এর আগে তিনি বলেছিলেন, সমবায়ের ঋণ শোধ না করলেও চাষিদের জমি-বাড়ি নিলাম হবে না। এর ফলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তা হলে আর হয়তো বকেয়া ঋণ শোধই করবে না বেশির ভাগ চাষি। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এ দিন ঋণ শোধের জন্য বাড়তি সময় এবং এক বার ঋণ শোধ করলে পরের বার কম সুদে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। অনেকেই বলছেন, নিজের কথা থেকে সরে না এলেও ঋণ শোধ করাটা যে জরুরি, এ দিন মুখ্যমন্ত্রী সেই বার্তাই দিতে চেয়েছেন এ ভাবে।
মুখ্যমন্ত্রী এ কথা বলেছেন রাজ্যের ‘শস্যগোলা’ বর্ধমানে দাঁড়িয়ে, ধান ও আলুর অতিফলনের জেরে গত মরসুমে আত্মঘাতী চাষিদের বেশির ভাগই যে জেলার বাসিন্দা। সেখানে চাষিদের কিষাণ কার্ড ও ব্যাঙ্কঋণ দিতে এসেছিলেন তিনি। ঋণ শোধের প্রসঙ্গও এসেছে সেই সূত্রেই। সমবায়ের ঋণ শোধ না করলেও যে চাষিদের জমি-বাড়ি নিলাম করা হবে না, সেই কথা ফের জানানোর পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, “চাষি যাতে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে ঋণশোধ করতে পারেন, তার জন্য অতিরিক্ত সময় দেওয়া হবে। সময়ে ঋণশোধ করলে পরের বার ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বছরে ৭%-র বদলে ৪% হারে সুদ নেওয়া হবে।” |
পরিবর্তন চাই চাষেও। বর্ধমানের পুলিশ লাইন মাঠে বিকল্প চাষের কথা
বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবারের নিজস্ব চিত্র। |
চাষিদের সরকারি ঋণ শোধে উৎসাহ দিতেই মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ, তাঁর আগের বক্তব্যে সমবায় ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। বকেয়া ঋণ আদায়ে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল ব্যাঙ্ককর্মীদের। একই সঙ্গে ফসলে বৈচিত্র আনার উপরেও জোর দিয়েছেন তিনি। ফসলের যথাযথ বিপণনের জন্য সর্বত্র স্থানীয় পাইকারি বাজার বা ‘কিষাণ মান্ডি’ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
ধান ও আলুর অতিফলনের জেরে গত মরসুমে চাষিদের একটা বড় অংশ ফসলের দাম পাননি। সেই বিপর্যয়ের জেরে মহাজনি ঋণের ফাঁসে জড়িয়ে একের পর এক চাষির আত্মহত্যার অভিযোগও ওঠে। মমতা এ দিন সরাসরি সে প্রসঙ্গ তোলেননি। তবে মহাজনি ঋণের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “চুরি করে সুদে টাকা ধার নিয়ে, জীবন বলিদান দিয়ে ভাল কিছু করা যায় না।” মুখ্যমন্ত্রী চাষিদের সরকারি ঋণ নিতে বলেন। ফড়েদের কাছে যাতে চাষিদের ‘অভাবী বিক্রি’ আটকাতে গলসি ১, কেতুগ্রাম ২, মেমারি ১ এবং ভাতার ব্লকে প্রস্তাবিত চারটি ‘কিষাণ মান্ডি’র ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন করেন মমতা বর্ধমান শহরে পুলিশ লাইনের মাঠের মঞ্চ থেকেই। বলেন, “রাজ্যের ৩৪১টি ব্লকেই কিষাণ মান্ডি তৈরি করা হবে, যাতে প্রতিটি এলাকার চাষিরা মান্ডিতে এসে ফসল বিক্রি করতে পারেন।”
গত বার আলু চাষে বিপর্যয়ের কথা তুলে মমতা বলেন, “বিদেশে আলু পাঠানোর জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলাম। পরে শুনলাম, এই রাজ্যে যে ধরনের আলু হয়, তা বিদেশে নেয় না। যাতে রফতানিযোগ্য আলু উৎপাদন করা যায়, সে ব্যাপারে আমরা উদ্যোগী হব।” কৃষি বিশেষজ্ঞের মতে অবশ্য, রাজ্যে আলুর চাষ অন্তত একের চার ভাগ কমিয়ে ফেলা দরকার। কমানো দরকার বোরো ধানের চাষও। বদলে ঢালাও দানাশস্য, তৈলবীজ, এমনকী গম চাষেরও পক্ষে তাঁরা। রাজ্যের প্রাক্তন কৃষি অধিকর্তা ধবলেশ্বর কোনার জানান, বছরে অন্তত ৬০% সর্ষে ও অন্য তৈলবীজ ভিন্ রাজ্য থেকে আমদানি করতে হয়। তা রাজ্যে চাষ করলে নিজেদের চাহিদা মিটিয়েও অন্যত্র রফতানি করা চলে। আবহাওয়াবিদ স্বদেশরঞ্জন মিশ্রের মতে, খরিফ ধান ওঠার পরে মুগ, মুসুর, অড়হর ডালের চাষ করলে যেমন ভাল দাম মেলে, জমির হৃতস্বাস্থ্যও পুনরুদ্ধার হয়। |
মুখ্যমন্ত্রীও বলেন, “ধান কমিয়ে ২৫% জমিতে ডালের চাষ করতে হবে। বিদেশেও তা বিক্রি করে অতিরিক্ত রোজগার করতে পারবেন চাষিরা।” তাঁর আশ্বাস, “কোন ফসলের চাষ করলে বেশি লাভ পাওয়া যাবে, তা দেখতে কৃষি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গড়া হয়েছে।”
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী কৌশিক ব্রহ্মচারী বা কৃষিবিজ্ঞানী অমিত চট্টোপাধ্যায় বলছেন, কোথাকার চাষি কোন চাষে দক্ষ এবং কী চাষ হলে ন্যায্য মূল্যে ফসল বাজারজাত করা যাবে, ব্লক ধরে ধরে তা খতিয়ে দেখা উচিত। এ জন্য উপগ্রহ চিত্রের সাহায্যও নেওয়া যেতে পারে।
মমতার আশ্বাস, বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ চাষিদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। চাষিদের পরামর্শ দিতে প্রতি অঞ্চলে নিয়োগ করা হবে দু’জন করে ‘কিষাণ বন্ধু’। রাজ্যের যা হাঁড়ির হাল, এত নতুন খরচের বোঝা কী করে টানা যাবে, তা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী ব্যাখ্যা করেননি। |