স্মরণ ৩
তখনই শুনেছিলাম, সুনীলদার সিনেমা পরিচালনা করার ইচ্ছে আছে
ষ্টমীর দিন।
টেলিফোনের ও পারে গুলজারসাব।
সেই অতি পরিচিত গভীর আর অদ্ভুত এক মাদকতা জড়ানো গলা। তবে কোথায় যেন বিষাদ মাখা।
গত বছর অষ্টমীর রাতে চলে গিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। দেখতে দেখতে কেটে গেল প্রায় একটা বছর।
তাই কি অষ্টমীর দিনটিতে ওঁর গলায় বিসর্জনের সুর?
‘সুনীলদার’ চলে যাওয়ার অভিঘাত আজও তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনি অসুস্থ ছিলেন, এ খবর তাঁর অজানা ছিল না।
তবু বলা নেই কওয়া নেই এ ভাবে চলে যেতে হয়!
শান্তিনিকেতনে। ছবি: অশোক মজুমদার।
“দ্য নিউজ হ্যাড কাম বোথ অ্যাজ আ শক্ অ্যান্ড সারপ্রাইজ টু মি। জানতাম অসুস্থ ছিলেন। তবু মনে মনে খুব চাইতাম, যে ভাবে বাঁচতে চান, সে ভাবেই যেন থাকতে পারেন। বারবার ভাবতাম, লেট হিম বি দ্য ওয়ে হি ওয়ান্টস্ টু, লেট হিম লিভ দ্য ওয়ে হি ওয়ান্টস টু,” বললেন গুলজার।
ঠিক ছিল আর কয়েক মাস পরেই আবার দেখা হবে শান্তিনিকেতনে। তার মাঝেই ‘ইজাজত’ না নিয়ে, কিছু না বলে হঠাৎ করেই চলে গেলেন তাঁর ‘সুনীলদা’?
দূরভাষে কথা বলতে বলতে স্মৃতির পরদা সরিয়ে উঁকি দেন ফেলে আসা সময়ে।
সত্তর দশক। গিয়েছিলেন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। তখন গুলজার চিত্র পরিচালক। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠতা। গান লিখতেন তাঁর জন্য। আর মাঝে মাঝেই জেনে নিতেন পুজোবার্ষিকীতে কে কেমন লিখলেন, কার লেখা ভাল লাগল। স্ত্রী রাখী কোনও গল্প পড়ে প্রশংসা করলে, তক্ষুনি সেটা নিজেও পড়ে নিতেন। তেমন মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে শুরু করে দিতেন গল্পর স্বত্ব কেনার তোড়জোড়। এ ভাবেই একবার কিনে ফেলেছিলেন রাজকুমার মৈত্রর ‘রঙিন উত্তরীয়’। যার থেকে তৈরি হয় ‘পরিচয়’। সুবোধ ঘোষের ‘জতুগৃহ’র স্বত্ব কিনে ছবি বানান ‘ইজাজত’।
সেবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা কাহিনি পড়ে খুব ভাল লেগেছিল। এক দম্পতির জীবন নিয়ে লেখা। ইচ্ছে হল, গল্পটা নিয়ে সিনেমা করার। “সুনীলদার গল্পের চরিত্রগুলো ছিল একেবারে অন্য রকম। আমি রাইটস কিনলাম। কিন্তু কোনও প্রযোজক পেলাম না,” গুলজারের গলায় আজও তাই আক্ষেপের সুর।
আরেক বার ওঁর ‘স্বর্গের নীচে মানুষ’ পড়েও ঠিক করেছিলেন ছবি করবেন। “বলেছিলাম, যদি আমাকে স্বত্বটা দেন...উত্তরে সুনীলদা বললেন, উনি নিজেই ওটা নিয়ে একটা বাংলা ছবি পরিচালনা করতে চান। শেষমেশ তা যদি না করেন, তবে স্বত্বটা আমায় দিয়ে দেবেন। সেই প্রথম বার শুনেছিলাম, সুনীলদার সিনেমা পরিচালনা করার ইচ্ছে আছে। আমি বললাম, যদি আপনি ডিরেক্ট করেন, আমায় অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নেবেন? আজও স্পষ্ট মনে আছে, এও বলেছিলাম, যদি সিনেমায় একটা গানও রাখেন, আমি সেটা লিখব।”
দিল্লিতে বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে।
চিত্র পরিচালনা করা আর হয়ে ওঠেনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। এক দশকের বেশি হয়ে গেল গুলজারসাবও সরে এসেছেন পরিচালনা থেকে।
এখন কি ইচ্ছে করে ‘স্বর্গের নীচে মানুষ’ পরিচালনার মধ্যে দিয়েই আবার ক্যামেরার পিছনে দাঁড়াতে?
