‘মুক্ত চিন্তা’র সংবাদপত্র তালিকা নিয়ে বিতর্ক
রাজ্যের সরকারি গ্রন্থাগারগুলিতে কোন কোন সংবাদপত্র রাখতে হবে, তার তালিকা সম্বলিত একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তিকে ঘিরে প্রশ্ন এবং সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার। বিশিষ্ট জন থেকে সাধারণ মানুষ অনেকেরই বক্তব্য, এই নির্দেশনামা অগণতান্ত্রিক এবং ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। এর মধ্য দিয়ে মানুষ কী পড়বেন, কী পড়বেন না, সেটাই ঠিক করে দিতে সচেষ্ট হয়েছে রাজ্য সরকার।
জনশিক্ষা ও গ্রন্থাগার দফতরের বিশেষ সচিবের সই করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে পাঁচটি বাংলা, একটি হিন্দি এবং দু’টি উর্দু দৈনিকের নামের তালিকা দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে ওই আটটির বাইরে অন্য কোনও সংবাদপত্র কেনা যাবে না। যার অর্থ, রাজ্যের প্রায় আড়াই হাজার সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারের পাঠকেরা শুধু নির্দিষ্ট আটটি খবরের কাগজই পড়ার সুযোগ পাবেন। বহুল প্রচারিত অন্যান্য বাংলা সংবাদপত্র দূরস্থান, কোনও ইংরেজি খবরের কাগজও তাঁরা পাবেন না।
সোমবার প্রকাশিত সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পাঠকদের মধ্যে ‘মুক্ত চিন্তা’র প্রসার ঘটানোর স্বার্থে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কোনও রাজনৈতিক দলের মদতে প্রকাশিত কোনও সংবাদপত্র সরকারি অর্থে কেনা হবে না। অর্থাৎ বাকি সব সংবাদপত্রকেই রাজনৈতিক দল-প্রভাবিত বলে মনে করছে সরকার। বাম জমানাতেও এই সব গ্রন্থাগারে অন্যান্য সংবাদপত্রের সঙ্গে সিপিএমের দৈনিক মুখপত্র রাখা কার্যত বাধ্যতামূলক ছিল। তবে তার জন্য লিখিত নির্দেশনামা ছিল না।
ওঁরা বলছেন
কেন এমন নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে জানি না। তবে সাধারণ মানুষ হিসেবে বলব, এটা ঠিক হয়নি। সকলেরই সব রকম মত জানার অধিকার আছে। সংবাদপত্রেরও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে।
শুভাপ্রসন্ন
মানুষ লাইব্রেরিতে গিয়ে কী পড়বেন, তা-ও সরকার ঠিক করে দেবে, এটা হতে পারে না। এ তো ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ। সরকারের সব ব্যাপারে মাথা গলানো উচিত নয়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বিভিন্ন কাগজে বিভিন্ন লেখা পড়েই মানুষের মত তৈরি হয়। লাইব্রেরিতে কোন সংবাদপত্র রাখা হবে, তা সরকারের স্থির করে দেওয়াটা তাই ঠিক কাজ হয়নি। এর পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
সব মতকে সম্মান করাটাই তো গণতন্ত্র। এমন একটা নির্দেশিকা তাই আমাকে হতবাক করে দিয়েছে। এটা শুধু লাইব্রেরির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়, ব্যক্তিগত অধিকারেও হস্তক্ষেপ।
সুচিত্রা ভট্টাচার্য
