|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
শহরের ভিড়, ঘোড়দৌড় অথচ জটিলতামুক্ত আবহ |
সম্প্রতি এমামি চিজেল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল প্রশান্ত কোলের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
চিন ও জাপানের চিত্রকলার মধ্যে লিখনশৈলী বা ক্যালিগ্রাফির বড় ভূমিকা থাকে। অনেক সময়ই ওখানকার শিল্পীরা অক্ষরমালা দিয়ে ছবিকে সাজান। তাতে শিল্পীর ভাবনার আভাসকে ধরে রাখার প্রয়াস থাকে কখনও। কখনও বা তা কেবলই ছন্দের বৈচিত্র আনে। সেই ছন্দের দোলা ছবির ভাবকেও স্পন্দিত করে নানা ভাবে। চিনের বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণই এক একটি ছবির মতো। আলম্ব, অনুভূমিক, সরল ও বক্র— এ রকম একাধিক নানা চরিত্রের রেখার আপাত বিচ্ছিন্ন সমন্বয়ে গড়ে ওঠে যে বর্ণটি, তা নিজেই হয়ে উঠতে পারে রেখাধৃত একটি বিমূর্ত ছবি। বর্ণের এই চরিত্রকে নানা ভাবে ব্যবহার করা হয় ওখানকার ছবিতে। আমাদের দেশের আধুনিক চিত্রকলায় দূরপ্রাচ্যের প্রভাব নানা ভাবে কাজ করেছে। লিখনশৈলী, বর্ণশৈলীর ব্যবহারও হয়েছে নানা ভাবে। আজও অনেক ছাত্রছাত্রী পাশ্চাত্যের বদলে চিনে যাওয়া পছন্দ করেন চিত্রকলার উচ্চতর পাঠ নিতে। এতে করে আমাদের চিত্রকলা নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ হচ্ছে।
প্রশান্ত কোলে এরকম একজন শিল্পী, যিনি তাঁর ছবির সমৃদ্ধির প্রয়োজনে চিনের ভাষা, সংস্কৃতি ও শিল্প-ঐতিহ্যকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন নানা ভাবে। কলকাতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিখেছেন চিনের ভাষা, ওখানেও গেছেন একাধিক বার। ১৯৮৫ সালে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে চিত্রকলায় ডিপ্লোমা নেন। তার পর থেকে ছবি আঁকছেন নিয়মিত। দেশে বিদেশে বহু প্রদর্শনী হয়েছে তাঁর। এক সময় নিসর্গই ছিল তাঁর ছবির প্রধান একটি বিষয়। সেই নিসর্গে তিনি খুঁজেছেন শহরের ভিড় ও জটিলতামুক্ত প্রশান্ত আবহ। আধুনিকতার ঘোড়দৌড় ও বিপন্নতার বিপরীতে সন্ধান করেছেন স্নিগ্ধ ও ছন্দিত লাবণ্য। সেই সন্ধানই তাঁকে দূরপ্রাচ্যের দিকে আকৃষ্ট করেছে।
এমামি চিজেল আর্টে অনুষ্ঠিত হল তাঁর একক প্রদর্শনী। প্রায় ৫০টির কাছাকাছি ছবি ছিল। এই প্রদর্শনীর প্রধান আকর্ষণ চৈনিক অক্ষরমালাকে তাঁর নিজস্ব রূপরীতির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া। এখানে কিছু ছবি ছিল, যা তাঁর পূর্ববর্তী নিসর্গ রূপায়ণরীতির সাক্ষ্য বহন করে। জলরঙে আঁকা ১১ ও ৩৭ সংখ্যক ছবি দু’টি দৃষ্টান্ত। এই যে নিসর্গ তা কোনও নির্দিষ্ট স্থানের স্বাভাবিকতা অনুসারী রূপায়ণ নয়। তাতে গ্রামীণ প্রকৃতির অন্তর্লীন সুষমাকে ধরার চেষ্টা আছে। সেই প্রকৃতি আবার অনেকটাই বিমূর্তায়িত হয়ে গেছে। |
|
শিল্পী: প্রশান্ত কোলে। |
এই বিমূর্তায়ন পদ্ধতি নিয়ে তিনি নানা রকম পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন। চৈনিক বর্ণমালার ব্যবহার তার একটি। কোনও কোনও ছবিতে তিনি মোটা তুলির টানে একটি অক্ষর লিখেছেন। তার পর সেই বর্ণের রেখার জ্যামিতির মধ্যবর্তী অংশকে কখনও বর্ণিল ছায়াতপে ভরাট করে, কখনও বা শূন্য পরিসরের ভিতর থেকে জ্যামিতিক রূপ বের করে এনে, সবটা মিলিয়ে একটা দৃশ্য পরিমণ্ডল তৈরি করেছেন। এর এক প্রান্তে রয়েছে অপরিচিত প্রকৃতির স্পন্দন, অন্য প্রান্তে প্রকৃতি নিরপেক্ষ শুদ্ধ রূপ বা বিমূর্ততার আভাস। ঐতিহ্যগত চৈনিক নিসর্গের যে গঠনভঙ্গি, তা তাঁর ছবিতে খুব বেশি নেই। বরং রূপায়ণ পদ্ধতির দিক থেকে তাঁর ছবি পাশ্চাত্যের অভিব্যক্তিবাদী আঙ্গিকের অনেক কাছাকাছি। পাশ্চাত্য অভিব্যক্তিবাদ ও চৈনিক অক্ষরশৈলী— এই দুইয়ের সমন্বয়ে তিনি গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন নিজস্ব রূপরীতি।
যেমন ২ সংখ্যক ছবিটিতে লিখেছেন একটি চৈনিক শব্দ ‘হোয়ান ইঙ্গ্’। ইংরেজিতে এর অর্থ ‘ওয়েলকাম’। ক্যানভাসের উপর লাল কাগজ সেঁটে কোলাজের প্রকরণে লেখা রয়েছে এই অক্ষর। প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন বর্ণের ছায়াতপ। কোথাও বা সাদা ছেড়ে রেখে তার সঙ্গে মেলানো হয়েছে। এভাবে গড়ে উঠেছে একটি ছবি, যা কোনও নির্দিষ্ট নিসর্গ নয়, আবার ‘হোয়ান ইঙ্গ্’ শব্দের অর্থের সঙ্গেও যার নিবিড় কোনও সম্পর্ক বা যোগসূত্র নেই। অলঙ্করণের বিভিন্ন ধরন নিয়ে খেলতে খেলতেই গড়ে ওঠে তাঁর ছবি। তা এক ছন্দের বিন্যাস ঘটায়। সেই ছন্দ প্রাচ্য চেতনা সঞ্জাত এবং পাশ্চাত্য অভিব্যক্তিবাদী রূপরীতির সঙ্গে সমন্বিত হয়ে এক বিশেষ আঙ্গিক তৈরি করে। নিসর্গ বা চৈনিক বর্ণমালা সেখানে একটি প্রকৃষ্ট প্রস্থানবিন্দু মাত্র। কয়েকটি ছবিতে তিনি সাদা ক্যানভাসের উপর লাল কাগজের রেখা সেঁটে কোলাজের পদ্ধতিতে অতি-সংক্ষিপ্ত বা ‘মিনিমাল’ রূপ বিন্যাসে ছবি করেছেন। নিসর্গ ও বিমূর্তের সমন্বয় এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য রূপভঙ্গির সংশ্লেষ। |
|
|
|
|
|