আকাশছোঁয়া থামগুলোকে পরপর উঠে যেতে দেখলে মনে হবে, পুরনো ব্রিটিশ স্থাপত্যের আধুনিক নিদর্শন বুঝি। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু পঞ্জাব ক্রিকেট সংস্থার চৌহদ্দিতে একবার ঢুকে পড়লে যত না স্টেডিয়াম বলে মনে হবে, তার চেয়ে ক্রিকেট-দুর্গ হিসেবে ভাবতে পছন্দ হবে বেশি।
আশেপাশে প্রহরারত অগুনতি পুলিশ। রাস্তায় ব্যারিকেড। শনিবাসরীয় মোহালিতে যতক্ষণ ভারত খেলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত টিকিট ছাড়া স্টেডিয়ামের দু-তিন কিলোমিটারের মধ্যে ‘রেস্ট অব মোহালি’-র প্রবেশ নিষেধ! আর স্টেডিয়ামের পাসপোর্ট? বিশালদেহী পুলিশ কর্তাদের চোখ এড়িয়ে আম-আদমি দূরের কথা, মাছিটিরও গলে যাওয়ার সাধ্য নেই। বাইশ গজের যুদ্ধ যেন নামেই, আসল যুদ্ধক্ষেত্রের বারুদের আঁচ পাওয়া যাবে বেশি, প্রতি মিনিটে মনে করিয়ে দেবে আর আড়াইশো কিলোমিটার...তার পরই পাকিস্তান সীমান্ত...ওয়াঘা বর্ডার...।
ঘড়ি ধরে সকাল ঠিক সাড়ে দশটায় যে টিমটা ওই ক্রিকেট-দুর্গের ভিতর ঢুকে গেল, তাদের সঙ্গে আবহের কোথাও না কোথাও গিয়ে মিল পাওয়া যাবে। ওঁরা পনেরো জন ফুরফুরে, ওঁরা সবাই জয়পুর সুখস্মৃতির মন্তাজে এখনও ডুবে, তবু ওঁরা ক্ষুধার্ত। ক্রিকেটার নন, ক্রিকেট-দুর্গ রক্ষার দায়িত্ব প্রাপ্ত এক-এক রাইফেলধারী প্রহরী যেন। |
কী রকম? বুঝতে গেলে বিপরীতধর্মী দৃশ্যগুলো দেখতে হবে।
কাট ওয়ান: চড়চড়ে রোদে ফিল্ডিং সেশন শুরু হব-হব করছে। আচমকা দেখা গেল ঘরের ছেলে যুবরাজ সিংহ সামান্য একটু ব্রেক ডান্স নেচে নিচ্ছেন।
কাট টু: নেট বোলারের একটা বাউন্সার কাঁধ ছুয়ে বেরিয়ে যাওয়াটা যে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির একেবারে পছন্দ হল না, মুখচোখের বিরক্তি থেকে বোঝা গেল। পরের বলটা মোটামুটি ওই একই জায়গায় এবং নেটের মাথায় যে গতিতে বলটা আছড়ে পড়ল তাতে ওটা ছয় নয়, বারো হয়।
কাট থ্রি: টিম ইন্ডিয়ার ফুটবল সেশনে হঠাৎই রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন বিরাট কোহলি। মুহূর্তে যে ড্রিবলটা বেরোল, সেটা সচরাচর লা লিগায় সিআর সেভেনের পায়ে দেখা যায়।
কাট ফোর: শিখর, আপনি কখন বুঝলেন জয়পুর ম্যাচটা জিততে পারেন? ভিড়ে ঠাসা সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন সেনসেশনের দিকে প্রশ্নটা উড়ে গেল, আর তার পর সেটার দৈত্যাকৃতি জানালার বাইরে উড়ে পড়তে লাগল সেকেন্ডের ভগ্নাংশ ‘ঠিক যখন আমি ড্রেসিংরুম থেকে ব্যাট নিয়ে বেরোলাম!’
কর্কশ যুক্তির বিচারে দেখলে, জয়পুর-কাণ্ডের পরবর্তী সময়ে ধোনির টিমে স্বস্তি যতটা আছে, শঙ্কাও ঠিক ততটাই আছে। টি-টোয়েন্টি আর ওয়ান ডে নিয়ে গত তিনটে ম্যাচের একশো কুড়ি ওভারে আটশো ষাট রান গিলেছে ভারতীয় বোলিং। যেমন স্পিনের দশা, তেমন পেসের। সবচেয়ে দুর্দশা ইশান্ত শর্মার। ভারতীয় পেস ব্যাটারির সিনিয়রতম সদস্য বটে, কিন্তু পারফরম্যান্সে জুনিয়রতম সদস্যের সঙ্গেও সাদৃশ্য পাওয়া যাবে না। মিডিয়া নিরন্তর গালিগালাজ করছে, প্রেস কনফারেন্সে ভারতীয় টিমের প্রতিনিধিকে তির্যক ভাবে প্রশ্ন করছে, ‘আচ্ছা, ঘণ্টায় একশো পঁচিশ কিলোমিটার স্পিডে ইশান্ত শর্ট পিচড গোছের ওটা কী দিচ্ছেন? বাউন্সার?’ শুনে তীব্র হাসির ফোয়ারা ছুটছে, তবু দিল্লি পেসারের বিশেষ বদল নেই। প্র্যাকটিস যদি কোনও কিছুর দিকনির্দেশ করে, তা হলে শনিবার জয়দেব উনাদকট বা বাংলার মহম্মদ সামিকে দেখতে পাওয়া গেলে অবাক হওয়ার থাকবে না। চিন্তার বস্তু আরও একটা আছে। উত্তর ভারতের শিশির। অক্টোবর মাসের সন্ধেয় যার ফিল্ডিং টিমের সাড়ে বারোটা বাজার সম্ভাবনা, বলাই বাহুল্য।
কিন্তু এটা একটা দিক। অন্য দিকটা বরং বেশি প্রাসঙ্গিক। যেখানে আবেগ ও আত্মবিশ্বাস দু’টোরই ফ্রেম আছে। যেমন, মোহালি সাম্প্রতিকে আফ্রিদির পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জিতে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ওঠার মাঠ। যেমন, শিখর ধবন নামক এক জাঠের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রবেশ এবং তাঁর শিখরে ওঠার প্রথম মঞ্চ। এই মাঠেই তো অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অভিষেক টেস্টে ১৮৭ এসেছে দিল্লির যুবকের। আর আত্মবিশ্বাসের নমুনা? ইশান্ত-বিনয় প্রসঙ্গে টিম থেকে সোজা বলে দেওয়া হচ্ছে, ‘আর কিছু না হোক, ওরা তো চেষ্টা করছে। তাতেই হবে।’
অতঃকিম?
সিরিজে এগিয়ে যাওয়ার ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগে ভারতীয় দলের বহিরঙ্গ-অন্দরমহলের নির্যাস খুব সংক্ষেপে ধরতে হলে, শিখরের মন্তব্যকে ব্যবহার করা বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ। ফুরফুরে মেজাজের চেয়েও হিংস্র ভাবটা যে মন্তব্যে ধরা পড়ছে বেশি, বড় বেশি। ‘অস্ট্রেলিয়ার সব কিছুর জন্য আমরা তৈরি। খিদেটা বাড়ছে। আমি ক্ষুধার্ত!’ |