“আমি তো আর পরিচালনা করি না, কিন্তু একজন ছিল যে ওটা নিয়ে কাজ করতে পারত। ঋতুপর্ণ ঘোষ। ও-ও তো কেমন হঠাৎ করেই চলে গেল...!”
প্রথম দিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্যের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন গুলজারসাব। যাকে বলে ‘ডিভোটি অব হিজ প্রোজ’। “‘সেই সময়’ আর ‘প্রথম আলো’, কী অসাধারণ দুটি উপন্যাস, বলুন তো? মাঝে মাঝে সুনীলদাকে মনে হত যেন লিও টলস্টয়। সাচ্ আ স্টলওয়ার্ট রাইটার। জানি, ওঁকে কারও সঙ্গে তুলনা করার প্রয়োজন নেই। তবু যখনই ওই দুটি উপন্যাসের প্রসঙ্গ আসে, মনে হয়, শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যে নয়, ভারতীয় সাহিত্যেও এই রকম একজন প্রতিভা একেবারেই বিরল। হি ওয়াজ সাচ্ আ টল ফিগার ইন ইন্ডিয়ান লিটারেচার। প্রথম প্রথম ওঁর গদ্য ভাল লাগত, ধীরে ধীরে পরিচিত হলাম ওঁর কবিতার সঙ্গে। পোয়েট্রি ইজ মাই প্যাশন অ্যান্ড স্লোলি হিজ পোয়েট্রি গ্রু ইনসাইড মি।” বলেছিলেন তিনি।
আর নীরা? যে নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই খুব দুঃখে থাকে... সূর্য নিভে গেলে, নিওনের বাতি হঠাৎ জ্বলে ওঠার আগে জেনে নেয় নীরা ভাল আছে কি না?
“সুনীলদার সঙ্গে নীরার দেখা হত নানা ভাবে। নানা রকম অনুভূতির মধ্যে দিয়ে। কখনও নীরাকে আদর করেছেন। কখনও রাগ। কখনও অভিমান... কত ধরনের প্রকাশ... সুনীলদা ওয়াজ আ লিটল মুডি ইন হিজ পোয়েম....।”
বহু অনুষ্ঠানে গিয়েছেন, যেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা পাঠ তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছেন। একবার তাঁর মনে পড়ে, দিল্লিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা বই প্রকাশ করতে গিয়েছেন তিনি। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ এসে গিয়েছিল। “লনে দাঁড়িয়ে গল্প করছি, বললাম, বাঙালিরা টেগোর নিয়ে এত পজেজিভ, আমার বেশ হিংসেই হয়। শুনে আমাকে হঠাৎ সুনীলদা বললেন, ‘তুমিও তো বাঙালি’,” বলেই হেসে ফেললেন গুলজারসাব।
সে বার মুম্বইতে এক তথ্যচিত্র প্রকাশের অনুষ্ঠান। “সুনীলদাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল অনুষ্ঠানে কে কে যেতে পারেন, সেরকম কয়েক জনের নাম বলতে। তাতে উনি আমার প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘অন্যদের কথা জানি না। তবে একজন বাঙালি আছে, ও নিশ্চয়ই যাবে।’ সত্যি বলতে কী আমার জন্মের পরে মনে হয়, ‘কিসি নে বাংলা লিখ দিয়া মেরি জুবান পর’। উনি সেটা বুঝতেন। আর তার জন্য একটা প্যাট্রোনাইজিং অ্যাটিচিউডও ছিল।”
আবেগে গলা বুজে আসে গুলজারসাবের। অল্প থেমে ফিরে গেলেন শান্তিনিকেতনের এক অনুষ্ঠানের গল্পে। “প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার আগে আমি বেশ নার্ভাস ছিলাম। একদিন আগে পৌঁছে গিয়েছিলাম কলকাতায়। সে রাতে একটা ডিনার ছিল। আমি সুনীলদাকে বললাম, ‘ডিনার ফর হোয়াট, স্যার?’ উনি কী বললেন জানেন? বললেন, ‘ইন ইওর অনার!’ আমি তো হতভম্ব। এও কি সম্ভব? এমন টুকরো টুকরো বহু ঘটনায় বুঝতাম, সুনীলদা আমাকে খুবই স্নেহ করতেন।”
