সারদা-কাণ্ড এবং তার জেরে পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক অর্থলগ্নি সংস্থার মালিক, এজেন্ট ও আমানতকারী আত্মঘাতী হওয়ার পরে সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরি করল না কেন্দ্র। বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার দৌরাত্ম্য দমনে গঠিত হল উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন আন্তঃমন্ত্রক গোষ্ঠী। সব ধরনের অর্থলগ্নি সংস্থাগুলিকে এক ছাতার তলায় এনে কী ভাবে তাদের বেআইনি আমানত সংগ্রহ বন্ধ করা যায় এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত করা যায়, তা ঠিক করার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে এই গোষ্ঠীকে। অর্থ মন্ত্রকের রাজস্ব, আর্থিক পরিষেবা, অর্থ বিষয়ক দফতর, কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক, সেবি ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তাদের নিয়ে তৈরি এই গোষ্ঠীর চেয়ারপার্সন হয়েছেন আর্থিক পরিষেবা দফতরের অতিরিক্ত সচিব স্নেহলতা শ্রীবাস্তব। মধ্যপ্রদেশ ক্যাডারের এই পোড় খাওয়া আমলা দায়িত্ব নিয়েই ১৬ মে আন্তঃমন্ত্রক গোষ্ঠীর বৈঠক ডেকেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে সারদা কেলেঙ্কারির জেরে লক্ষ লক্ষ আমানতকারী পথে বসার পরেই নড়েচড়ে বসে কেন্দ্র। মে-র শুরুতেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক, সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শীর্ষকর্তাদের বৈঠকে ঠিক হয়, বেআইনি লগ্নি সংস্থার দৌরাত্ম্য দমনে পৃথক একটি নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা গড়া হবে। লগ্নি সংস্থার আর্থিক অনিয়ম রুখতে এত উচ্চপর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রক গোষ্ঠী এই প্রথম। অর্থ মন্ত্রকের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “চিট ফান্ডের বিরুদ্ধে আগে এ ভাবে দল বেঁধে মাঠে নামিনি।” |
অর্থ মন্ত্রকের ব্যাখ্যা, সারা দেশেই নানা ফিকিরে মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলছে অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি। কোথাও বহুস্তরীয় বিপণন সংস্থা বা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানির নামে তো কোথাও কালেকটিভ ইনভেস্টমেন্ট স্কিম তৈরি করে। এ ছাড়া নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলো তো রয়েইছে। এই সব সংস্থার কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কী ধরনের আইন রয়েছে এবং কী ভাবে তা পুরোপুরি রূপায়ণ করা যায়, তা খতিয়ে দেখবে এই গোষ্ঠী। সরকারি সূত্রের বক্তব্য, সুদীপ্ত সেনের মতো লগ্নি সংস্থার মালিকরা আমানতকারীদের কোটি কোটি টাকা কোথায়, কী ভাবে কাজে লাগাচ্ছেন, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, লগ্নি সংস্থাগুলি কেউ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, কেউ বা সেবি-র অনুমোদন নিয়ে কাজ করে। কেউ কেউ আবার কোম্পানি আইনের আওতায় পড়ে। এই তিন রকম আইনের মাঝের ফাঁক গলে অনেকেই বেরিয়ে যায়। বেআইনি লগ্নি সংস্থাগুলির তরফে যুক্তি দেওয়া হয়, তাদের ব্যবসার ধরন সেবি বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, কারও আওতাতেই পড়ে না। আইনের এই ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে তা বন্ধ করার দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে নতুন গোষ্ঠীকে। মন্ত্রকের এক কর্তার বক্তব্য, আইনত চিট ফান্ডের কারবার নিষিদ্ধ নয়। দেশের বিভিন্ন অংশে স্বল্প আয়সম্পন্ন ব্যক্তিরা নিজেরাই চিট ফান্ড তৈরি করেন। প্রতি মাসে অল্প পরিমাণে টাকা জমিয়ে একটি তহবিল তৈরি হয়। প্রয়োজনে সেখান থেকেই তাঁরা ধার নেন। এতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বহু সংস্থা নিজেদের চিট ফান্ড বলে সরকারি খাতায় নাম নথিভুক্ত করাচ্ছে। তার পর বেআইনি পথেচড়া সুদের লোভ দেখিয়ে বাজার থেকে টাকা তুলছে। এক জন আমানতকারী আরও আমানতকারী জোগাড় করে আনছেন। বদলে তারাও চড়া হারে কমিশন পাচ্ছেন। তখন আর সেটা চিট ফান্ড থাকছে না, হয়ে যাচ্ছে পন্জি স্কিম। সুদীপ্ত সেনের সারদা গোষ্ঠীর ব্যবসাটাও এই রকমই ছিল। এই সংস্থাগুলি মূলত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার, স্বল্পশিক্ষিত, সরল সাধাসিধে মানুষকে নিশানা করছে। খুব কম সময়ে জমা টাকা দু-তিনগুণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের জালে পড়ছেন।
তবে মন্ত্রকের কর্তারা মনে করছেন, শুধু নজরদারি বাড়িয়ে এই সংস্থাগুলির কাজে লাগাম পরানো যাবে না। সরকারি স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পগুলিকে উৎসাহ না দিলে, গ্রামে গ্রামে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছে না দিলে লগ্নি সংস্থাগুলির রমরমা বাড়বেই। উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন গোষ্ঠী খতিয়ে দেখে নতুন নীতি নির্ধারণ করবে।
|