|
|
|
|
স্মরণ ১ |
আমাদের মনের মানুষ |
উত্ত্যক্ত হয়েও সৌজন্য হারাননি কোনও দিন। আত্মশ্লাঘার ধার দিয়েও যেতেন না। দফতরে তাঁর উপস্থিতিতেই
হালকা হাওয়ার প্রবাহ বয়ে যেত। সহকর্মী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের তিরিশ বছরের সঙ্গলাভের স্মৃতিতে হর্ষ দত্ত। |
‘গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কেবা’। জানি এই পঙক্তিটি বহু ব্যবহারে জীর্ণ, ক্লিশে। কারও বিশালতাকে বোঝানোর জন্য এমন একটি লাইন বেশ জুতসই। তা সত্ত্বেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো একজন পরিপূর্ণ মানুষ সম্পর্কে ওই কথাগুলোই ঘুরে ফিরে এসে যায়। ভাবনায়, অনুভবে, স্বপ্নে।
রবীন্দ্রনাথকে দেখিনি। তাঁর জীবৎকালে আমাদের জন্মই হয়নি তো দেখার অবকাশ! বাঙালির সর্বোত্তম প্রতীকপুরুষকে না-দেখার বেদনা কি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মুছিয়ে দিয়েছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে বলব, না। তেমন মহান কোনও ব্রতপালনে ওঁর আগ্রহ ছিল না বিন্দুমাত্র। বরং চতুর্দিকে নানা রবীন্দ্রনাথের প্রশস্তিতে উনি বিরক্তই হতেন। তা হলে? এর উত্তর তিনি নিজেই।
রবীন্দ্রনাথের পর এত বিপুল পরিমাণ গদ্য-পদ্য আর কেউ লিখে উঠতে পারেননি। আমৃত্যু এই সৃষ্টিশীলতায় তিনি অক্লান্ত এবং বর্ণময়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ধাঁচে সুনীলসঙ্গীত রচনা থেকে বিরত থেকেছেন। কিন্তু এইটুকু বাদ দিলে পূর্বসূরির মতোই বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ভূমিখণ্ডে তাঁর জমিদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তবে লেঠেল দিয়ে নয়, সহজাত প্রতিভায়, প্রভূত পরিশ্রমে, সৃষ্টিমগ্নতার আনন্দে।
ওঁর এক অনুজ সহকর্মী হিসেবে ওঁকে তিরিশ বছর ধরে কাছ থেকে দেখেছি, আর বিস্মিত হয়েছি। সুনীলদা প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে, চাকরির শর্ত হিসেবে কিংবা কোনও অজুয়া গ্রহণ করে, অনুরোধে-উপরোধে এত লিখেছেন, এত লিখেছেন যে পরিমাপ করাই কঠিন। অথচ ছড়িয়ে থাকা অপরিমেয় রচনা তাঁকে অমর করে রাখবে, এ কথা কখনও ভাবেননি। লেখাটি পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কোনও কৌশলে তিনি বিশ্বাস করতেন না। ওঁর সহজ গদ্যের নির্ভার চালই বলে দিত, মানুষটা অন্তর ছুঁতে চাইছেন, মস্তিষ্কের জিমন্যাসিয়াম নয়। এইখানেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের সময়ের রবি, আমাদের এই সময়, আমাদের পূর্ব-পশ্চিম, আমাদের মনের মানুষ। |
|
ছবি: সমর দাস। |
আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগ থেকে যখন দেশ পত্রিকায় বদলি হয়ে এলেন, তখন সদ্য সাংবাদিকতার চাকরিতে হাতে-খড়ি-হওয়া আমার মনে হয়েছিল, এমন একটা অবিশ্বাস্য মুহূর্ত তৈরি না হলেই তো পারত! লোকের কাছে কী করে বলব আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সহকর্মী? উলটো দিক থেকে মানুষ কেন মেনে নেবে সুনীলদা আমার সহকর্মী? এমন অবাস্তব ঘটনা কখনও ঘটে নাকি!
