আশার ছলনে ভুলেই জামাই ষষ্ঠীটা কাটাল বাঙালি!
শুক্রবার ভরবিকেলের মানিকতলা বাজারে জলের উজ্জ্বল শস্য ছুঁয়েও হাত সরিয়ে নিলেন অমৃতা রায় সোম। ডায়মন্ড হারবার-কাকদ্বীপের তাজা ইলিশ কলকাতায় ঢুকছে বটে। কিন্তু তার ওজন টেনেটুনে ৫০০-৬০০ গ্রাম। দাম সেই ৫০০-৬০০ টাকা কিলোগ্রাম। এত ছোট মাছের জন্য এত টাকা খরচ করা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়নি অমৃতার। ক্বচিৎ-কদাচিৎ কোলাঘাটের ইলিশেরও দেখা মিলেছে। তবে দাম ১০০০-১২০০ টাকার কম নয়। বাংলাদেশের বরফের ইলিশের দাম তারও এক কাঠি উপরে। কাগজে-কলমে ও-পার বাংলার ইলিশ আমদানি বন্ধ থাকলেও সেখানকার ইলিশই এখন এ তল্লাটের বাজারে বাজারে রাজত্ব করছে। সকালে গড়িয়াহাট, দমদমে দু’হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে ইলিশ!
রুবি হাসপাতালের কাছের বাজার জরিপ করতে গিয়েও ইলিশের মোটামুটি একই দর দেখেছেন সুদেষ্ণা বসু। বেশি দাম দিয়ে কম ওজনের ‘পানসে’ মাছ (তার দামও যথেষ্ট বেশি) নিতে সাহস হয় না। আর বড়সড় ইলিশ হাতে ধরতে গেলেও স্রেফ আকাশছোঁয়া দামের জন্য ছেঁকা লাগে। মানিকতলা, গড়িয়াহাট, কসবা, দমদম, বাগুইআটি, লেক মার্কেট সর্বত্র এটাই ইলিশ-চিত্র। |
হাওড়ার পাইকারি বাজারে ফিশ ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সৈয়দ আনোয়ার মকসুদের দাবি, “বাংলাদেশি ইলিশ যেটা পাচ্ছি, সেটা টাটকা নয়। ফ্রিজে রাখা মাছ। তবে এই বাজারে এটাই বা মন্দ কী!” দক্ষিণ ২৪ পরগনার মৎস্যজীবীরা হাহুতাশ করছেন, এত কাঠখড় পুড়িয়ে যা উঠল, তাতে ৭০০-৭৫০ গ্রামের ইলিশ খুঁজে পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। মোহনায় জাল ফেলে যা উঠছে, তার চোদ্দো আনাই ৪৫০-৫০০ গ্রামের ইলিশ।
ভরা বর্ষার ইলিশ-ঋতুতে ডায়মন্ড হারবার-কাকদ্বীপে গড়ে ২০০টি মৎস্যযান এক-এক দিনে ৮০০-১০০০ টন ইলিশও নিয়ে আসে! এ বার পুবালি বাতাসে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি দেখে মৎস্যজীবীরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৪০০ টনের বেশি মাছ আসেনি। দিঘার অবস্থা আরও খারাপ। দিঘার ফিশারমেন্স অ্যান্ড ফিশ ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক শ্যামসুন্দর দাস জানান, এখনও পর্যন্ত টেনেটুনে দেড়-দু’টন ইলিশ উঠেছে। অন্যান্য বছর এই সময় দিঘায় রোজ অন্তত ৩০-৪০ টন ইলিশ উঠত। এ বার তা হচ্ছে না। তবে শ্যামসুন্দরবাবুর বক্তব্য, ইলিশের সেরা সময়টা আসতে এখনও সপ্তাহখানেক দেরি আছে।
শ্যামসুন্দরবাবুর বক্তব্যে যে-আশা প্রচ্ছন্ন আছে, তাতে আস্থা রাখছেন কাকদ্বীপের বাসিন্দা, ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিশারমেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বিজন মাইতিও। তিনি জানান, এ-যাত্রা মাছ ধরতে গিয়েও মৎস্যযানগুলি খারাপ আবহাওয়ার সঙ্গে যুঝতে না-পেরে ফিরে এসেছে। তবে ঝোড়ো হাওয়ার দাপট কমলে আর ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা চলতে থাকলে মৎস্যজীবীদের পরিশ্রম বৃথা যাবে না। সব থেকে বড় কথা, বর্ষা এ বার ঠিক সময়ে এসেছে। তাই বঙ্গোপসাগরের লাগোয়া সাগরদ্বীপ, ফ্রেজারগঞ্জ, কেন্দুদ্বীপ, বকখালি, কলসদ্বীপ এলাকায় মরসুমি রুপোলি শস্যের আশা ছাড়তে রাজি নন মৎস্যজীবীরা।
এই আশাটুকুই তাঁদের সম্বল। গত দু’বছরে তেমন ইলিশ-শিকার না-হওয়ায় মৎস্যজীবীদের অনেকেরই পিঠ ঠেকেছে দেওয়ালে। এ বার এখনও পর্যন্ত যা ইলিশ উঠেছে, তাতে মৎস্যজীবী বা গৃহস্থ কারও স্বস্তি নেই। জোগান কম। তাই ডায়মন্ড হারবারের পাইকারি নগেন্দ্রবাজারে বড়সড় পুঁটিমাছের আকারের ইলিশই ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। স্বাদও ভাল নয়।
এই অবস্থা কেন? “এখন বাংলাদেশ হয়ে এ দিকে আসার
আগেই সব ইলিশ ধরা পড়ে যাচ্ছে। নদীতে দূষণের জেরেও ইলিশ অন্য দিকে সরে যাচ্ছে,” ব্যাখ্যা দিলেন কুলতলির প্রাক্তন বিধায়ক তথা
ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিশারমেন অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক জয়কৃষ্ণ হালদার। অবশ্য নগেন্দ্রবাজারের আড়তদার মানু মণ্ডল এ যুক্তি মানতে রাজি নন। তাঁর আশা, আবহাওয়াটা এমন থাকলে ক’দিন বাদেই কপাল খুলবে ইলিশ-শিকারিদের। এখনও অবশ্য আড়তে ইলিশ কম। চিংড়ি-পমফ্রেটেরই নিলাম চলছে।
শহুরে জামাইষষ্ঠীর মেনুতেও এ দিন ইলিশ বাতিল করে চিংড়ি, আড় মাছই বেছে নিলেন অমৃতা-সুদেষ্ণারা।
|