চল্লিশ বছর আগেও তিনিই ছিলেন। চল্লিশ বছর পরেও সেই তিনিই। ১৯৭৩ সালে পুরসভা ভেঙে দিয়ে প্রশাসক বসিয়েছিলেন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। এই ২০১২ সালে তিনটি জেলা পরিষদ ‘ভেঙে’ দেওয়ার সময়েও সামনে সেই সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
সাতের দশকে তাঁর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। এখন তাঁর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রতবাবু এই সমাপতনের কথা বিলক্ষণ জানেন। তিনি বলছেন, “কোনও জেলা পরিষদ তো ভাঙা হয়নি! অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে বলে আর্থিক ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া হয়েছে শুধু।”
চল্লিশ বছর আগে সুব্রতবাবু ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ‘নন-পারফরম্যান্স’-এর। এ বারও তাঁর ‘আনুষ্ঠানিক’ ব্যাখ্যা একই। কিন্তু শাসক জোটেরই একাংশের বক্তব্য, রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূলের প্রথম ‘পরীক্ষা’ আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচন। সেই ভোটে ১৩-১৪টি জেলা পরিষদ দখলের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন মমতা। কিন্তু ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ফলে তাঁর ‘জনপ্রিয়তা’য় খানিকটা হলেও ভাটার টান লেগেছে। যা তাঁর জেলা পরিষদের ‘লক্ষ্য’ পূরণে অন্তরায় হতে পারে। |
বাম নেতাদের কক্ষত্যাগ। মঙ্গলবার বিধানসভায়। নিজস্ব চিত্র |
বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক তো সরাসরি বলেছে, আগামী পঞ্চায়েত ভোটের আগে একটা ভীতিজনক মানসিকতা তৈরি করতে চাওয়া হচ্ছে। পঞ্চায়েতে মানুষের কাছে গেলে কী রায় আসবে, তা নিয়ে সংশয় হচ্ছে বলে গায়ের জোরে কাজ করতে হচ্ছে।
রাজ্য মন্ত্রিসভার এক সদস্যের ব্যাখ্যায়, জেলা পরিষদ সংক্রান্ত নির্দেশিকা দিয়ে এই ‘বার্তা’ই দেওয়া হচ্ছে যে, বামেদের জেলা পরিষদ কাজ করতে পারছে না। তাই তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন সরকার উন্নয়নের কাজ করাতে প্রশাসনকে দায়িত্ব দিচ্ছে। ঘটনাচক্রে, সাবেক বাম সরকার পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার তৃণমূল পরিচালিত জেলা পরিষদের বিরুদ্ধে ‘অকর্মণ্যতা’র অভিযোগ তুললেও এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। সুব্রতবাবুর বক্তব্য, “হতে পারে বাম সরকার বদান্যতা দেখিয়েছিল। আবার এ-ও হতে পারে, দুই জেলা পরিষদ ভাল কাজ করছিল বলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি আগের সরকার।”
বিরোধী দলনেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্রের অভিযোগ, উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের আর্থিক ক্ষমতা যে ভাবে সভাধিপতিদের হাত থেকে নিয়ে জেলাশাসকদের দেওয়া হয়েছে, সেই নির্দেশ ‘আইনবিরুদ্ধ ও অগণতান্ত্রিক’। যার প্রতিবাদে এ দিনই পথে নামে সিপিএম। উত্তর ২৪ পরগনায় জেলাশাসকের দফতরের সামনে বিক্ষোভ দেখায় জেলা বামফ্রন্ট। সেখানে ছিলেন অমিতাভ নন্দী, অমিতাভ বসু, তড়িৎ তোপদার প্রমুখ। জেলাশাসকের কাছে তাঁরা স্মারকলিপি দেন।
সিপিএম-সহ বিরোধীদের প্রতিবাদের জবাবে বর্তমান পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রতবাবু অবশ্য পাল্টা বলছেন, “সূর্যবাবুর তৈরি বিধি মেনে বামফ্রন্টের আমলে তিন জেলার বহু গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। আমরা তা করিনি। অকর্মণ্যতার কারণে সূর্যবাবুদের তৈরি আইন মেনে শুধু তিন জেলা পরিষদের আর্থিক দায়িত্ব দিয়েছি জেলাশাসকদের হাতে।”
তিন জেলা পরিষদ সংক্রান্ত সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার পর শাসক-বিরোধী শিবিরের চাপানউতোর তুঙ্গে। ওই বিজ্ঞপ্তি জারি করার আগে সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদগুলিকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছিল কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। প্রেশ্ন তোলা হয়েছে, জেলাশাসকের হাতে দায়িত্ব না-দিয়ে ওই ক্ষমতা জেলা পরিষদের সভাধিপতিকেই কেন দেওয়া হল না?