আমি বহু দিন সঙ্কোচের সঙ্গে বলেছি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দেশ পত্রিকায় আছেন, আমিও সেখানে কর্মসূত্রে আছি। এই কথা শুনে অনেকের চোখেই কৃপাদৃষ্টির আভাস দেখেছি। ছোকরা বলে কী! যদি সত্যিই তুমি সুনীলের সঙ্গে একই ঘরে বসে কাজ করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে থাকো, তা হলে সে তোমার ঊর্ধ্বতন চোদ্দো ও অধস্তন চোদ্দো পুরুষের ভাগ্য! তাঁরা উদ্ধার হয়ে গেলেন!
দেশ পত্রিকার চাকরিতে ঢুকে দেখলাম সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ বাগচী এবং কবি সুনীল বসু নিজেদের বিভা ছড়িয়ে আগে থেকেই আছেন। এর পর সুনীলদা, তারও কিছু পরে আনন্দবাজারের বার্তাবিভাগ থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বাইরে থেকে আবুল বাশার ও জয় গোস্বামী যখন দেশ-এ যোগ দিলেন, তখন সে এক রৈ রৈ কাণ্ড। নক্ষত্র সমাবেশ যেন সীমাহীন। আর সকলের মধ্যমণি হয়ে প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তো আছেনই! শুধু লেখালিখিতেই নয়, সেরার সেরাদের চাকরির ঠিকানাও তখন দেশ। শুনেছিলাম বার্তা বিভাগ থেকে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ নাকি দেশ-এ আসবেন। তবে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
আজ আর স্বীকার করতে লজ্জা নেই, তখন পত্রিকা দফতরে ঢুকলেই অপারবিস্ময় আমার পাশে পাশে ছায়ার মতো সেঁটে থাকত। সুনীলদা যখন এলেন, বিস্ময়ের গাঢ়তা বেড়ে গিয়েছিল। এমন একজন খ্যাতিমান মানুষের পাশে বসে কাজ করছি! ভাবতে ভাবতে কত বার কাজে ভুল হয়ে যায়নি কী!
আসলে, এক গোপন মুগ্ধতা আমাকে ঘিরে রেখেছিল। বাইরের জগতে যিনি এত বিখ্যাত, এত মানুষের উন্মাদনা যাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে, তিনি কাজের জায়গায় কত স্বচ্ছন্দ, কত সহমর্মী! কোনও অহংকার নেই, শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার চেষ্টা নেই।
প্রতিটি মানুষের অনেক সত্তা, কিন্তু তাদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক, সহজ বন্ধন তৈরি করতে পারা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। অহং আমাদের বাধা দেয়, আত্মশ্লাঘা বিপথে চালিত করে। কিন্তু সুনীলদা আশ্চর্য ক্ষমতায় ও দক্ষতায় নিজের সব ক’টি সত্তাকে বেঁধে রাখতে পারতেন। কখনও দেখিনি এমন ভাব করছেন মনে রেখো, আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বরং রীতিমতো উত্ত্যক্ত হয়েও সৌজন্য, শালীনতা ও ধৈর্য রক্ষা করেছেন। ভেতরে ভেতরে হয়তো ক্ষুণ্ণ হয়েছেন, কিন্তু বাইরে বুঝতে দেননি। কখনও বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। কত অবুঝ কবিযশঃপ্রার্থী কী লেখক ওঁকে অস্বস্তিকর কথা বলতেন। সেসব শুনে আমার নিজেরই মাথা গরম হয়ে যেত। কিন্তু সুনীলদা সব সময় অনুদ্বিগ্রমনা। রাগ করতেন না। কাউকে কটু কথা বলে অপমান করতেও দেখিনি।
