বাজার থেকে একশো টাকা তুললে মাত্র ১০ টাকা লগ্নি করেছে সারদা গোষ্ঠী। বাকি ৯০ টাকাই চলে গিয়েছে এজেন্টদের কমিশন, কর্মীদের বেতন, আগের আমানতকারীদের পাওনা আর রাজনৈতিক নেতাদের চাঁদা দিতে। ফলে সারদা গোষ্ঠী পাততাড়ি গোটানোর পরে তাদের সম্পত্তি হিসেব নিতে গিয়ে এখন চোখ কপালে ওঠার দশা আয়কর দফতরের কর্তাদের।
আয়কর দফতর সূত্রে বলা হচ্ছে, সারদার মতো ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থাগুলি সাধারণ ভাবে জমি, ফ্ল্যাট অথবা রিসর্টে বিনিয়োগ করে। সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন নামে বা বেনামে কত টাকা জমি-বাড়িতে ঢেলেছেন, তার পুরো হদিস মেলেনি। তবে প্রাথমিক তদন্তের পরে দফতরের কর্তাদের অনুমান, সেই অঙ্কটা সারদার মোট তোলা টাকার দশ শতাংশের বেশি নয়। ফলে সংস্থার সম্পত্তি বিক্রি করে আমানতকারীদের টাকা মেটানোর যে কথা সুদীপ্তবাবু সিবিআই-কে লেখা চিঠিতে বলেছেন, তা বাস্তবে অসম্ভব বলেই আয়কর কর্তাদের মত।
তা হলে বাকি টাকা যেত কোথায়? আয়কর দফতর সূত্রে বলা হচ্ছে, আমানতের ৩৫ শতাংশ যেত এজেন্টদের কমিশন দিতে। ৪০ শতাংশ টাকায় মেটানো হতো আগে যাঁরা লগ্নি করেছেন তাঁদের পাওনা। সংস্থার কর্মীদের বেতন দিতে এবং রাজনৈতিক নেতাদের তুষ্ট রাখতে ১৫ শতাংশ টাকা খরচ করতেন সুদীপ্ত। সিংহভাগই অন্য খাতে চলে যাওয়ায় আমানতকারীদের টাকা মেটাতে প্রতিদিন আরও বেশি পরিমাণ টাকা তোলার দরকার হয়ে পড়ছিল সারদার। বেশ কিছু দিন ধরেই সেই পরিমাণ টাকা বাজার থেকে তুলতে পারছিল না তারা। তারই জেরে ভরাডুবি। |
আয়কর দফতরের এক কর্তা জানান, গত দু’বছরে টাকা জমার পরিমাণ কমে আসায় সুদীপ্তবাবু বুঝতে পারছিলেন, তাঁর দিন শেষ হয়ে আসছে। সব খরচ মিটিয়ে যে টাকা তাঁর হাতে থাকত, তা দিয়ে প্রতিশ্রুতি মতো চড়া সুদে টাকা ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর আর ছিল না।
নিজের ব্যবসা বজায় রাখতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পিছনে কী ভাবে টাকা ঢেলেছিলেন সুদীপ্তবাবু, তার একটি উদাহরণ দিয়ে আয়কর দফতর সূত্রে বলা হচ্ছে, সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত এক সাংবাদিক তথা সাংসদ ২০০৯-’১০ আর্থিক বছরে চার লক্ষ টাকা আয়কর দেন। ২০১০-’১১ সালে তাঁর আয়করের পরিমাণ বেড়ে হয় ৩৮ লক্ষ টাকা।
বিজ্ঞাপন খাতেও বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করেছিল সারদা। খবরের কাগজ, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ঢালাও বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে লগ্নির দাবি করা হতো। কিন্তু বাস্তবে সেই সব লগ্নি পারতপক্ষে করাই হয়নি। আয়কর দফতরের ওই কর্তা বলেন, “বিজ্ঞাপনে নানা ব্যবসায় টাকা বিনিয়োগের কথা বলা হলে, মানুষ ভাববে ওই সংস্থার আর্থিক শ্রী বৃদ্ধি হচ্ছে। উৎসাহিত হয়ে মানুষ সারদা গোষ্ঠীর বিভিন্ন প্রকল্পে আরও টাকা রাখবেন। বিজ্ঞাপনের জন্য যে টাকা খরচ করা হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা মানুষ বিনিয়োগ করেছে সারদা গোষ্ঠীতে।”
আয়কর দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, এই পরিস্থিতিতে সম্পত্তি বিক্রি করে আমানতকারীদের টাকা মিটিয়ে দেওয়ার যে দাবি সুদীপ্তবাবু করেছেন, তা প্রায় অবাস্তব। কারণ, সাধারণ ভাবে এই ধরনের সংস্থা যত সংখ্যক আমানতকারীর কাছ থেকে টাকা তোলে আর যে পরিমাণ জমি কেনে, তার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে না। ফলে জমি খুব চড়া দামে বিক্রি হলেও অধিকাংশ আমানতকারীই টাকা মেটানো যায় না। তা ছাড়া, সারদা গোষ্ঠী একই জমি একাধিক লোককে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। সে ক্ষেত্রে টাকা ফেরতের সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে পড়ছে বলেই আয়কর কর্তাদের মত।
আয়কর দফতর সূত্রে খবর, সারদা গোষ্ঠীর ১৬০টি সংস্থার আয়ব্যয়ের হিসেবে কষে দেখার কাজ শুরু হয়েছে। তবে সেই কাজেও বিস্তর অসুবিধা। কারণ, সারদা গোষ্ঠীর অনেক সংস্থাই নিয়মিত তাদের আয়ব্যয়ের হিসেব আয়কর দফতরে জমা দেয়নি। |