নিধিরাম ঘাড়ে তদন্তের
বোঝা, দিশাহারা সিআইডি
দ্যপ্রকাশিত একটি আমেরিকান বেস্টসেলারে মজেছেন রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের এক প্রাক্তন কর্তা। নাসিম তালেবের বই ‘অ্যান্টি-ফ্রেজাইল: থিংস দ্যাট গেন ফ্রম ডিজঅর্ডার’। যা বলছে, অস্থিরতা বা বিশ্ৃঙ্খলার মধ্য দিয়েও কেউ কেউ নতুন করে ঘুরে দাঁড়ায়। ভাঙনের মধ্যে দিয়েই গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সিআইডি-তদন্তের কার্যকারিতা নিয়ে খাস হাইকোর্টের অনাস্থার পটভূমিতে এই আশাবাদই ভরসা রাজ্যের ওই পোড়খাওয়া গোয়েন্দা-কর্তার।
বিস্তর তদন্তের বোঝায় ন্যুব্জ রাজ্য পুলিশের এই সংস্থাটি। তাদের দক্ষতা নিয়েও প্রশাসনের ঘরে-বাইরে প্রশ্ন। হাইকোর্ট গুড়াপের হোমে মহিলাদের অপমৃত্যুর তদন্তভার কেড়ে নিয়ে সিবিআইকে দেওয়ায় সিআইডি-কে নিয়ে সেই প্রশ্নগুলি আরও জোরালো ভাবে উঠে এসেছে। অথচ প্রায় অর্ধেক পদই খালি এমন একটা সংস্থার কপালে অদক্ষতার তকমা জুটলেও, দক্ষতার দাওয়াই নিয়ে যে মহাকরণ ভাবিত নয়, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানান, আলাদা করে সিআইডি-র সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে অভিযোগ আসেনি। এখনই সিআইডি-র পরিকাঠামো বাড়ানোর বিষয় নিয়ে কোনও ভাবনা-চিন্তা নেই।”
এডিজি, সিআইডি শিবাজী ঘোষও পরিকাঠামোজনিত সমস্যার অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁর কথায়, “যথেষ্ট পরিকাঠামো বলে আবার কিছু হয় নাকি! শূন্য পদ ফাঁকা তো পুলিশের প্রতিটি বিভাগ, বিভিন্ন থানাতেও রয়েছে।” এটা ঘটনা যে, সীমিত পরিকাঠামো নিয়েও গত ১০-১২ বছরে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্তে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সিআইডি। কিন্তু কয়েক বছর আগের সিআইডি-র সঙ্গে বর্তমানের ফারাকটাও বিবেচনা করা দরকার বলে মনে করছেন পুলিশ-কর্তারা। সাফল্যের স্মৃতিচারণায় এক পুলিশকর্তা যেমন বলছেন, “কেউ কি ভাবতে পেরেছিল, এ রাজ্যের গোয়েন্দারাই খাদিম-কর্তা অপহরণের সঙ্গে আমেরিকার ৯/১১-র হামলার মূল চক্রী মহম্মদ আটার যোগসাজশের বিষয়টা ধরে ফেলবেন! ওই ব্যবসায়ীর মুক্তিপণের বেশ খানিকটা আটার কাছে পৌঁছেছিল বলেও জানতে পারে সিআইডি-ই।”
কেন পিছিয়ে
তদন্তকারী অফিসারের আকাল
ডিআইজি (অপারেশনস) পদ খালি
বাহিনীর ল্যাপটপ, জিপিএস অকেজো
জেলা কার্যালয়গুলি বেহাল
অতিরিক্ত মামলার বোঝা
আর এক পুলিশকর্তার বক্তব্য, লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের মতো প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড-এর আখ্যা কোনওকালে সিআইডি-র কপালে জোটেনি। তবু কঠিন পরিস্থিতিতে পুলিশের এই শাখাটি কিন্তু বারবার নিজেদের প্রমাণ করে ছেড়েছে।”
