ধর্মঘট মানেই তরাই-ডুয়ার্সের চা বাগানের সব কাজকর্ম স্তব্ধ হয়ে যাবে, এই ধারনাটা কিছুটা হলেও পাল্টে দিলেন শ্রমিকদের একাংশ। অন্তত বুধবার উত্তরবঙ্গের সমতলের বহু বাগানে স্বাভাবিক কাজকর্ম হওয়ার ঘটনা যেন সে কথাই বলছে। বীরপাড়া, কোহিনুর, ধওলাঝোরা জয়ন্তী, রায়ডাক, ফাঁসখোয়া, চুনিয়া এবং কুমারগ্রামের সংকোশ নিউল্যান্ডস, কুমারগ্রাম চা বাগানে দিনভর ছিল কাজের মেজাজ। এমনকী, যে সব বাগান বন্ধ ছিল, সেখানেও শ্রমিকদের একাংশ কাজে যোগ দিতে গিয়েছেন বলে মালিকপক্ষের তরফে দাবি করা হয়েছে। যদিও ধর্মঘটে সামিল হওয়া আদিবাসী বিকাশ পরিষদের রাজ্য সভাপতি বিরসা তিরকের দাবি, “তরাই-ডুয়ার্সের চা বলয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক কাজে যোগ দেননি। এতেই বোঝা যাচ্ছে বাগানে আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।”
সাধারণ চা শ্রমিকদের অনেকে অবশ্য ধর্মঘটের ফলে দাবি মিটবে এমন আশা করছেন না। যেমন বীরপাড়ার নাংডালা চা বাগানের পিলি ইন্দোয়ার। তিনি বুধবার ধর্মঘট অগ্রাহ্য করে কোদাল নিয়ে বাগানের নালা কেটেছেন। পিলির কথায়, “আগে কত ধর্মঘট হল। আমাদের অবস্থা ফিরল না। খালি বড় বড় স্লোগান দিলে হবে? কাজে না গেলে টাকা মিলবে না। না খেয়ে থাকলে কে দেখতে আসবে!”
বাগানের হাটখোলা লাইনের গঙ্গা ওঁরাও-এর একই মত। তাঁর কথায়, “হরতালের কথা শুনেছি। তবে লাল পার্টি কী কারণে তা ডেকেছে জানি না। আর তা নিয়ে আমারা মাথা ঘামাই না। কাজ না করলে সংসার অচল হয়ে পড়বে।”
পিলি ও গঙ্গার মতো ডুয়ার্সের বীরপাড়া থানার ওই বাগানের ১ হাজার ১৫৬ জন শ্রমিক এদিন কাজে যোগ দেন। গাছে পাতা নেই। তাই পাতা তোলা বন্ধ। পাতা না থাকায় কারখানা এখন রং করার কাজ চলছে। চা গাছ পরিচর্যা ছাড়া কাজ নেই। ৪৮৫ হেক্টরের ওই বাগানে এখন শুধু শীতকালীন পরিচর্যার কাজ চলছে। তাও মাত্র চার-পাঁচ ঘণ্টা। বাগানের ম্যানেজার রঘুনন্দনপ্রসাদ থাপিয়াল বলেন, “একশো শতাংশ কর্মী কাজে এসেছেন। যদিও চায়ের মরসুম নয় বলে ধর্মঘট নিয়ে চিন্তায় ছিলাম না তবুও ভাল দিকটা হল সকলে কাজ করেছেন।” শুধু নাংডালা চা বাগান নয়, উত্তরবঙ্গের ২৭৪টি চা বাগানের ৯০ শতাংশ চা শ্রমিক এদিন কাজ করেছেন বলে দাবি করেছেনন উত্তরবঙ্গের যুগ্ম শ্রম আধিকারিক মহম্মদ রিজওয়ান। তিনি বলেন, “ধর্মঘটের প্রভাব তেমন পড়েনি। শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় কাজ করেছেন।” শ্রম দফতরের হিসাবে ২৭৪টি চা বাগানের মধ্যে ২৩১টি বাগানে কাজ হয়েছে। ৩১ বাগান বন্ধ ছিল। ১২টি চা বাগানে আংশিক কাজ হয়েছে।
বাগান সূত্রে জানা গিয়েছে, যে হেতু বছরের অনাবৃষ্টির জন্য এ সময়ে বাগান থেকে চা পাতা তেমন ভাবে মেলে না, তাই ফি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে চা বাগানে বার্ষিক ছুটি দেন কর্তৃপক্ষ। কোথাও ১৩ দিন। আবার কোনও বাগানে ১৪ দিন। বড় অংশের শ্রমিকরা সে ছুটি কাটান। নাংডালার মত অনেক বাগান সদ্য খুলেছে। আবার অনেক বাগানের বেশীর ভাগ শ্রমিক ছুটিতে রয়েছেন। তবে ডুয়ার্সের এথেলবাড়ি চা বাগানের ৫৪২ শ্রমিকের মধ্যে যে দেড়শো জন ছুটি পাননি, তাঁদের সকলে এদিন কাজ করেছেন বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।
এক সময় সিটু, আরএসপি দলের দখলে থাকা ডুয়ার্সের অধিকাংশ চা বাগানে বামেদের ধর্মঘটের ডাকে কোন সাধারণ শ্রমিক নেতাদের উপেক্ষা করে কাজে যোগ দেওয়ার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতেন না। এখন কিছুটা হলেও ভয় কাটিয়ে শ্রমিকরা যে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা ভাবছেন, সে কথা ধর্মঘটের দিনের ছবিই যেন বুঝিয়ে দিল। তবে মালবাজারের বামনডাঙা, বাতাবাড়ি, গুডহোপ, মালনদী, কৈলাশপুর, ওদলাবাড়ির মতো চা বাগানগুলি ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ। |