তী কালে আর্থিক সংকটের কারণ দেখিয়ে নতুন আসবাব কেনায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ফলে নবান্নে বেশ কিছু দফতরে আলমারির ঘাটতি রয়েছে। তাই বস্তা থেকে বের করে ফাইল ফেলে রাখতে হয়েছে মাটিতে। এই যুক্তি দেখিয়েই অনেক কর্মী ইচ্ছে মতো আসছেন-যাচ্ছেন বলে কর্তাদের অভিযোগ।
কর্মীদের হাজিরা নিয়ে গোয়েন্দাগিরি করছে পূর্ত দফতরও। লিফটে কেন এত লাইন হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে গত কয়েক দিন ধরে আসা-যাওয়ার সময়ের ভিডিও রেকর্ডিং করছে তারা। দেখা যাচ্ছে, সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সমস্ত লিফটই প্রায় ফাঁকা। ভিড় শুরু হচ্ছে পৌনে ১১টা থেকে, নিয়মমতো যখন হাজিরা খাতায় লাল কালি পড়ে যাওয়ার কথা। সেই ভিড় ১২টা-সাড়ে ১২টা পর্যন্ত থাকছে। আবার ঢোকার সময় লিফটে লাইন থাকলেও অফিস ছুটির সময় কখনওই লাইন হচ্ছে না। কারণ, অধিকাংশ কর্মীই ৪-৫ ঘণ্টা অফিসে থেকে চলে যাচ্ছেন। ফলে, অফিস ছুটির নির্দিষ্ট সময়ে কোনও লিফটেই ভিড় নেই!
এত কিছুর পরেও এখনই কর্মীদের আসা-যাওয়ার ব্যাপারে কোনও কড়া মনোভাব নেওয়া হবে না বলেই রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, বেশির ভাগ দফতর এখনও পর্যন্ত গুছিয়ে বসতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে দফতরের একাংশ এখনও মহাকরণে কিংবা অন্য ভবনে থেকে যাওয়ায় কাজের সমন্বয়ে সমস্যা হচ্ছে। সরকারি এক মুখপাত্রের কথায়, “মহাকরণে জায়গা অনেক বেশি। এখানে অনেক কর্মীকে বসতে দেওয়া যাচ্ছে না। কাজ করবে কী করে!”
সরকার পক্ষের কর্মী সংগঠনের নেতারা বিষয়টিকে আমল দিচ্ছেন না। তাঁদের মতে, “নতুন জায়গায় ধাতস্থ হতে তো একটু সময় লাগবেই। তা ছাড়া, পুজোর পরে কালীপুজো পর্যন্ত কর্মীদের মধ্যে গা-ছাড়া ভাব থাকেই। সেই মনোভাবেই পরিবর্তন হয়নি।” বিরোধী কর্মীসংগঠনগুলির অবশ্য অভিযোগ, “এর থেকেই স্পষ্ট, প্রশাসন কী কাজ করছে!”

পুরনো খবর:





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.