ওঁর কাছে অনেকেই প্রত্যাশার ডালি মেলে ধরত। যেন দেওয়া ও পাইয়ে দেওয়ার জাদুদণ্ড ও ক্ষমতা সুনীলদার হাতেই আছে। অনেককে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিবৃত্ত করতেন। আবার সত্যি সত্যি প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও যারা সামান্য যোগাযোগের অভাবে বঞ্চনার শিকার হয়ে আছে, তাদের পাশে দাঁড়াতে কখনও কুণ্ঠিত হননি। শীর্ষেন্দুদা প্রায়ই ওঁর অনুপস্থিতি বা উপস্থিতে ঠাট্টা করে বলতেন, “সুনীল হচ্ছেন বাবা তারকনাথ। ঠিক জায়গায় কেউ যদি বেল পাতা আর চোখের জলটি ফেলে আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না। সুনীল-সাগর পাড়ি দেওয়ার কসরতটি জানলেই হল।”
এসব শুনে সুনীলদা মুচকি মুচকি হাসতেন। যখন আনন্দবাজার সংস্থা কর্মীদের আইডেনটিটি কার্ড দিল এবং যখন সে-কার্ড অফিসে ঢোকা ও বেরনোর পরিচয়-জ্ঞাপক হয়ে দাঁড়াল, তখন সুনীলদা খুব মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলেন। সাধারণত উনি অফিসে আসতেন দুপুরের দিকে। তেমন কোনও তাড়াহুড়ো থাকত না। কিন্তু প্রায়ই কার্ডটা আনতে ভুলে যেতেন, কার্ড পাঞ্চ করা তো দূরের কথা।
রিসেপসনিস্ট পড়ে যেতেন ভীষণ অস্বস্তিতে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে কে না চেনেন? কার্ড ছাড়া তাঁর গতিরোধ করার মধ্যে অবশ্যই কোনও কৃতিত্ব নেই। বরং সসম্মানে তাঁকে প্রবেশ করতে দেওয়াই ন্যূনতম সৌজন্য। এদিকে কার্ড না নিয়ে আসাটাও অফিসরীতি ও নিয়ম লঙ্ঘনের সামিল। কার্ড ছাড়াই সুনীলদা ঢুকতে পারেন জেনে শীর্ষেন্দুদা হতাশ স্বরে একদিন বললেন, ভাই, সুনীলের ভুঁড়িটাই যথেষ্ট। ভুঁড়ি বাজিয়ে সুনীল ঢুকে পড়ে। আমাদের ভুঁড়ি নেই মুড়ি (মুড়ো) আছে। মুড়ি দিয়ে যেমন সুস্বাদু ঘণ্ট হয়, তেমন মুড়িতে আমাদের ঘণ্টা বাঁধতে হয়। সুনীল ছাড় পায়, আমরা কার্ড বিনে পার পাই না। এই সমস্যার সমাধান হল গাড়ির ড্রাইভারের জিম্মায় কার্ড রেখে দিয়ে। ওঁর ড্রাইভার মহেন্দ্র এসে কার্ড পাঞ্চ করে ওঁকে প্রবেশ দ্বার খুলে দিতেন। |
|
সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সন্তোষ কুমার ঘোষের সঙ্গে। ছবি: তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়। |
শীর্ষেন্দুদা চিরদিনই কৌতুকপ্রিয় মানুষ ও লেখক। প্রায়ই সুনীলদার সঙ্গে এমন মজা করতেন। কোনও সুন্দরী রমণী, যিনি সুনীলদারও গুণমুগ্ধ, তিনি হয়তো ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করার পর চলে গেলেন। তার পরই সুনীলদার অফিসে প্রবেশ। শীর্ষেন্দুদা ওঁর বিখ্যাত হাসিচাপা কৌণিক মুখটি সামান্য ঘুরিয়ে বলতেন, “একজন নিঃশব্দে এসে সশব্দে চলে গেলেন। কাঁহাতক আর অপেক্ষা করবেন বলুন তো!”
সুনীলদা হাসি লুকিয়ে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করতেন, “পুরুষ না নারী!”
শীর্ষেন্দুদার উত্তর, “নারী তো বটেই। তবে আনাড়ি। বেলা-অবেলা-কালবেলা জ্ঞান নেই। ভগবান দর্শন কি এতই সোজা!”
