সরকারি এবং সরকারি অনুদান পাওয়া পাঠাগারগুলিতে কোন কোন সংবাদপত্র রাখা যাবে, সেই তালিকা অবিলম্বে পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দিল হাইকোর্ট। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত রাজ্য সরকারকে সময় দিয়ে প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ বৃহস্পতিবার বলেছে, ওই সময়ের মধ্যে তালিকা পুনর্বিবেচনা করা না-হলে আদালত নিজেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
গত বছর মার্চ মাসে রাজ্যের জনশিক্ষা ও গ্রন্থাগার দফতর একটি নির্দেশনামা জারি করে জানিয়ে দেয়, সরকারি এবং অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারগুলিতে মোট আটটি দৈনিক সংবাদপত্র রাখা যাবে। এদের মধ্যে পাঁচটি বাংলা, ২টি উর্দু এবং ১টি হিন্দি কাগজ। পরে সেই তালিকায় আরও ৫টি (২টি বাংলা, ১টি ইংরাজি, ১টি নেপালি ও ১টি সাঁওতালি) কাগজের নাম জোড়া হয়। কিন্তু রাজ্যে বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রগুলির অধিকাংশই সেই তালিকায় স্থান পায়নি। তার বদলে ছিল সদ্য বেরোনো, এমনকী তখনও প্রকাশিত না-হওয়া দৈনিকের নাম। স্বাভাবিক ভাবেই সরকারি নির্দেশ ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়। আপত্তি জানান পাঠাগারগুলিতে যাঁরা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তে আসেন তাঁরাও।
সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক এক মহল থেকে এক এক রকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, মুক্ত চিন্তার প্রসার ঘটাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কোনও রাজনৈতিক দলের মদতে প্রকাশিত কোনও কাগজ সরকারি পয়সায় কেনা হবে না। তথ্য অধিকর্তা আবার বলেন, সরকারের আর্থিক অবস্থার কথা মাথায় রেখেই কাগজগুলি বাছাই করা হয়েছে। অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, ছোট ছোট কাগজের পাশে দাঁড়ানোই তাঁর সরকারের নীতি। সরকারের টাকায় কোন কাগজ কেনা হবে, সেটা সরকারই ঠিক করবে। সেই নীতি মেনেই কাগজের তালিকা তৈরি হয়েছে। তৃণমূল সূত্রের দাবি ছিল, বাম আমলে কাগজেকলমে না-হলেও মৌখিক ফতোয়া জারি করে সিপিএমের দৈনিক মুখপত্র সরকারি গ্রন্থাগারে রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। সেটা আটকাতেই এই সিদ্ধান্ত। যদিও সরকারি গ্রন্থাগারে রাখার যোগ্য বলে যে সব সংবাদপত্রকে তৃণমূল সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে বেছে নেওয়া হয়েছিল, তাদের অনেকগুলিই সরকার বা শাসক দলের অনুগত বা সমর্থক বলে পরিচিত। একাধিক কাগজের মালিক, সম্পাদক বা পদস্থ কর্মী ছিলেন তৃণমূলের সাংসদরা।
তা ছাড়া, রাজনৈতিক মদতে পুষ্ট কাগজ রাখা বন্ধ করার কথা বলে আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্য টেলিগ্রাফ বা বর্তমানের মতো বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল কেন, তার সদুত্তর সরকার বা শাসক দল কোনও তরফেই মেলেনি। অধিকাংশ লোক যে সব কাগজ পড়তে চান, সেগুলি সরকারি পাঠাগার থেকে এ ভাবে ছেঁটে ফেলা যায় কি না, সেই প্রশ্ন তোলেন অনেকেই। পাঠকদের অনেকে নিজেদের পয়সায় ওই সব কাগজ কিনে পাঠাগারে রাখার প্রস্তাব দেন। কিন্তু অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার সরকারি রক্তচক্ষুর জেরে অধিকাংশ পাঠাগারই সেই প্রস্তাবে রাজি হতে পারেনি। সরকারি নির্দেশ অমান্য করার ফল যে ভাল হবে না, প্রচ্ছন্ন ভাবে সে কথা বুঝিয়ে দিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “মানুষ কোন কাগজ কিনে পড়বে, সেটা তো এখনও আমরা বলিনি। আগামী দিনে বলব। কারণ বিষয়টা আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্তের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।”
ঘটনা হল, যে সব ছোট সংবাদপত্রের হয়ে সওয়াল করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, গত এক বছরের মধ্যে তাদের তিনটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশিকার জেরে এই এক বছরে পাঠকের আনাগোনাও অনেক কমে গিয়েছিল বলে বহু পাঠাগারই জানিয়েছে। ফলত এ দিন আদালতের বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকেই। এটা আসলে পাঠকদেরই জয় বলে মনে করছেন গ্রন্থাগারিকদের একাংশ।
সরকারি বিজ্ঞপ্তিকে গত বছর ২৯ মার্চই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন আইনজীবী বাসবী রায়চৌধুরী। আবেদনে বলা হয়, সরকারি নির্দেশ সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা এবং পাবলিক লাইব্রেরি অ্যাক্ট (১৯৭৯) এবং লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট রুলের পরিপন্থী। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারের থেকে তাদের সিদ্ধান্তের কারণ জানতে চায় ডিভিশন বেঞ্চ। সরকারের তরফে বলা হয়, এমন বিজ্ঞপ্তি জারি নতুন নয়। এর আগেও এমন তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
অন্য দিকে আবেদনকারীর আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, আগে সব গ্রন্থাগারেই পাঠকদের দ্বারা নির্বাচিত কমিটি ঠিক করত, কোন কোন সংবাদপত্র রাখা হবে। এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কোনও ভূমিকা ছিল না। এখন নির্বাচিত কমিটি কোন কোন সংবাদপত্র রাখা যাবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এতে পাঠকদের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হচ্ছে। তিনি বলেন, রাজ্যের সব থেকে বেশি প্রচারিত সংবাদপত্র বাদ দিয়ে যে ভাবে সদ্য প্রকাশিত সংবাদপত্রকে তালিকায় জায়গা দেওয়া হয়েছে, তাতে বর্তমান সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়।
আদালত এ দিন যে ভাবে সরকারকে তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বলেছে, তাতে পঞ্চায়েত, কামদুনির পরে রাজ্য আরও এক বার ধাক্কা খেল বলেই আইনজীবী মহলের মত।
|