পঞ্চায়েত বিশেষজ্ঞদের অবশ্য অভিমত, বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তকে ‘বেআইনি’ বলা যায় না। তবে তাঁদের মতে, প্রশ্ন এখানে ‘দৃষ্টিভঙ্গি’র। যাকে বিরোধীরা বলছে ‘অভিসন্ধি’।
সুব্রতবাবু নিজেও মঙ্গলবার সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা উল্লেখ করে তাঁর সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে প্রশাসনের একাংশের মতে, ‘অচলাবস্থা’র কারণ দেখিয়ে জেলা পরিষদের আর্থিক ক্ষমতা সভাধিপতির হাতে দেওয়া হলে এই ‘বিতর্ক’ হত না। বিতর্কের কারণ প্রথমত, নির্বাচিত জেলা পরিষদের ক্ষমতা গিয়েছে আমলার হাতে। দ্বিতীয়ত, আইনে সংস্থান থাকলেও তার প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে বিরোধী বামফ্রন্টের অধীন জেলা পরিষদগুলির উপরে। সেখানেই রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ খুঁজে পাচ্ছে বিরোধীরা।
সরকার চাইলে কি এই ‘অপ্রীতিকর’ পরিস্থিতি এড়াতে পারত না? রাজ্যের পঞ্চায়েত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের দিক থেকে পঞ্চায়েতমন্ত্রী কোনও ভুল করেননি। কিন্তু অন্য ভাবেও এর সমাধান করা যেত। তাঁদের মতে, এখানেই আসছে ‘দৃষ্টিভঙ্গি’র প্রশ্ন। বাজেট পাশ না-করাতে পারলে সরকার অবশ্য আইনানুগ বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু সে অধিকার জেলাশাসককে না-দিয়ে জেলা পরিষদের সভাপতিকে দিলে ‘স্থানীয় সরকার’কে মর্যাদা দেওয়া হত। সরকারের পাল্টা যুক্তি, ২০১০-এ বামফ্রন্ট সরকার যখন পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বাঁকুড়া জেলার বেশ কিছু গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল, তখন কিন্তু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিডিও-কে। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিকে, অর্থাৎ, ‘স্থানীয় সরকার’কে নয়।
জেলা পরিষদের ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে বিধানসভাও ছিল সরগরম। প্রাক্তন পঞ্চায়েতমন্ত্রী তথা সিপিএম বিধায়ক আনিসুর রহমান একটি দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব পড়তে গেলে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বলেন, সংশোধিত প্রস্তাবটি পড়তে। তখন বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু মুলতবি প্রস্তাব তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাজেট অধিবেশন চলার জন্য তা নাকচ করেন স্পিকার। ক্ষুব্ধ বিরোধীরা ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখান। পরে সভা ছেড়ে বেরিয়ে যান। অধিবেশনের প্রথমার্ধে ওই ঘটনার পর দ্বিতীয়ার্ধে দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাবের জবাব দিতে চেষ্টা করেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। কিন্তু বিরোধীরা তা শুনতে অস্বীকার করেন। বাধ্য হয়ে সুব্রতবাবু বাইরে সাংবাদিক সম্মেলন করে বক্তব্য জানান।
জেলা পরিষদের আর্থিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়াকে সরকারের ‘গণতন্ত্র-বিরোধী’ কার্যকলাপের তালিকায় ‘নবতম সংযোজন’ বলে চিহ্নিত করেছেন বিরোধী দলনেতা। তিনি বলেন, “গত কাল (সোমবার) বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত এই নির্দেশের ব্যাপারে আমরা কিচ্ছু জানতাম না। সরকার কি তা হলে রাতে নির্দেশ জারি করছে?” সূর্যবাবুর অভিযোগ, যে আদেশের ভিত্তিতে তিনটি জেলা পরিষদের আর্থিক দায়িত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তা ১৯৭৩ সালের পঞ্চায়েত আইনের বিরোধী। তাঁর কথায়, “নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, আইনের ২১২ ধারা অনুযায়ী এটি করা হয়েছে। কিন্তু এই ধারা মেনে সরকার এমন কাজ করতে পারে না।” |
মন্ত্রী সুব্রতবাবু পাল্টা বলেছেন, “তিন জেলা পরিষদ ভাঙা হয়েছে বলে বিরোধীদের প্রচার সম্পূর্ণ অসত্য। আমরা শুধু অকর্মণ্যতার কারণে আর্থিক ক্ষমতা জেলাশাসকদের হাতে তুলে দিয়েছি। বাকি সব ক্ষমতা জেলা পরিষদেরই রয়েছে।” তাঁর আরও সংযোজন, “আরও কয়েকটি জেলা পরিষদ ভেঙে দেওয়া উচিত বলে মনে করি! কিন্তু আমরা তা করছি না।” তাঁর যুক্তি, “অনেক জেলা পরিষদ কাজ করছে না। ফলে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা ফেরত চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রাজ্য সরকার তা হতে দিতে পারে না বলেই এই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।”
১৯৭৩ সালে কংগ্রেস জমানায় রাজ্যের পঞ্চায়েত আইনটি বিধানসভায় পেশ করেছিলেন বর্তমান পঞ্চায়েতমন্ত্রীই। তার পর বামফ্রন্ট সরকার কয়েক বার সেই আইন সংশোধন করে। তাদের সর্বশেষ সংশোধন ছিল ২০০৮ সালের ৩০ জুলাই, যখন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী ছিলেন সূর্যবাবু। সুব্রতবাবু বলেন, “১৯৭৩ সালের আইনের ২১২ ধারা এবং সূর্যবাবুর তৈরি ২৭ নম্বর বিধি মেনেই তিন জেলা পরিষদের আর্থিক ক্ষমতা জেলাশাসকদের হাতে দেওয়া হয়েছে। সূর্যবাবুর স্মৃতি বোধহয় দুর্বল হয়ে গিয়েছে। মনে করিয়ে দিই, এই আইন দিয়েই তাঁরা পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর এবং পুরুলিয়ার ৬৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং চারটি পঞ্চায়েত সমিতি ভেঙেছিলেন। আমরা তা করিনি।” তথ্য বলছে, ওই ওই পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির সিংহভাগই ছিল বামফ্রন্টের এবং জঙ্গলমহলে। যেখানে মাওবাদী হানার ভয়ে কাজকর্ম শিকেয় উঠেছিল। ফলে বিরোধী শিবির এ কথাও বলার সুযোগ পাচ্ছে যে, একই আইন প্রয়োগ হলেও বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্ত ‘অভিসন্ধিমূলক’। কারণ, এই তিনটি জেলা পরিষদই বামেদের দখলে। |