|
|
|
|
স্মরণ ২ |
কেউ কি কথা রাখেনি? |
কৈশোর, এমনকী প্রথম যৌবনও হয়তো’বা ছিল নারীবর্জিত। অথচ শেষ জীবনে তিনিই কি
না প্রেম সঞ্চয় করে গেলেন! প্রেমিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ফিরে দেখলেন সমরেশ মজুমদার। |
শ্যামপুকুর স্ট্রিটের যে বাড়িতে আমি থাকি, সেই বাড়ি থেকে নব্বই বছরের বৃদ্ধের পায়ে হেঁটে গেলে সাড়ে চার মিনিটে যে বাড়িতে পৌঁছনো যায়, সেই বাড়িতেই সুনীলদার বালক-কিশোর-যৌবনবেলার প্রথম ধাপ কেটেছিল।
আটত্রিশ বছর আগে শ্যামপুকুর লেনের রকের আড্ডায় যখন শরিক হয়েছিলাম তখন সবে আমি ‘দৌড়’ লিখেছি। তাই সদ্য পরিচিতরা আগ বাড়িয়ে বলতেন, “আমাদের পাড়ায় সুনীল গাঙ্গুলি থাকতেন।”
একটি মানুষ সারা জীবন প্রেমের কথা লিখে গেল, নীরা থেকে শুরু করে গত বছরের পুজোয় মাকে নিয়ে যে অনবদ্য কবিতা লিখল, যা প্রেমের সার্থক প্রকাশ, তার কিশোর এবং প্রথম যৌবনবেলা কেমন কেটেছিল তা জানতে আগ্রহী হয়েছিলাম। কিন্তু পাড়ার যে সব মানুষ ওঁকে দেখেছেন, চিনতেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে হতাশ হলাম।
সুনীলদার বাবা ছিলেন টাউন স্কুলের শিক্ষক, কাকাও তাই। অল্প বয়েসের সুনীলদা থাকতেন চুপচাপ। মেয়েবন্ধু দূরের কথা, ঘনিষ্ঠ ছেলেবন্ধুর কথা মনে করতে পারেননি কেউ।
বাড়ি থেকে কয়েক পা দূরে বিখ্যাত অভিনেতা রবীন মজুমদার থাকতেন, আর একটু এগোলেই রামধন মিত্র লেনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, কিন্তু তাঁদের সঙ্গ পেতে সুনীলদা উৎসাহী ছিলেন না। এমনকী শ্যামপুকুরের বিখ্যাত রকে আড্ডা মারতে কেউ তাকে দেখেননি। ‘অর্ধেক জীবন’ পড়ে জেনেছি, যা কিছু কর্ম এবং দুষ্কর্ম তিনি করেছেন, তা পাড়ার বাইরে, শিক্ষক পিতার এলাকায় নয়। অথচ তখন ও পাড়ার রেস্টুরেন্টগুলোতে তরুণ কবি-শিল্পী-ইউনিয়ন করা ছাত্রদের জমজমাট আড্ডা বসত। সঞ্জীবনি কেবিন, ফ্রেন্ডস কেবিন, মলয় গ্রীনের আড্ডায় আমিও গিয়েছি। |
|
ছবি: অশোক মজুমদার। |
হাতিবাগানের ওপরে ‘মিতালি’ নামে একটি রেস্টুরেন্টে পরদা ফেলা কেবিন ছিল। কলেজের ছেলেরা সদ্য পরিচিতা সহপাঠিনীকে নিয়ে চোরের মতো সেখানে ঢুকে মুখোমুখি বসত। মাঝখানের টেবিলের ব্যবধান দূর করতে সময় লাগত। সুনীলদার পক্ষে ‘মিতালি’র কেবিনে যাওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। ‘মিতালি’র বৃদ্ধ বেয়ারা, যিনি সুনীল গাঙ্গুলির ‘রাধাকৃষ্ণ’ পড়েছেন, দু’দিকে মাথা নেড়ে বলেছেন, “না, না, তাঁকে কখনও দেখিনি এখানে আসতে।” জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “হয়তো এসেছেন, আপনি চিনতে পারেননি।” উত্তরটা ছিল, “কী যে বলেন বাবু, আমি টাউন স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিলাম, ওঁকে চিনব না?”
অর্থাৎ সুনীলদার কৈশোর এবং প্রথম যৌবনবেলা নারীবর্জিত ছিল? বাবার শাসন, পরিবারে অর্থাভাব ইত্যাদি তাকে কি তথাকথিত ‘ভাল ছেলে’ হতে বাধ্য করেছিল? আমরা দেখেছি বাল্যকালে অত্যন্ত দুষ্টু ছেলে বড় হলে অত্যন্ত শান্ত হয়ে যায়। বিপরীতটাও ঘটে আকছার। কবিতা লিখতে শুরু করে, বোহেমিয়ান বন্ধুদের সঙ্গে খালাসিটোলায় যাওয়া, মাঝরাতে কলকাতার ফুটপাথে টলোমলো পায়ে হাঁটা কি প্রথম জীবনের নিস্তরঙ্গ জীবন থেকে বেরিয়ে আসার সচেষ্ট প্রয়াস?
