হিসেব মেলাতে গিয়ে তো মাথার চুল ছেঁড়ার জোগাড় হয়েছিলই। হিসেব যখন প্রায় মিলে গেল, তখনও যে ধন্দ!
সারদা গোষ্ঠীর বিনিয়োগের অঙ্ক ঘাঁটতে গিয়ে ওই ধন্দেই চোখ প্রায় কপালে উঠেছে তদন্তকারীদের। বাজার থেকে তোলা টাকার কতটা বিভিন্ন সংস্থায় বিনিয়োগ করা হত, তার হিসেব মেলাতে গিয়ে কয়েক দিন ধরে নাজেহাল হচ্ছিলেন তদন্তকারীরা। এ বার সেই হিসেব মিলতেই নতুন ধাঁধা হাজির হয়েছে তাঁদের সামনে।
কী রকম ধাঁধা?
বিধাননগর পুলিশের এক গোয়েন্দাকর্তা বুধবার জানান, বাজার থেকে ১০০ টাকা তোলা হলে তার ২৪ টাকা পেতেন এজেন্টরা। ১১ টাকা যেত সংশ্লিষ্ট শাখার খরচ খাতে। বাকি ৬৫ টাকা পৌঁছত সল্টলেকে সারদা গোষ্ঠীর মূল দফতরে। “তবে সেটাও যে বাজারে বিনিয়োগ করা হত, তা কিন্তু নয়” বলছেন তদন্তকারীরা। ওই পুলিশকর্তা জানান, ৬৫ টাকার একটি অংশ কেটে নেওয়া হত সারদার কর্মীদের মাইনে হিসেবে। তার পরে বাকি অংশ বিভিন্ন সংস্থায় বিনিয়োগ করতেন সারদা-কর্তা।
এবং এখানেই ধন্দ তদন্তকারীদের। তাঁদের বক্তব্য, কর্মীদের মোটা বেতন দিয়ে যা পড়ে থাকত, তা মূল আমানতের প্রায় অর্ধেক। তা হলে এত বেশি টাকা ফেরত দেওয়ার রহস্যটা কী? ধাঁধা এটাই।
তদন্তকারীদের বক্তব্য, সারদার অন্যতম জনপ্রিয় প্রকল্প ছিল দেড় বছরের আমানতে ২২ শতাংশ সুদ। অর্থাৎ কেউ যদি ১০০ টাকা রাখতেন, তা হলে দেড় বছর পরে ১২২ টাকা পেতেন। যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই বেশি। কিন্তু পুলিশ বলছে, খরচের বহর হিসেব করলে ২২ শতাংশের অনেক বেশি দাঁড়াচ্ছে।
কী রকম?
এক গোয়েন্দা অফিসার বলেন, “কোনও আমানতকারী ১০০ টাকা সারদায় রাখলেন। সংস্থার সব খরচখরচা বাদ দিয়ে তা দাঁড়াল খুব বেশি হলে ৫০ টাকায়। কিন্তু দেড় বছর পরে ফেরত দিতে হবে ১২২ টাকা। অর্থাৎ বাজারে বিনিয়োগ করা টাকার প্রায় সাড়ে চার গুণ ফেরত দিতে হত সারদাকে। যা প্রায় অসম্ভব।” এ ছাড়াও এজেন্টদের উৎসাহিত করতে নানান রাস্তা বার করত সারদা গোষ্ঠী। পুলিশের বক্তব্য, এ ভাবে কোনও ব্যবসাই টিকে থাকতে পারে না। এত বেশি সুদের জন্যই সারদা-সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছে বলে গোয়েন্দাদের একাংশের অভিমত।
তদন্তকারীদের একাংশ অবশ্য বলছেন, সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের মস্তিষ্কপ্রসূত এই সব প্রকল্প যে ভাঁওতা ছাড়া আর কিছুই নয়, সেটা ওই সংস্থার ব্যবসা সংক্রান্ত তথ্য ঘাঁটলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। পুলিশি সূত্রের খবর, সারদা অর্থ লগ্নি সংস্থার ব্যবসার মূল আকর্ষণ ছিল জমি। বিভিন্ন জায়গায় জমি দেখিয়ে সারদাকে লাভজনক সংস্থা হিসেবে তুলে ধরা হত। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নানা ধরনের অভিনব ব্যবসা-কৌশলও। এক পুলিশকর্তা জানান, সায়েন্স সিটিতে সারদার এক অনুষ্ঠানে হাসনাবাদে ডাবের জল পাউচে ভরে বিক্রির কারখানা গড়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই সংস্থার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল অবধূত অ্যাগ্রো প্রাইভেট লিমিটেড’। যদিও পুলিশ খোঁজ নিয়ে জেনেছে, ওই সংস্থার নাম দেওয়াই সার। ইছামতী নদীর ধারে ঘোষিত সেই প্রকল্পে একটুও কাজ এগোয়নি। এমনকী সুদীপ্ত পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে যে-সংস্থার ১৫ শতাংশ শেয়ার কিনেছিলেন বলে জানান, সেটাও ভুয়ো বলে পুলিশের দাবি। তদন্তকারীদের বক্তব্য, সংস্থার নামের সঙ্গে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ কথাটি জুড়ে দিয়ে প্রকল্পটিতে সরকারি মোড়ক দিতে চেয়েছিলেন সুদীপ্ত।
এ ভাবেই সারদা কাণ্ডের তদন্তে নেমে আর্থিক সম্পত্তির হদিস করতে গিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছে বিধাননগর পুলিশের অফিসারেরা। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ঘেঁটেও তাজ্জব হয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। পুলিশি সূত্র জানাচ্ছে, সারদার ২৫০টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মধ্যে ২৫-৩০টিতে কোনও টাকাই নেই।
খুব সামান্য টাকা পড়ে আছে ৫০টি অ্যাকাউন্টে। তা হলে টাকা গেল কোথায়?
বিধাননগরের গোয়েন্দা-প্রধান অর্ণব ঘোষ জানান, সারদার সম্পত্তির ফরেন্সিক অডিট করানোর জন্য টেন্ডার ডাকা হয়েছে। সেই টেন্ডারে সাড়া দেওয়া অডিট সংস্থাগুলির মধ্য থেকে একটিকে বেছে নেওয়া হবে। এর আগে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা, ‘সত্যম’-এর আর্থিক কেলেঙ্কারিতে দক্ষিণ ভারতের একটি অডিট ফার্মকে দিয়ে ওই সংস্থার সম্পত্তির হিসেব করানো হয়েছিল।
ঘটনাচক্রে সারদার তদন্তে নেমে ইতিমধ্যেই সেই অডিট ফার্মের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন বিধাননগরের তদন্তকারীরা। সম্পত্তি সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার জন্য সুদীপ্তকে জেরা করেই যাচ্ছে পুলিশ। বুধবার সন্ধ্যাতেও বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার ও গোয়েন্দা-প্রধান অর্ণববাবু নিউ টাউন থানায় সুদীপ্তকে জেরা করেন।
|