ব্যক্তিবিশেষের ভূমিকা সেখানে কম নয়। ২০০৫-০৬ সালে দু’জন আইপিএস-কর্তার উপস্থিতি সিআইডি-র চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছিল। ডিআইজি (অপারেশন্স) রাজীব কুমারের নেতৃত্বে বহু জটিল অপরাধের তদন্তে ঝটিতি সাফল্য মেলে। সল্টলেকে দিনের আলোয় অপহৃত স্কুলছাত্রী রোমা ঝওয়ার অক্ষত অবস্থায় মুক্ত হন। গুঞ্জন ঘোষের মতো একাধিক খুনের অভিযুক্তর কোমরেও দড়ি পড়ে। আর ডিআইজি (সিআইডি) সৌমেন মিত্রের উদ্যোগে ঢেলে সাজা হয় গোটা বাহিনীকেই। ঝকঝকে অফিস থেকে শুরু করে উন্নত প্রযুক্তি-নির্ভর কন্ট্রোলরুম সবই বাহিনীর মনোবল চাঙ্গা করতে সাহায্য করেছিল। রাজীব কুমারের পরে ডিআইজি (অপারেশন্স) সিদ্ধিনাথ গুপ্তের নেতৃত্বেও রাজ্যে বিপুল চোরাই অস্ত্র-ভাণ্ডার উদ্ধার-সহ বেশ কিছু তদন্তে সাফল্য মিলেছে।
এখন কী হাল সেই সিআইডি-র? পুলিশ সূত্রের খবর, সিআইডি-তে তদন্তের অভিযান চালানোর মূল পরিকল্পনাকারী, ডিআইজি (অপারেশন্স)-এর পদটিই দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। ডিআইজি (স্পেশ্যাল) অস্থায়ী ভাবে সেই দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। ডিএসপি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই প্রায় অর্ধেক শূন্য পদ। সৌমেন মিত্র বা রাজীব কুমারের সময়ের পরে প্রযুক্তি-নির্ভর তদন্তের সরঞ্জামও কেনা হয়নি। পুরনো সরঞ্জাম বেশ কিছু অকেজো অবস্থায় পড়ে।
রাজ্য পুলিশের এক কর্তার কথায়, “সব থেকে বড় সমস্যা, দক্ষ সাব-ইনস্পেক্টর বা দারোগার অভাব। পুলিশের যে কোনও বাহিনীতে সাব-ইনস্পেক্টররাই মূল চালিকাশক্তি। আমজনতার কাছেও দারোগারাই পুলিশের মুখ। যা পরিস্থিতি, কনস্টেবলের সংখ্যা কমিয়ে বাড়তি সাব-ইনস্পেক্টর থাকলে সিআইডি-র চেহারাই পাল্টে যেত।” রাজ্য পুলিশ বা লালবাজারে বিভিন্ন শীর্ষ পদে দায়িত্ব সামলানোর অভিজ্ঞ রয়েছে, এমন এক পুলিশকর্তার বক্তব্য, “সাব-ইনস্পেক্টরের আকাল বাম আমল থেকেই শুরু হয়েছিল। অনুপভূষণ ভোরা রাজ্য পুলিশের ডিজি থাকার সময় থেকেই আমরা তৎকালীন রাজ্য সরকারকে অফিসারদের শূন্য পদে নিয়োগের বিষয়টি বোঝাতে পারিনি।” ফলে, ক্রমশ কনস্টেবল থেকে উন্নীত (ডিপার্টমেন্টাল) অফিসারদের সংখ্যা বাহিনীতে ভারী হয়েছে। এক পুলিশকর্তার বক্তব্য, “ব্যতিক্রম থাকলেও তুলনায় স্বল্পশিক্ষিত ডিপার্টমেন্টাল অফিসারেরা অন্য অফিসারদের তুলনায় মেধায় খাটো।”
রাজনীতির পালাবদলেও সিআইডি-র হাল পাল্টাতে পারেনি। বরং পুলিশকর্তাদের একাংশের মত, উদ্ভট কিছু কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারে গোড়া থেকেই সিআইডি-র প্রতি বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে। তৃণমূল-শিবিরের ধারণা, বাম আমলে বিরোধী নেতা-নেত্রীদের মোবাইলে আড়ি পাতার কাজে সিআইডি-কেই ব্যবহার করা হতো। ফলে ক্ষমতায় এসেও তারা সিআইডি-র পরিকাঠামো বাড়ানোয় আমল দেয়নি। কিন্তু তা-বলে সিআইডি-র উপরে নিত্যনতুন দায়িত্ব চাপানোয় ভাটা পড়েনি। লোহাচুর কেলেঙ্কারি বা ডুয়ার্সের শিপচুতে মোর্চা-সমর্থকদের উপরে পুলিশের গুলিচালনার মতো রাজনৈতিক মামলার তদন্তভারও সিআইডি-কেই দেওয়া হয়েছে।
