কলকাত্তাইয়া বুলির দাপটে কোণঠাসা জেলার বাংলা
সে বার প্রেসিডেন্সি কলেজে মাতৃভাষা ভাষা দিবসে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন সোহিনী ঘোষ ও তাঁর বন্ধুরা। সোহিনীর বাড়ি বাঁকুড়ায়। কথাবার্তায় আঞ্চলিক টান স্পষ্ট। সে জন্য বন্ধুদের কাছ থেকে অহরহ খোঁটা শুনতে হত। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী সোহিনী বলেন, “ভাষা দিবসে সে বার সকলে মিলে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গাইছিলাম। মনে হয়েছিল, মাতৃভাষা নিয়ে সকলের এত আবেগ। অথচ, আমার উচ্চারণ বিধিতে আঞ্চলিক ছাপ থাকায় কত না হেনস্থা হতে হয়।”
সোহিনী এখন মুখের ভাষা বদলে ফেলেছেন। শুধু আজও দেশের বাড়ি গেলে প্রাণ খুলে পুরনো টানে কথা বলেন সকলের সঙ্গে।
এ যেন ঘরের মধ্যে ঘর।
বাংলাতেই কথা বলে পুরুলিয়া, জলপাইগুড়ি, দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, বসিরহাটের মানুষ। যদিও প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব উচ্চারণবিধি, শব্দ ও তার ব্যবহার। শহর কলকাতা বা তার সংলগ্ন এলাকার একটাই বাংলাভাষা। বিবেকানন্দ যাকে বহু দিন আগে ‘কলকেতার ভাষা’ বলেছিলেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এড়াতে জেলার ছেলেমেয়েরা দ্রুত বদলে ফেলেন তাঁদের ‘মাতৃভাষা।’
বাংলা ছবিতে বাঙাল টান বসানো হয় কমেডি চরিত্রেই। ‘ওগো শুনছ’ ছবিতে তেমনই
একটি দৃশ্যে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।—ফাইল চিত্র।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জ্যোতির্ময় সমাজদারের অভিজ্ঞতায়, দূরবর্তী জেলা বা মফস্সলের ছেলেমেয়েদের কাছে এ হল এক ধরনের ‘কালচারাল শক।’ কলকাতায় উচ্চশিক্ষার জন্য এসে একে তো পড়াশোনার বিপুল চাপ নিতে হয়। তার উপরে ভাষাগত কারণে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগে অনেকে। গুটিয়ে নেয় নিজেকে। না হলে ‘সমগোত্রীয়’ মানুষ খুঁজে নিয়ে তৈরি করে ফেলে ছোট্ট ‘উপদল।’ ‘গেঁয়ো’ তকমা দূর করতে কেতাদূরস্ত পোশাক-আশাক পরতে শুরু করে এক দল। মুখের ভাষাও বদলে নেয়। শহুরে হয়ে ওঠার মরিয়া চেষ্টা চলে। জ্যোতির্ময়বাবু বলেন, “সকলেই বাংলায় কথা বললেও উচ্চারণবিধির তারতম্যের জন্য কারও কারও উপরে এক ধরনের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা থাকে শহরের মানুষের। এটা উদারতার অভাব তো বটেই।”
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে শিবপুর থেকে কলকাতায় পড়াশোনার জন্য এসে (তখনও তৈরি হয়নি দ্বিতীয় হুগলি সেতু) এই সমস্যা ভুগিয়েছিল নাট্যকর্মী সুমন মুখোপাধ্যায়কে। ইদানীং কলকাতার সঙ্গে জেলার ভাষাগত বা সাংস্কৃতিক দূরত্ব কমছে বলেই মনে করেন তিনি। টেলিভিশন বা রেডিও-র তাতে একটা বড় ভূমিকা আছে বলে মত সুমনের।
বনগাঁর সোমা ভট্টাচার্যের বিয়ে হয়েছিল সল্টলেকে। ছোটবেলা থেকে নিজস্ব টানে বাংলা বলে অভ্যস্ত। দেখলেন, শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁর সেই ভাষায় ঠিক যেন স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন না। বদলে ফেলতে হয়েছিল সোমার মাতৃভাষার আঙ্গিক। এখন তিনি পড়ান বেহালার একটি কলেজে। সেখানে কখনও ভুলক্রমেও নিজের দেশের বাড়ির টানে যাতে কথা বলে না ফেলেন, সচেতন থাকতে হয় সোমাকে।
“এটা অত্যন্ত অন্যায়” প্রসঙ্গ শুনে রীতিমতো ক্ষিপ্ত সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়। বললেন, “এটুকু সহনশীলতা, শ্রদ্ধাবোধ কেন থাকবে না শহরের মানুষের? আঞ্চলিক রীতি মেনে উচ্চারণ তো কোনও দোষের নয়। এই বৈচিত্র্যকে উৎসাহই দেওয়া উচিত। উপহাস করা খুবই অনুচিত।”
কিন্তু ‘উচিত নয়’ বলেই তো হল না। বাস্তবটা এড়াবে কে?
বাংলাদেশ থেকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক নিয়ে পড়াশোনা করতে এসেছেন রাজকমল। তাঁর আক্ষেপ, “আমাদের দেশে মাতৃভাষা নিয়ে এত বড় একটা আন্দোলন সংগঠিত হল। এত জনের রক্ত ঝরল। সারা পৃথিবীতে মাতৃভাষার অধিকার স্বীকৃত হল। অথচ, পশ্চিমবঙ্গে সেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষই দেখি নিজের ভাষার বৈচিত্র্যের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল নন। কলকাতা শহরে এসে বাঙাল উচ্চারণে কথা বলার জন্য আমাকে যথেষ্ট হেনস্থা হতে হয়।” জলপাইগুড়ি থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “আমার মতো অনেকেই জেলা থেকে কলকাতায় এসে এখানকার মতো করে বাংলা বলতে শেখে। কই, জলপাইগুড়িতে গিয়ে কলকাতার কোনও মানুষকে তো সেখানকার মতো করে বাংলা বলতে শুনিনি।” শহুরে বাংলা উচ্চারণ বিধির এই ‘প্রচ্ছন্ন দাদাগিরি’ ভাবায় অভিজিতের মতো গাঁ-গঞ্জ থেকে আসা বহু মানুষকে।
অনেকে অবশ্য থোড়াই পরোয়া করেন কলকাতার দাদাগিরিকে।
সে বার কলকাতায় এক অরাজনৈতিক মঞ্চে বক্তৃতা করছিলেন প্রবীণ এক মানুষ। দীর্ঘ বক্তৃতার পরে ‘খাস বাঙাল’ মানুষটি যখন নামলেন মঞ্চ থেকে, সামনের সারিতে বসে থাকা এক তরুণী বললেন, “বড্ড ভাল ইংরেজি বলেন আপনি। কিন্তু বাংলায় অন্য একটা টান।”প্রবীণ মানুষটি উত্তরে বলেছিলেন, “ও যে আমার মায়ের ভাষা। বদলাতে পারব না।” সে দিন বক্তা, প্রাক্তন স্কুল শিক্ষামন্ত্রী কান্তি বিশ্বাস। শ্রোতা, রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.