এখন যে সংবাদপত্রগুলিকে গ্রন্থাগারে ‘রাখার যোগ্য’ এবং ‘মুক্ত চিন্তার’ সহায়ক বলে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বেছে নেওয়া হয়েছে, তার প্রায় সবগুলিই অবশ্য সরকার তথা শাসক দল তৃণমূলের ‘অনুগত’ বা ‘সমর্থক’ হিসেবেই পরিচিত। তালিকার প্রথম নাম ‘সংবাদ প্রতিদিন’ যার সম্পাদক এবং সহযোগী (অ্যাসোসিয়েট) সম্পাদক দু’জনেই তৃণমূলের রাজ্যসভা সদস্য। তালিকায় থাকা হিন্দি দৈনিক ‘সন্মার্গ’ এবং উর্দু দৈনিক ‘আখবর-ই-মশরিক’-এর সম্পাদকেরাও কয়েক দিন আগেই তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। সরকারের বাছাই-তালিকায় ‘সকালবেলা’ নামের আরও একটি বাংলা দৈনিক এবং ‘আজাদ হিন্দ’ নামের একটি উর্দু দৈনিক স্থান পেয়েছে। যে গোষ্ঠী ওই দু’টি সংবাদপত্রের পরিচালক, ঘটনাচক্রে ‘সংবাদ প্রতিদিনে’র সহযোগী সম্পাদকই সেই গোষ্ঠীর ‘মিডিয়া সি ই ও’। বাকি আর যে তিনটি বাংলা দৈনিক রাখার ‘ছাড়পত্র’ মিলেছে, সেগুলি যথাক্রমে ‘খবর ৩৬৫ দিন’, ‘একদিন’ এবং ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’।
এই নির্দেশের খবর জানাজানি হতেই নানা মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। রাজনীতিকরা তো বটেই, মুখ খোলেন বিশিষ্ট জনেরাও। সাধারণ ভাবে কেউই সরকারের এই ‘অগণতান্ত্রিক’ মনোভাব সমর্থন করতে পারেননি। মঙ্গলবার বিধানসভায় এ নিয়ে একই সুরে সরব হন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এবং সরকারি দল কংগ্রেসের বিধায়ক অসিত মিত্র। পরে সাংবাদিক সম্মেলনে সূর্যবাবু বলেন, “যাবতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত নড়বড়ে করে দেওয়ার চেষ্টা করছে এই রাজ্য সরকার।” অসিতবাবুও বলেন, “এই ধরনের নির্দেশ গণতান্ত্রিক বন্দোবস্তে আঘাত হানে।” সমালোচনা করে বিবৃতি দেয় সিপিআই-র যুব সংগঠন।
বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে পাঠক মহলেও। এমন একটি লিখিত নির্দেশ পেয়ে হতচকিত বিভিন্ন সরকারি গ্রন্থাগারের কর্মীরা। শিলিগুড়িতে জেলা গ্রন্থাগারের কর্মী সুজিত চক্রবর্তী বলেন, “পাঠকদের ক্ষোভ কী ভাবে সামাল দেব, জানি না।” উত্তর দিনাজপুর জেলা গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান প্রতুলচন্দ্র কর্মকারও বলেন, “ওই বিজ্ঞপ্তি কার্যকর হলে পাঠকদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা করছি।” পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থাগার কর্মী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রণজিৎ সরকার জানান, “বাম আমলে গ্রন্থাগারে সিপিএমের দৈনিক মুখপত্র রাখা নিয়ে লিখিত সরকারি নির্দেশ থাকত না। এ বার রাস্তায় নেমে আন্দোলন ছাড়া পথ নেই।”
যাঁর দফতরের জারি করা নির্দেশ নিয়ে এত আলোড়ন, সেই গ্রন্থাগারমন্ত্রী আব্দুল করিম চৌধুরী মঙ্গলবার দিনভর ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। তাঁর অফিস এবং বাড়িতে ফোন করলে বলা হয়, “মন্ত্রীর গলা খারাপ। তিনি কথা বলতে পারবেন না।” ফোনে পাওয়া যায়নি দফতরের সচিব রিনচেন টেম্পোকেও। তবে মহাকরণের খবর, এই ধরনের নির্দেশ ‘লিখিত ভাবে’ কেন বার হল, তা জানতে মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয়েছে। তথ্য দফতরকে বিষয়টি জানতে বলা হয়েছে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.