পূর্ব কলকাতা জলাভূমি সংস্কারে কেন্দ্রীয় সাহায্য চাইল রাজ্য সরকার। জলাভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পলি জমায় মাছ চাষ মার খাচ্ছে। উধাও হয়ে যাচ্ছে রুই-কাতলা-মৃগেলের মতো পরিচিত নানা মাছ। বাজারে কমছে এ সব মাছের জোগান। তাই এ বার দ্রুত মাছের জোগান বাড়াতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে মৎস্য দফতর।
কলকাতায় দৈনিক ময়লা জলের পরিমাণ প্রায় ১৩০ কোটি লিটার। এর একটি বড় অংশ এসে পড়ে পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতে। পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সদস্য তথা পূর্ব কলকাতা জলাভূমি মৎস্যজীবী কল্যাণ সমিতির অন্যতম কর্তা শশিদুলাল ঘোষ এ কথা জানিয়ে বলেন, “এখানকার যে সব সমস্যায় মাছ চাষ মার খাচ্ছে, তার অন্যতম প্রধান হল ক্রমান্বয়ে পলি জমা।” তাঁর দাবি, এতে এক দিকে বাজারে মাছের জোগান কমছে। অন্য দিকে, সঙ্কটে পড়ছেন এখানকার মাছ চাষ এবং সংশ্লিষ্ট নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত অন্তত এক লক্ষ লোক। সমিতির হিসেবে, মহানগরীতে এখন যত মাছ পাওয়া যায়, তার ২৫ শতাংশ মেলে কেবল এই অঞ্চল থেকেই।
পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতে নানা মাপের ভেড়ির সংখ্যা ২১৭। এর মধ্যে প্রায় ১০০টি ব্যক্তিগত মালিকানার। ১২টি স্বীকৃত সমবায় সমিতির। বাকিগুলি অস্বীকৃত সমবায় সমিতির। ‘অল বেঙ্গল ফিশ প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি দীপঙ্কর মণ্ডল এ কথা জানিয়ে বলেন, “দেড় দশক আগে এই অঞ্চলে হেক্টর পিছু প্রায় ৯ টন মাছ হত। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৯ টন।” তাঁর দাবি, রুই-কাতলা-মৃগেলের মতো ‘ইন্ডিয়ান মেজার কার্প’ প্রজাতির বিভিন্ন মাছের জন্য জলের গভীরতা ছ’ফুট হলে ভাল হয়। কিন্তু গভীরতা কমে দেড়-দু’ফুট, কোথাও কোথাও ছ’ইঞ্চি।” ফলে নাইলনটিকার মতো মাছ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে মৎস্যজীবীদের। |
এক নজরে |
আয়তন: ১২, ৫০০ হেক্টর |
মৌজা: ৩৭টি |
থানা: তিলজলা, লেদার কমপ্লেক্স, সোনারপুর এবং দক্ষিণ বিধাননগর
|
মিলছে: বছরে প্রায় ১৬ হাজার টন মাছ |
|
পরিস্থিতি ক্রমে খারাপ হচ্ছে স্বীকার করে মৎস্য দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা শৈলেন বিশ্বাস বলেন, “প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এই পাঁক সাফ করা উচিত। মূলত অর্থাভাবে তা হচ্ছে না। রাজ্য এ কারণে জাতীয় মৎস্য উন্নয়ন পর্ষদকে (এনএফডিবি) চিঠি দিয়েছে। কথা চলছে ওঁদের সঙ্গে।”
এ বিষয়ে কী ভাবে মিলতে পারে কেন্দ্রীয় সহায়তা? মৎস্য দফতরের এক পদস্থ অফিসার বলেন, “কেন্দ্রের মৎস্যচাষি উন্নয়ন সংস্থা (এফএফডিএ) বিভিন্ন সাধারণ জলাশয় সংস্কারের জন্য সহায়তা দেয়। খরচের ২৫ শতাংশ দিতে হয় রাজ্যকে।” তিনি বলেন, পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ‘রামসর সাইটে’ পড়ছে। পরিবেশ রক্ষায় এই অঞ্চলের একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে। তাই এখানে মাছ চাষের বিকাশের লক্ষে পলি তোলার অনুদান দেওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্রকে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার পরে ঠিক হবে প্রয়োজনীয় অর্থের কতটা দেবে কেন্দ্র। মৎস্যচাষিদের হিসেবে, চার ফুট গভীরতা বজায় রাখার লক্ষে ১০০ বিঘা অংশে পাঁক তুলতে গেলে কম করেও খরচ হবে ৫০ লক্ষ টাকা।
মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, “বিভিন্ন খাল সংস্কারের ফলে পূর্ব কলকাতা জলাভূমির বেশ কিছু অঞ্চলে পলি জমার প্রবণতা কমেছে। গোটা অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা হচ্ছে।” নিউ টাউন তৈরির জন্য বছর আট আগে চকের ভেড়ি, বড় আবাধ, নারকেলতলা, চিন্তা সিংহ, বড় পরেশ প্রভৃতি ভেড়ির প্রায় ৯০৪ হেক্টর অংশের পলি তোলা হয়েছিল। মাছ চাষ বেড়েছে এই সব অঞ্চলেও।
দফতর সূত্রে খবর, কেন্দ্রের একটি বিজ্ঞপ্তির জন্য এই অঞ্চলের খাল সংস্কার আটকে গিয়েছে।” এ ব্যাপারে দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা বলেন, “পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে সার্বিক ভাবে ওই বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। পূর্ব কলকাতা জলাভূমির বিশেষ চরিত্র ও গুরুত্ব বিবেচনা করে এই অঞ্চলটিকে ওই নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখতে আমরা কেন্দ্রকে আর্জি জানিয়েছি।”
বাড়তে থাকা পাঁক ছাড়াও এই অঞ্চলের সমস্যা রয়েছে বেআইনি দখল ও নির্মাণ নিয়ে। দীপঙ্কর মণ্ডল বলেন, “তিলজলা ও সোনারপুর থানার কিছু জায়গায় এ রকম ঘটনা ঘটছে।” মহাকরণ সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পরিস্থিতি খতিয়ে, বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে পরিকল্পনা ও উন্নয়নমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীকে দিয়েছেন। তা খতিয়ে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি হবে। |