|
|
|
|
বিমা নেই, ক্ষতিগ্রস্ত লক্ষ চাষি
দিবাকর রায় • কলকাতা
অভিজিত্ চক্রবর্তী • ঘাটাল |
তপন দাস। বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর ব্লকের শোলিডিহা গ্রামে। স্থানীয় সমবায় সমিতি থেকে ঋণ ৬০ হাজার টাকা। ঝড়-বৃষ্টিতে তাঁর প্রায় দু’একর জমিতে ধান পুরোপুরি শেষ। তবে কৃষি বিমা আছে, তাই ঋণের টাকা শোধ না দিলেও সমবায় থেকে তাগাদা আসবে না। ক্ষতিপূরণও মিলবে, একর পিছু ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত।
দাসপুর ব্লকের সামাটবেড়িয়া গ্রামের নিরঞ্জন সাউ তিন বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছিলেন। বন্যায় সব ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বিমা করেননি। ফলে পুঁজি শেষ। “কী হবে বুঝতে পারছি না,” বলেন তিনি।
বন্যার পর আবার স্পষ্ট হল, এ রাজ্যে নিরঞ্জনবাবুর মতো চাষিই এখনও বেশি। সরকারি হিসেব বলছে, কৃষি বিমা না থাকায় দুই মেদিনীপুরে বন্যা-আক্রান্ত চাষিদের প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। তাঁরা পাবেন কেবল রাজ্য সরকারের সহায়তা ৬ কিলোগ্রাম ধানবীজ এবং ১০ কিলোগ্রাম সার। অন্য দিকে, কৃষি বিমা যাঁদের রয়েছে তাঁরা বিঘা পিছু প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন।
কিন্তু কৃষি দফতরের এক কর্তা জানিয়েছেন, এ বার বন্যায় সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা। ওই জেলায় প্রায় ১ লক্ষ ৮৫ হাজার চাষি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এঁদের মধ্যে কিষান ক্রেডিট কার্ড রয়েছে ৩৫ হাজার পরিবারের। তাঁরা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে চাষ করেছেন। ফলে কেবল ওই চাষিরা কৃষি বিমার আওতায় এসেছেন। একই ভাবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় প্রায় ১ লক্ষ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ২০ হাজার পরিবারের কৃষি বিমা রয়েছে। বাকি পরিবারগুলি ক্ষতিপূরণ পাবেন না।
অথচ শস্য বিমার খরচ তেমন কিছুই নেই। ধান চাষে বিমার জন্য এ রাজ্যে চাষিদের কোনও প্রিমিয়াম দিতে হয় না। কিষাণ ক্রেডিট কার্ডে ঋণ নিলে প্রিমিয়ামের পুরো টাকাই রাজ্য সরকার দেয়। প্রতিটি ‘নোটিফায়েড’ ফসলের জন্য চাষিরা বিমা করতে পারেন। কোন ফসল এবং কোন ব্লকের চাষিরা বিমা করতে পারবেন তা ঠিক করে রাজ্য সরকার এবং বিমা কর্তৃপক্ষ। কিষাণ ক্রেডিট কার্ডে ঋণ নিলে সংশ্লিষ্ট চাষির বিমা এমনিতেই হবে। যাঁরা ঋণ নেননি সেই চাষিরাও বিমা করতে পারবেন। তবে সেই চাষিকে কৃষি দফতরে অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কে গিয়ে বিমার আবেদন তুলে তা পূরণ করতে হবে। কৃষি বিমা অনুযায়ী একর পিছু চাষিরা ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পাবেন। পরে অবশ্য ব্লক অনুযায়ী ‘ক্রপ কাটিং’ পদ্ধতিতে ক্ষতিপূরণ ঠিক করা হবে।
তবে ঋণ না নিলেও যে বিমা করা যায়, সে বিষয়ে সরকারি প্রচারের অভাব রয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের কৃষি বিমা সহায়ক নবকৃষ্ণ দাস বলেন, “জেলার যত চাষি রয়েছেন বেশির ভাগের বিমা নেই। সরকারি প্রচারের অভাব এবং অনীহার জন্যই এই অবস্থা হচ্ছে।” চাষিদের অবশ্য অভিযোগ, বিমার আবেদনপত্র ভরার জন্য কৃষি দফতর, ভূমি রাজস্ব দফতর আর ব্যাঙ্ক, তিন জায়গায় ঘুরতে হয়। বারবার ঘুরতে হয় বলে বিরক্ত, হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেন অনেক চাষি, জানান নদিয়ার কালীগঞ্জের চাষি আরমান শেখ।
কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্না অন্য একটি সমস্যার কথা বলেন। “কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের অ্যাকাউন্ট খোলাতে গিয়ে দেখা যায়, অনেক চাষির জমি নিজের নামে নেই। বাবার নামেই রয়ে গিয়েছে। ফলে তাঁরা কৃষিঋণ পান না, বিমাও হয় না।”
রাজ্য কৃষি দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, হুগলি-হাওড়া এবং দুই মেদিনীপুর মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত চাষি পরিবারকে ৬ কিলোগ্রাম ধান এবং ১০ কিলোগ্রাম সারের ‘কিট’ দেওয়া হবে। সেই তালিকা তৈরির কাজ করছেন দফতরের অফিসারেরা। বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হওয়া এলাকা ঘুরে রিপোর্ট তৈরি করে তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতরে পাঠানো হবে। মুখ্যমন্ত্রী কৃষি কর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন, শুধু ধানের বীজ নয়, চাষিরা যে বীজ চাইবেন তাই যেন দেওয়া হয়। সে কারণে ধান ছাড়াও সর্ষে, ডালশস্য-সহ নানা ধরনের বীজের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।
চলতি মরসুমে রাজ্যে ৪১.৭০ লক্ষ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছিল। রাজ্য সারা দেশের নিরিখে ধান চাষে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। কিন্তু ফসল তৈরি হওয়ার মুখে চার জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যায় উত্পাদনে প্রভাব পড়বে, আশঙ্কা কৃষির কর্তাদের। |
|
|
|
|
|