সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে
মানুষ চায় না, তবু বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গই বনধ
’৬৬-র সেপ্টেম্বর।
সকাল থেকেই জ্যোতি বসুর বাসভবনের সামনে কয়েক’শো বিক্ষোভকারী। রিক্সাওয়ালা, হকার, দোকানদাররা স্লোগান তুলছেন, ‘‘বনধের দু’দিন খাব কী? জ্যোতিবাবু জবাব দিন।”
ঘুম ভেঙে যায় বিরোধী দলনেতার। বেরিয়ে এসে বলেন, “এখানে বিক্ষোভ না করে মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের
বাড়ি যাও। ওঁর জন্যই তো বনধ করতে হচ্ছে।”
স্লোগান তবু চলতেই থাকে “বনধের ডাক ফিরিয়ে নাও। খেয়ে-পরে বাঁচতে দাও।” সে বার সরকারি নীতির বিরুদ্ধে হরতাল ছিল ৪৮ ঘণ্টার। সাংবাদিকেরা জ্যোতিবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আগে তো ২৪ ঘণ্টা করতেন, এ বার ৪৮ ঘণ্টা কেন?” জ্যোতিবাবুর জবাব, “২৪ ঘণ্টা বনধ করে দেখেছি, কোনও ফল হয় না। তাই ৪৮ ঘণ্টার বনধ ডাকা হয়েছে।”
২০১৩ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বুঝতে পেরেছেন, ৪৮ ঘণ্টা বনধ করেও লক্ষ্য পূরণ হয় না। দীর্ঘদিন ধরে বাংলায় বনধ হতে হতে এই কর্মসূচির সঙ্গে আম জনতার আর সংযোগ নেই। দিল্লিতে কংগ্রেস ও বিজেপির শীর্ষ নেতারা বরং আজ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বনধে সক্রিয় না হওয়াকে এক নতুন রাজনীতি বলে মনে করছেন। সলমন খুরশিদ, কপিল সিব্বল থেকে জয়রাম রমেশ সকলেই মনে করেন, মানুষের উপর বনধের রাজনীতি চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়, এমনকী স্বাধীনতার পরেও দীর্ঘ সময় বনধের রাজনীতিতে স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল। এখন জনসমর্থন ছাড়াই রাজনৈতিক দলগুলি বনধের ডাক দেয়। আর বাস-ট্রাম জ্বালিয়ে সাফল্য খোঁজে।
জ্যোতিবাবু মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় এক বার বলেছিলেন, অক্সফোর্ড অভিধানে ‘ঘেরাও’ শব্দটি বামপন্থীদের অবদান। ১৯৪৬ সালের অগস্ট মাসে বিধানসভার সামনে বিরাট বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছিল। বিধানসভায় সব গেট বন্ধ। মিছিল করে আসা বহু মানুষ ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। বিধানসভার নবীন সদস্য জ্যোতি বসুকে পুলিশ ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। তার পাঞ্জাবি ছিঁড়ে গিয়েছিল।
মুখ্যমন্ত্রী সোরাবর্দি জ্যোতিবাবুকে ভিতরে নিয়ে আসেন। ছেঁড়া জামা নিয়েই বিধানসভায় ঢুকেছিলেন জ্যোতিবাবু। সে দিন কিন্তু মানুষের বিক্ষোভে স্বতস্ফূর্ততা ছিল। পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে শহরে বনধ পালিত হয়েছিল।
’৭৭ সালে সিপিএম ক্ষমতায় এল। বাস-ট্রামের ভাড়া বাড়ার প্রতিবাদে যাঁরা হরতাল করতেন, তাঁরাই ভাড়া বাড়ালেন। ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে যখন বিরোধীদের আন্দোলন শুরু হল, তখন বামফ্রন্টের পুলিশ রাস্তায় নামল। প্রথম দিকে দলীয় কর্মীরা ‘বাস-ট্রামে বাড়তি ভাড়া দিতে হবে’, ‘বামফ্রন্ট সরকার জিন্দাবাদ’ বলে চেঁচিয়েছিল। কিন্তু তার পর দেখা গেল, শুধু দল নয়, প্রশাসনকে দিয়ে আন্দোলনকারীদের মোকাবিলা করা হচ্ছে। ’৮৩ সালের ১৫ মার্চ বাস-ট্রামের ভাড়া বাড়ে। তার আগের দিন কার্ল মার্কসের মৃত্যুর একশো বছর পূর্ণ হয়। তৎকালীন রাজ্যপাল ভৈরবদত্ত পাণ্ডের বাসভবনের সামনে বসানো জার্মান প্রজাতন্ত্রের দেওয়া মার্কস-এঙ্গেলসের মূর্তিতে মালা দিয়ে জ্যোতিবাবু গেলেন বিধানসভায় বাজেট পেশ করতে। সেই বাজেটে চাল-গমের উপরেও কর বসানো হল। এর প্রতিবাদে সিপিএমের বিরুদ্ধে কংগ্রেস বনধ ডাকে। তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তীর নাম ছিল ‘হরতাল দা’। রাজ্য কংগ্রেস নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “হরতাল দাদাদের বিরুদ্ধে আমরা হরতাল ডাকছি।”
’৮৪ সালে জেতার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনের শুরু। মমতাও একের পর এক বনধ ডেকেছেন বাম শাসনের প্রতিবাদে। তত দিনে বঙ্গ-সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে বনধ। বুদ্ধবাবু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে অবশ্য বনধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এ কথা বিজেপির শীর্ষ নেতারাও স্বীকার করেন। তথ্য-প্রযুক্তি দফতরকে বনধের আওতার বাইরে রাখা সম্ভব হয়েছিল বুদ্ধবাবুর আমলে। মানব মুখোপাধ্যায় ছিলেন তখন সেই দফতরের মন্ত্রী। শোভন দত্তগুপ্তের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, দীর্ঘ স্থায়িত্বের ফলে সিপিএমে একটি সঙ্কট তৈরি হয়েছিল। দল ও প্রশাসনের মধ্যে একটা ‘কেরানি কমিউনিজম’ তৈরি হয়েছিল। বনধকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে কতটা ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে সিপিএমের ভিতরে বিতর্কটি এখনও বহাল।
মমতা এখন মুখ্যমন্ত্রী। এখন তিনিও বনধের ঘোর বিরোধী। এক তৃণমূল সূত্র বলছে, “আমাদের দলে নাগপুর বা আলিমুদ্দিন নেই। দিদিই শেষ কথা। তিনিও বন্ধ-বিরোধী অবস্থান নিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাইছেন, রাজ্যের উন্নয়নের জন্য এ বার বনধের মহাসমাপ্তি ঘটানো হোক।” ডেরেক ও ব্রায়ান বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের বন্ধ অসফল। বিমান চলেছে, রাস্তাঘাটে যান চলাচল হয়েছে। এ-ও এক পরিবর্তন।” বুদ্ধবাবু চেয়েছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ চাইছেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের অভ্যাস থেকে বাঙালি কি বেরোতে চাইছে?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.