নতুন কোনও স্পর্শকাতর মামলার দায়িত্ব ঘাড়ে চাপলেই অবধারিত ভাবে হাতে গোনা ক’জন দক্ষ অফিসারের ডাক পড়ে। সিআইডি সূত্রের খবর, সুশান্ত ঘোষের মামলার তদন্ত শেষ না-হতেই লক্ষ্মণ শেঠকে ধরতে ঝাঁপাতে হয় ওই অফিসারদের। মালদহের রতুয়ার অপহরণের তদন্ত শুরু করতে না-করতেই কলকাতার ভবানীভবনের (সিআইডি-র সদর দফতর) কোনও অফিসারকে দিনাজপুরের খুনের দায়িত্বও নিতে হয়। আবার বারাসতে মহিলার ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ উঠলে সেই তদন্তও সামলাতে হয়। সিআইডি-র এক কর্তার কথায়, “হাতে-থাকা দক্ষ অফিসারদের এক-একজনের কম করে চার-পাঁচটি করে মামলা। তার সঙ্গে আরও চার-পাঁচটি গুরুতর অভিযোগের তদন্তে (যেমন গার্ডেনরিচ-কাণ্ড) তাঁদের যুক্ত করা হয়। এর বাইরে দুষ্কৃতীদের বিভিন্ন গ্যাংয়ের খোঁজ-খবর রাখা, তদন্তের পরে আদালতে বিচার চলাকালীন কী ঘটছে, সে-দিকে খেয়াল রাখা থেকে শুরু করে উর্ধ্বতন কর্তাদের বিভিন্ন নির্দেশ পালন লেগেই থাকে।”
সিআইডি-র কাজের চাপের প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রসচিবের বক্তব্য, “সে তো আমার উপরেও বিস্তর কাজের চাপ। সন্ধের পরও অফিসে থাকতে হয়। এ সবই পেশাগত ঝক্কি।” পুলিশের অন্য বিভাগের সঙ্গে সিআইডি-র তুলনা করতে গিয়ে লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের এক অফিসার কিন্তু স্বীকার করেন, অপরাধীদের খুঁজতে বা তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে উন্নত সরঞ্জাম থেকে শুরু করে পর্যাপ্ত অফিসারের সংখ্যা, কোনওটাতেই লালবাজার ও ভবানীভবন এক মাপে আসে না। তাঁর কথায়, “মাঝেমধ্যে ঠাট্টা করে সিআইডি-র অফিসারদের বলি, তোদের হোমিসাইড বা গাড়িচুরিদমনের মতো গুরুত্বপূর্ণ শাখায় যত অফিসার, লালবাজারের রিসেপশনে তার থেকে ঢের বেশি অফিসার রাখা থাকে।”
লালবাজারের শীর্ষ স্তরের এক কর্তাও বলছেন, যে যাই বলুন, সিআইডি-র তুলনায় লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের কাজ অনেক সহজ। লালবাজারে অনেক ছোট জায়গায় কাজ করতে হয়। আর ভবানীভবনে বসে কোচবিহার বা মুর্শিদাবাদের খবর রাখা, কি চাট্টিখানি কথা! জেলায় জেলায় সিআইডি-র অধীনে ডিডিআই থাকলেও, তারা হাতে-গোনা ইনস্পেক্টর বা সাব-ইনস্পেক্টর নিয়ে কাজ করে। ওই ক’জনের সাহায্যে গোটা জেলার অপরাধপ্রবণতার হিসেব রাখা কার্যত অসম্ভব।
পুলিশকর্তারা এ-ও মনে করেন যে, কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের পাশে সিআইডি-র স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপ-কে এক রকম দুয়োরানি করে রাখা হয়েছে। মাওবাদী দমনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থাকলেও তাদের কোনও ঝুঁকি-ভাতা পর্যন্ত নেই। কিন্তু ২০০৯ সালেই দেখা গিয়েছিল, কলকাতা পুলিশ জঙ্গলমহলে গিয়ে ছত্রধর মাহাতোকে ধরে আনার সঙ্গে-সঙ্গে সিআইডি-ও কলকাতায় তেলুগু দীপকের মতো বড় মাপের নেতাকে পাকড়াও করে।
এক পুলিশকর্তার কথায়, “মনের জোর আর চেষ্টাতেও কিন্তু অনেকটা হয়। মরিয়া হয়ে ঝাঁপালেও সাফল্য আসে।” নিধিরামের দশায় এসে পৌঁছলেও এই সিআইডি-ই হয়তো ফের ঝাঁপিয়ে তদন্তে সাফল্য কুড়িয়ে নেবে, ভাবছেন কোনও কোনও পুলিশ-কর্তা! যেন আধা খালি গ্লাসেই পুরো তেষ্টা মেটানোর স্বপ্ন! তবু ওই আশাটুকুই যা হাতের পেন্সিল।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.