রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের পাকিস্তান সফর নিয়ে ব্যাখ্যা চাইল রাজ্য সরকার। বৃহস্পতিবার এ ব্যাপারে কমিশনের সচিবকে লেখা চিঠিতে ওই সফর সম্পর্কে পাঁচ দফা প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব। দ্রুত ওই সব প্রশ্নের জবাব চাওয়া হয়েছে কমিশনের কাছ থেকে। কিন্তু মানবাধিকার কমিশনের  মতো আধা-বিচারবিভাগীয় সংস্থার প্রধানের কাছ থেকে রাজ্য সরকার এমন কৈফিয়ত চাইতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। সেই বিতর্ক দূরে রাখলেও রাজ্যের পদক্ষেপকে অশোভন বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশ।
সরকারি সূত্রের খবর, জুনের প্রথম সপ্তাহে এক বেসরকারি সংস্থার আমন্ত্রণে পাকিস্তানের সংবিধান ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে আলোচনা সভায় যোগ দিতে সে দেশে যান সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোকবাবু। দেশের আরও কয়েক জন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ তাঁর সঙ্গী ছিলেন।
এ দিন স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠানো চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়েছে এক, সফর কত দিনের এবং তার উদ্দেশ্য কী ছিল? দুই, সফরের বিষয়ে কি রাজ্যপালকে জানানো হয়েছিল বা তাঁর অনুমতি নেওয়া হয়েছিল? তিন, সফরের খরচ কি রাজ্য মানবাধিকার কমিশন মিটিয়েছে? তা না হলে কে দিয়েছে? এই সংক্রান্ত খরচখরচার উৎসের যাবতীয় হিসেব পেশ করা হোক। চার, সফরের সময় বিদেশি আতিথ্য নেওয়া হয়েছিল কি? সেই আতিথ্য কি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুমতি সাপেক্ষ? ২০১১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ফরেন কন্ট্রিবিউশন (রেগুলেশন) অ্যাক্ট’ মেনে যে নির্দেশিকা মন্ত্রক জারি করেছিল, তা মানা হয়েছিল কি? এবং পাঁচ, এই বিষয়ে জানানোর মতো আরও কিছু তথ্য আছে কি? |
রাজ্যের চিঠি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে অশোকবাবু এ দিন বলেন, “এই ধরনের কোনও চিঠি এখনও হাতে পাইনি। চিঠি পেলে জবাব দেব। তবে সংবাদমাধ্যমকে নয়, যিনি চিঠি পাঠিয়েছেন তাঁকেই।”
কিন্তু স্বরাষ্ট্রসচিব আদৌ এমন চিঠি দিতে পারেন কিনা, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “যদি রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব এ রকম ব্যাখ্যা চেয়ে থাকেন, তা হলে তা অশোভন এবং এক্তিয়ার বহির্ভূত।” তাঁর মতে, এ ব্যাপারে আদৌ কিছু জানার প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় সরকার তা জানতে চাইতে পারে। কিন্তু রাজ্য নয়।
মানবাধিকার কমিশনের প্রধানের সফর নিয়ে কেন তৎপর রাজ্য?
মহাকরণের একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, ব্যঙ্গচিত্র পর্ব থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ হয়ে সাম্প্রতিক কামদুনি কাণ্ড কমিশন যে ভাবে নিজে থেকে তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছে এবং সরকারের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠাচ্ছে, তাতে প্রচণ্ড রুষ্ট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিছু দিন আগে এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী কটাক্ষের সুরে জানিয়েছিলেন, যাঁকে এই পদে বসিয়েছিলেন, তিনিই এখন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির মতো আচরণ করছেন! কমিশন-সরকার সম্পর্ক যে তলানিতে, তা মানছেন সরকারি কর্তারাও। পাক সফর নিয়ে জবাবদিহি চেয়ে চিঠি পাঠানো তারই জের বলে ধারণা অনেকের। আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “উনি রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। আর ওঁর পাকিস্তান সফর নিয়ে রাজ্য অন্ধকারে!”
পাকিস্তান সফরে গিয়ে অশোকবাবু নিয়ম ভেঙেছেন বলেই রাজ্য সরকারের আমলাদের একাংশের দাবি। এক শীর্ষ সরকারি কর্তার কথায়, “২০১০ সালের ‘ফরেন কন্ট্রিবিউশন (রেগুলেশন) অ্যাক্ট’-এর তিন নম্বর ধারা অনুযায়ী কোনও বিচারপতি বিদেশ ভ্রমণে গেলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাজনৈতিক এবং বৈদেশিক মুদ্রা সংক্রান্ত ছাড়পত্র নিতে হবে তাঁকে। মানবাধিকার কমিশনের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হলেও তিনি একটি স্বশাসিত সংস্থার শীর্ষ পদে রয়েছেন। ফলে তাঁরও এই অনুমোদন নেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সে সব হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ, এফসিআরএ ছাড়পত্র আদায় করা হয় রাজ্য সরকারের মাধ্যমেই।”
যদিও এই মতের সঙ্গে একমত নন মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের অনেকেই। এক প্রাক্তন চেয়ারম্যানের মতে, “এ সব করার কোনও মানে হয় না। শুনলে অস্বস্তি হয়। আসলে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ মেটাতে এ সব করা হচ্ছে।” কমিশনের দীর্ঘদিনের সদস্য অপর এক বিচারপতি জানান, অতীতে এক চেয়ারম্যান একটি ধর্মীয় সংস্থার আমন্ত্রণে বিলেত এবং মার্কিন মুলুকে গিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত সেই সফর নিয়ে কোনও অনুমতি তখনও নেওয়া হয়নি। কোনও হইচইও হয়নি। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের এক কর্তা জানান, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি ছিলেন অশোকবাবু। গিয়েছেন পাকিস্তানের মতো একটি দেশে, যে দেশের ভিসা কারা পাচ্ছেন, তাদের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের তীক্ষ্ন নজর থাকে। তার পরেও দেশের আরও কয়েক জন খ্যাতনামা আইনজ্ঞদের সঙ্গে তিনি যখন পাকিস্তান গিয়েছেন, তখন সব নিয়ম মেনেই গিয়েছেন। সরকারি চিঠি পেলে তার উপযুক্ত জবাবও দেওয়া হবে বলে জানান ওই কর্তা।
|