সুনীলদার লেখায় আমি ভণ্ডামি দেখিনি। ‘আত্মপ্রকাশ’-এ যখন নায়ক বলে যে সে কাল রাতে প্রচুর মদ্যপান করেছিল তখন বাংলা সাহিত্যের পুরনো পাতা হাতড়ে দেখেছি, কেউ কেউ নায়ককে দিয়ে এই কথা বলাতে সাহস পাননি।
নিয়মিত মদ্যপান করতেন এমন একজন জনপ্রিয় লেখককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আপনি যে পান করেন তা লিখতে পারবেন?” তিনি চোখ বড় করে বলেছিলেন, “পাগল! সব পাঠক হাওয়া হয়ে যাবে।” সুনীলদা এই ভয় পাননি, তাই তাঁর সত্যি কথা বলাটাকেই পাঠক সানন্দে গ্রহণ করেছে।
তাঁর বিখ্যাত প্রেম পর্বটির কথা তিনি নিজেই লিখেছেন। তখনও গদ্য লেখেননি নিয়মিত, আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন। গিয়ে পরিচয় হয়েছিল এক শ্বেতাঙ্গিনীর সঙ্গে। ঘনিষ্ঠতা হল। সেই প্রেমের বর্ণনা সুনীলদা বলতে না চাইলেও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কিছুটা জেনেছি। যার স্বাভাবিক পরিণতি হত বিয়েতে। আমেরিকায় চাকরি করতেন প্রেমিকাকে স্ত্রী হিসেবে সঙ্গে নিয়ে। তখনই সমস্যা সামনে এসে দাঁড়াল। রাধাকে রাখবেন, না কলম? সাদা কাগজে স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ সাজাবেন, না স্ত্রীর নীল চোখের দিকে তাকিয়ে বলবেন, “আই লাভ ইউ।” দুটোরই ছিল সমান টান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছিল বাংলায় না লিখে বেঁচে থাকা অর্থহীন। চলে এসেছিলেন।
নিউইয়র্কের কুইন্স বুলেভার্ডের একটি হোটেলে ক’দিন একসঙ্গে ছিলাম। কলকাতায় থাকলে বছরে যত দিন আড্ডা মেরেছি, হিসেব করলে বিদেশে তার চেয়ে অনেক বেশি সময় কাটিয়েছি ওঁর সঙ্গে। সেই হোটেলে মধ্যরাতে সুনীলদা বলেছিলেন, “তখন বয়স কম বলে আবেগ বেশি ছিল।” বলেছিলাম, “ভাগ্যিস ফিরে এসেছিলেন নইলে বাঙালি বঞ্চিত হত।”
সুনীলদা হেসে বলেছিলেন, “দূর কী লিখেছি, কিছুই না।” |
|
ছবি: তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়। |
নানান সময়ে সুনীলদাকে নিয়ে যেসব প্রেমকাহিনি প্রচারিত হয়েছে সেগুলো সত্যি না মিথ্যে তা যাচাই করা মূর্খামি। কিন্তু সুনীলদার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য কুড়ি থেকে ষাটের মহিলাদের উদ্বেলিত হতে দেখেছি। চন্দনের বনে যাওয়ার জন্য তাঁরা যে এক কথায় রাজি, তা বুঝতে অসুবিধে হত না।
অনুষ্ঠান চলছে। মঞ্চে সুনীলদা বসে আছেন, দ্বিতীয় সারিতে বসা এক মহিলা এক পলকের জন্যও অন্য দিকে চোখ সরাননি, এও তো দেখেছি। আমার মনে হয় এই সব নারীর কাছ থেকে সুনীলদা টুকরো টুকরো প্রেম গ্রহণ করেছেন, যা তাঁর কবিতার লাইনে লাইনে সাজাতে পেরেছিলেন। আমি কোনও নারীকে জানি না যিনি শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে সুনীলদার বিপক্ষে কথা বলেছেন।
নিউ জার্সির এক বাড়িতে ডেকে রাত একটার সময় একজন মহিলা সুনীলদাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। পরে জানলাম, মহিলার সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্ক বিচ্ছেদের মুখে দাঁড়িয়ে, ভেঙে পড়েছিলেন তিনি, সান্ত্বনা চেয়েছিলেন সুনীলদার কাছে। মানুষ কার কাছে সান্ত্বনা চায়?
সুনীলদার কবিতার লাইনে লাইনে ভালবাসার অলঙ্কার ছড়ানো। তা মানবীর জন্য যেমন, কবিতার জন্যও তেমন। কখনও অসহায় গলায় বলেন, “কেউ কথা রাখে না।” জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “সবাই যদি কথা রাখত?” চোখ বড় করে বলেছিলেন, “সেকী! তা হলে মিলিটারিদের জীবন হয়ে যেত।”
আমার ধারণা, সুনীলদা প্রেম নিয়েছিলেন, প্রেম করেননি। প্রতিভাবান মানুষেরা এমনই হয়ে থাকেন। নদীর মতো ঘাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে বয়ে যান তাঁরা। যেমন রবীন্দ্রনাথ। ঘাট বলে নদী আমার, নদী বয়ে যায়।
একবার একটু আফশোসের গলায় বলেছিলাম, “সুনীলদা, আপনাকে হিংসে হয়।”
অবাক হলেন। বললেন, “কী রকম?” “যদি আপনার মতো কবিতা লিখতে পারতাম, যদি নীরার মতো ‘আছে তবু নেই’ গোছের নারীচরিত্র তৈরি করতে পারতাম, তা হলে প্রচুর সুন্দরী সুনীলদা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কৈশোর এবং প্রথম যৌবনের প্রায় ব্রহ্মচারী, বাকি জীবনে প্রেম সঞ্চয় করে গেছেন। ভাগ্যিস করেছিলেন। নইলে বাংলা কবিতা নীরক্ত থাকত। তিনি যতই লিখুন, একজন কি কথা রাখেননি? |
|
|
|
|
|