অনুষ্ঠান তো হবে। কিন্তু কী করতে হবে তাঁকে সেখানে? ডিনারের মাঝেই গুলজারসাব আর না থাকতে পেরে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলেন সে কথা। “‘সুনীলদা কেমন সহজ ভঙ্গিতে বললেন, কয়েকটা কবিতা পড়বে। আমরা শুনব। রবীন্দ্রচর্চা হবে। এর থেকে আর বেশি কী চাই?’ দ্যাট আনসার মেড মি সো কমফর্টেবল...।”
ছবি: অলক মিত্র।
পরের দিন কবিতা উৎসব।
বাংলায় নয়, হিন্দিতে কথা বলার অনুমতি চেয়ে বলতে শুরু করেন গুলজারসাব। তার পর চলে যান মিশ্র ভাষায়। মঞ্চে তখন বসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
“এখনও ওই মুহূর্তটার কথা ভাবলে নিজেকে ধন্য মনে হয়। শান্তিনিকেতনে ওঁর পাশে দাঁড়িয়ে আমি কবিতা পাঠ করেছি। এটা ওঁর আশীর্বাদ ছাড়া সম্ভব ছিল না। আমার কাছে এ যে কত বড় সম্মানের, বলে বোঝাতে পারব না,” বললেন গুলজারসাব।
শুধু সাহিত্য পাঠ বা রবীন্দ্রচর্চা নয়, ‘সুনীলদা’র গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতেও অসম্ভব ভাল লাগত তাঁর। “কী ভাল যে গাইতেন, ওই উদার গলায় রবীন্দ্রনাথের গান... আই হ্যাভ আ ফিলিং দ্যাট আফটার আ ফিউ ড্রিংকস টেগোর উড সিপ ইন টু হিম অ্যান্ড স্টার্ট সিঙ্গিং। আই কুড অলমোস্ট সি দ্য বেয়ার্ড অব টেগোর অ্যাজ সুনীলদা স্যাট ইন ফ্রন্ট অব মি সিঙ্গিং ইন ফুল থ্রোটেড ইজ্....।’
গত বছর ওঁর চলে যাওয়ার পরে কেমন যেন সময়টা থমকে গিয়েছিল গুলজারসাবের জীবনে। দম বন্ধ করা স্তব্ধতা যেন!
তবে কবির শেষ আশ্রয় তো কলম ... আর সাদা পৃষ্ঠা... সেখানেই শোকগাথা লিখেছিলেন গুলজারসাব তাঁর শ্রদ্ধার, ভালবাসার মানুষটির জন্য... উর্দুতে....নাম রেখেছিলেন ‘সুনীলদা’... ফোনের ওপার থেকে এক বছর বাদে পড়লেন কবিতাটি আবার...
“কিতাব অঁধি পড়ি হ্যায় মেজ পর,
র‌্যাহনে দো উসকো
উসে নিদ আ গ্যায়ি থি পড়তে পড়তে
ও উঠ কর সো গ্যায়া থা
আগারচা পঁ ফাটে সুরজ নে ঝাকা ভি থা,
দস্তক দি থি খিড়কি পর/মাগর জাগা নেহি ও, না উস্নে কারওয়াট লি!
বঁয়া জারি হ্যায় দোস্ত উসকা আদব মেঁ
কিতাব অঁধি পড়ি হ্যায় মেজ্ পর
র‌্যাহনে দো উসকো/জাগেগা তো—
উসি সফে সে আগে পড়না হোগা শায়েদ!”

মাঝে মাঝে উর্দু শব্দের তর্জমা করে বোঝালেন, ‘পঁ ফাটে সুরজ’ মানে সকালের প্রথম আলো। ‘আদাব’ হল সাহিত্য। ‘সফে’ বইয়ের পাতা। ঠিক হল কবিতাটির বাংলা অনুবাদ করা হবে।
অষ্টমীর রাত গড়িয়ে নবমীর সকাল। সন্ধিপুজোর সময় বাংলা অনুবাদের অনুমোদন এল গুলজারসাবের কাছ থেকে...!

সুনীলদা

বইখানা খোলা আছে টেবিলের পরে,
ওকে থাকতে দাও ওখানেই
ওর ঘুম এসেছিল পড়তে পড়তে
তাই উঠে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল
সকালের প্রথম আলো উঁকি দিয়ে যায়
জানলায় টোকা মারে
হাওয়া এসে আদর করে হাত বোলায়
তবু ঘুম ভাঙে না, একবার পাশও ফেরে না ও
তবে, ভাবনা চলতেই থাকে
বইখানা খোলা আছে, ওকে থাকতে দাও ওখানেই
যদি ঘুম ভাঙে
ওখান থেকেই হয়তো আবার পড়ে যেতে হবে!
(অনুদিত)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.