প্রসঙ্গটা নিয়ে আরও হাসিঠাট্টা নিশ্চয়ই হয়েছিল। সেসব আর খুঁটিয়ে মনে নেই। শুধু এইটুকু মনে আছে সুনীলদার উপস্থিতিতে দপ্তর জুড়ে একটা হালকা হাওয়ার প্রবাহ এ পাশ থেকে ও পাশ বয়ে যেত।
লেখার ব্যাপারে সুনীলদা ভীষণ নিয়মনিষ্ঠ। সময়মতো লেখা দিতে অবিশ্বাস্য পারঙ্গম। অথচ সারাদিন ধরে লিখতেন এমন নয়। আমি যত দূর জানতাম সন্ধের পর আর উনি কলম ধরতেন না। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন তাঁর বিখ্যাত অভিধানটি নির্মাণ করেছিলেন সূর্যোদয় থকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ে, তেমনই সুনীলদার লেখার সময় ছিল এই দিনের বেলা।
একদিন কথাচ্ছলে বলেছিলেন, “হরিচরণের মতো আমিও বিশ্বাস করি সূর্য ডুবে যাওয়ার পর মানুষের মেধা ও প্রজ্ঞা সুষুপ্তিতে আক্রান্ত হয়। তখন তাকে বিশ্রাম দেওয়াই বিধেয়।” শুনেছি জীবনের শেষ কয়েক বছর এই নিয়মনিষ্ঠা সুনীলদা রক্ষা করতে পারেননি। এত রকম আসনে তাঁকে অধিষ্ঠিত হতে হয়েছে, এত রকম সামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন যে দিনের বেলায় ওঁর লেখার সময়টুকু প্রায়শই চুরি হয়ে যেত! অগত্যা রাত্রে কলম ধরতে হয়েছে।
দেশ পত্রিকা এবং বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আনন্দবাজারের ইতিহাসে তিনি এক স্মরণীয় নাম এ বিষয়ে কোনও বিতর্ক নেই। বিতর্ক উঠবেও না। তাঁর প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি এই সংস্থার উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছিল। অবশ্য সন্তোষকুমার ঘোষ যখন ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার এই সপ্রতিভ তরুণটিকে আহ্বান করে এনে ছিলেন, তখনই তিনি ভেতরে ভেতরে নিজেকে নির্মাণের কাজটি সম্পন্ন করে ফেলে ছিলেন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ফলে এই সংস্থার প্রায় সমস্ত প্রকাশনায় (বিশেষত বাংলায়) তাঁর উপস্থিতি অনিবার্য হতে দেরি হয়নি।
পত্রিকার পাতা কিংবা সাময়িক পত্রের ভারা ভরানোর জন্য একদল লেখক সর্বকালেই থাকেন। সুনীলদাকে তাঁদের সমগোত্র মনে করলে মস্ত ভুল হবে। তিনি যা কিছু লিখেছেন অন্তর দিয়ে, মানুষের অন্তর ছুঁয়ে। তাঁর কোনও লেখাই তাই উপেক্ষিত নয়। উপেক্ষা করাও মুশকিল। দেশ-এ প্রকাশিত তাঁর বিপুল গদ্য ও পদ্য সুনীলদার লেখকজীবনের শ্রেষ্ঠ ফসলগুলির সিংহভাগ। এই পত্রিকাকে তিনি গভীরে ভালবেসেছিলেন। হয়তো কৃত্তিবাসকে যেমন ভালবাসতেন তার চেয়ে কিঞ্চিৎ কম। তা সত্ত্বেও দেশ-এ তিনি নিজেকে উজাড় করে দিতে কোথাও কার্পণ্য করেননি। এতে তিনি নিজে যেমন তৃপ্তি পেয়েছেন, তেমনি দেশ-এর মননশীল সম্মাননীয় পাঠকরা সাহিত্যপাঠের নিখাদ অনন্দে নিজেদের ভরিয়ে তুলেছেন।
ঈশ্বর একমাত্র অবিনশ্বর, অমর। তাঁর মৃত্যু নেই। মানুষ জন্ম-মৃত্যুর ভেতর দিয়ে অনন্তকাল ধরে এক নশ্বর অভিযাত্রায় বেরিয়েছে। এই যাত্রাপথের পাশে সে রেখে যায় তার স্মৃতি, তার কীর্তি। এগুলোই ‘আসা যাওয়ার পথের ধারে’ তার স্মরণচিহ্ন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই স্মারকশিলাগুলো রেখে গেছেন। তাঁর একজন অনুজ সহকর্মী হিসেবে সেই চিহ্নগুলো সযত্নে বুকের মধ্যে রেখে দিয়েছি। কেননা এগুলো যে অমর।
এগুলো হারিয়ে যাওয়ার নয়, হারিয়ে ফেলার নয়। |
|
|
|
|
|