দুর্যোগে ভেঙেছে ঘরবাড়ি। কারও ঠাঁই গোয়ালঘরে, কারও সরকারি ত্রাণ শিবিরে। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়ের বাড়িতে। কিন্তু লক্ষ্মীপুজো তো বন্ধ করা যায় না। এই দুর্বিপাকের মধ্যেই তাঁদের অনেকে লক্ষ্মীর আরাধনা করলেন। যদিও দুর্গতদের হাহাকারে চাপা রইল উলু-শঙ্খ ধ্বনি।
‘পিলিনে’র প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে দুর্গাপুজার আনন্দ অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছিল। সারেঙ্গা ব্লকের বানপুর, গাংনালা, খয়েরপাহাড়ি, কৃষ্ণপুর, গাড়রার মতো গ্রামগুলিতে শতাধিক কাঁচাবাড়ি ভেঙে পড়ে। অনেকেই উঠে দিয়েছিলেন ত্রাণ শিবিরে। বৃষ্টি থামতে তাঁরা ভাঙা ঘরে ফিরেছেন। সরকারি ত্রিপল দিয়ে কোনওরকমে ভাঙা ঘরের ছাউনি দিয়েছেন। কিন্তু সে ঘরে রাত কাটাতে অনেকেরই বুক কাঁপে। আধ ভাঙা দেওয়ালটা ভেঙে পড়বে না তো! শুক্রবার সেই ঘরের সামনে উঠোনেই খড়িমাটি গুলে অনেকে আলপনা আঁকলেন। গৃহকর্তা পকেট হাতড়ে বাঁচিয়ে রাখা সামান্য ক’টা টাকা নিয়ে পুজোর বাজার সেরে আনলেন। কোথাও বেজে উঠল শাঁখ।
সারেঙ্গার বিডিও হীরকজ্যোতি মজুমদার বলেন, “পাঁচটি গ্রামের ৯০টি পরিবারকে ত্রাণশিবিরে এনেছিলাম। বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় অনেকেই বাড়ি ফিরে গেছেন। সরকারি ভাবে ত্রাণ শিবির বন্ধ হয়ে গেলেও, অনেকেই থাকার জায়গা না থাকায় এখনও ওই স্কুলবাড়িতেই রয়ে গিয়েছেন।” জঙ্গলমহলের এই সব গ্রামে প্রতি বছর প্রায় ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পুজো হত। পরম্পরা অনুসারে এখানে হাঁড়িলক্ষ্মীর পুজোর চল রয়েছে। সকাল থেকে বাড়ির তুলসিতলায় আলপনার নকশা আঁকা হত, মেয়ে-বউরা উলু ও শঙ্খধ্বনি দিতেন। ঝাঁঝ-কাঁসরের আওয়াজে গম গম করত গোটা গ্রাম। কিন্তু এ বার ছবিটা একেবারেই আলাদা। |
বানপুর গ্রামের হলধর দাসের টিনের চালার মাটির বাড়ি বৃষ্টিতে ধসে গিয়েছে। টিকে রয়েছে শুধু গোয়ালঘর। সেখানেই আস্তানা নিয়েছেন তাঁরা। হলধরবাবুর স্ত্রী মাধুরীদেবীর আক্ষেপ, “প্রতিবছর লক্ষ্মী পুজোর জন্য ঘরদোর পরিষ্কার করে আলপনা দিয়ে সাজাতাম। পুজোর উপকরণ কিনে আনতাম। ডোকরার লক্ষ্মীঝাড় পেতে হাঁড়িলক্ষ্মীর (ধান ভর্তি হাঁড়ি) পুজো করতাম। এ বার আমাদের ঘরই নেই। নিজেরাই গোয়াল ঘরে রাত কাটাচ্ছি। লক্ষ্মী বসাব কোথায়?” চিরাচরিত পুজোয় এবার ছেদ পড়ল হলধরবাবুর।
একই অবস্থা বহু গ্রামবাসীর। যদিও বিধ্বস্ত বাড়িতেই বংশ পরাম্পরার ধারা বজায় রাখতে কেউ কেউ নাম মাত্র পুজো করলেন। যেমন এই গ্রামেরই বাসিন্দা বিমল গুঁই। বৃষ্টিতে তাঁর বাড়িও ধসে পড়েছে। আপাতত তিনি পরিবার নিয়ে গ্রামেরই এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছেন। তবে বিমলবাবুর বাড়ির আঙিনায় তুলসি মঞ্চটা এখনও অক্ষত রয়েছে। সেখানেই ত্রিপল টাঙিয়ে হাঁড়িলক্ষ্মী পেতে পুজোর আয়োজন করছেন তাঁরা।
বিমলবাবু বলেন, “সব হারিয়ে উদ্বাস্তুর মতো দিন কাটছে আমাদের। ভেবেছিলাম পুজো করব না। কিন্তু পূর্বপুরুষদের পুজো বন্ধ করতে বিবেকে বাধল। তাই তুলসি মঞ্চের সামনে কোনওরকমে পুজোটা সারছি। এই গ্রামের বাসিন্দা মধুসূদন পালের বাড়িতে লক্ষ্মী প্রতিমার পুজোর চল রয়েছে। বৃষ্টিতে ঘর-দুয়ার ভেঙে যাওয়ায় তিনিও সপরিবারে গোয়ালঘরে উঠেছেন। গোয়ালঘরেই এক কোণে পুজোর আয়োজন করেছেন তাঁরা। ছোট্ট একটি লক্ষ্মী প্রতিমাও কিনে এনেছেন কুমোরপাড়া থেকে। তাঁর কথায়, “দুর্যোগে সবই হারিয়েছি। কিন্তু পারিবারিক পুজোটা বন্ধ করতে পারলাম না।”
সারেঙ্গার গাংনালা গ্রামে মদন রজকের বাড়ি কংসাবতী নদীর বানে ভেসে গিয়েছে। সংসার নিয়ে তিনি এখন গ্রামেরই এক স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। ফি বছর তাঁর বাড়িতেও সাড়ম্বরে লক্ষ্মীপ্রতিমা এনে পুজো হত। এখন মদনবাবুরা গৃহহীন। তবে পুজো বন্ধ করেননি। স্ত্রী ছেলে মেয়েকে নিয়ে ত্রাণ শিবির থেকে বেরিয়ে নিজের বাস্তুভিটেতে গিয়ে খোলা আকাশের নীচেই লক্ষ্মীর ঘট বসিয়ে পুজো সেরেছেন কোনও ভাবে। তাঁর স্ত্রী ঝর্ণাদেবী বলেন, “অন্য বার সাড়ম্বরে দেবীর আরাধনা করেছি। এ বার ঘরই নেই। ত্রাণশিবিরে রাত কাটাচ্ছি। তাই নমো নমো করে ঘটেই পুজো করলাম।”
গাংনালা লাগোয়া সারেঙ্গার গুড়েপাড়া গ্রামের সর্বজনীন লক্ষ্মীপুজোতেও এ বার বিষন্নতার ছাপ। এই পুজো কমিটির অন্যতম সদস্য প্রসেনজিৎ চৌধুরী বলেন, “আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী। কিন্তু অতিবৃষ্টিতে এ বার ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাই সকলেরই মন খারাপ। স্বাভাবিকভাবেই পুজোর চমকও কমে গিয়েছে।” |