|
|
|
|
|
সংঘাতের আবহ কাটতেই পথে বাঙালি
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
|
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য: ১। শ্যামল চক্রবর্তী: ০!
বুধবার রাজ্যে সাধারণ ধর্মঘটের চিত্র দেখে এই রকমই স্কোরশিট লিখছেন রাজনীতির কারবারিদের একাংশ! যাঁদের মতে, বুদ্ধবাবুর সিপিএমের কাছে হেরে গেল শ্যামলবাবুদের সিটু!
ধর্মঘটের বাংলায় এ দিন হাজিরা ভালই ছিল সরকারি অফিস, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে। বিয়েবাড়ি বা জরুরি পরিষেবার স্টিকার ছাড়াই রাস্তায় বেরিয়েছিল অনেক সাধারণ গাড়ি। চলেছে বাস-ট্রামও। তবে এটা ঠিক যে, আর পাঁচটা সাধারণ দিনের তুলনায় যাত্রী ছিল কম। কিন্তু সব মিলিয়ে বন্ধ ঘিরে বাঙালির ভয় যে ভাঙছে, সেই ইঙ্গিত এ দিন মিলেছে। যার জেরে আজ, বৃহস্পতিবার ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনে বাঙালি আরও বেশি সংখ্যায় কাজে বেরোবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কেন ভয় ভাঙছে বাঙালির? |
|
অন্য দিনের মতো ভিড়ে ঠাসা নয়। তবে আসন খালিও ছিল না বুধবার বেলা এগারোটার মেট্রোয়। —নিজস্ব চিত্র |
রাজনীতির কারবারিদের একটা বড় অংশের মতে, রাজ্য রাজনীতির দুই প্রধান মুখই বনধ বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন, তাই। ধর্মঘট মোকাবিলায় বেশ কিছু দিন ধরেই কড়া মনোভাব নিয়ে চলছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এ বারও তাঁর সেই অবস্থান বজায় ছিল। তার সঙ্গে সঙ্গেই দলের ভিতরে-বাইরে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর সাম্প্রতিক কথাবার্তায় বার্তা যাচ্ছিল, তিনিও ধর্মঘটের বিপক্ষে। রাজ্যের দুই প্রধান যুযুধান দলের দুই শীর্ষ নেতা-নেত্রীর ধর্মঘট-বিরোধী সুর মিলে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ এই প্রথম পথে বেরোনোর সাহস পেয়েছেন বলে অনেকে মনে করছে।
এ বারের ধর্মঘটে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেখা যায়নি সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের পিকেটিং। বুদ্ধবাবুর তীব্র ধর্মঘট-বিরোধিতাই সিপিএম-কে নিজেদের গুটিয়ে রাখতে বাধ্য করেছে বলে দলের একাংশের ব্যাখ্যা। আগে রাস্তার উপরে বেঞ্চ-চেয়ার পেতে বসা লাল ঝান্ডাধারীদের দেখেই আমজনতা ভয় পেত। তৃণমূল নেত্রীও তাঁর দলকে সংযত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। শাসক-বিরোধী কেউই রাস্তায় না-থাকায় সংঘাতের ভয় ছিল না। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের ভাবনাচিন্তায়।
সম্প্রতি যে সব সমাবেশে বুদ্ধবাবু গিয়েছেন, তার প্রতিটিই ডাকা হয়েছিল সাধারণ ধর্মঘটকে সামনে রেখে। কিন্তু কোনও সভাতেই ধর্মঘট সফল করার ডাক দিয়ে একটি শব্দও খরচ করতে দেখা যায়নি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে! দলের মধ্যেও তিনি জোর সওয়াল করেছেন দু’দিন ধর্মঘট না-করার জন্য। রাজনীতির কারবারিদের একাংশ মনে করছেন, আলিমুদ্দিনকে ধর্মঘটের বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে যথেষ্টই সফল বুদ্ধবাবু। কেউ কেউ এমনও বলছেন, “মমতার মতো বুদ্ধদেববাবুর যদি দলের উপরে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকত, তা হলে সিটুর ধর্মঘট সিপিএমের মধ্যে আদৌ কোনও প্রভাব ফেলতে পারত না!” বুদ্ধবাবুর অবস্থানে সমর্থন রয়েছে সিপিএমের নতুন প্রজন্মের। দলের এক তরুণ নেতার মন্তব্য, “বনধের রাজনীতি তো আমাদের পিছনের দিকেই নিয়ে যাবে!” |
|
ফিরহাদ হাকিম |
নির্বাচনী প্রচারে |
উপেন বিশ্বাস |
দিল্লিতে |
রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় |
অসুস্থ, বাড়িতে |
স্বপন দেবনাথ |
কালনায় |
হুমায়ূন কবীর |
উপনির্বাচনে প্রার্থী |
সাবিত্রী মিত্র |
মালদহে |
কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী |
উপনির্বাচনে প্রার্থী |
গৌতম দেব |
উত্তরবঙ্গে |
সুকুমার হাঁসদা |
পশ্চিম মেদিনীপুরে |
শান্তিরাম মাহাতো |
পুরুলিয়ায় |
চন্দ্রনাথ সিংহ |
নির্বাচনী প্রচারে |
সুব্রত সাহা |
নির্বাচনী প্রচারে |
নুরে আলম চৌধুরী |
দিল্লিতে |
আব্দুল করিম চৌধুরী |
ইসলামপুরে |
হিতেন বর্মন |
কোচবিহারে |
|
ধর্মঘট নিয়ে তাঁর মনোভাব যে অনেকটা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মতোই, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের মন্তব্যে তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, “ঠিক কী বিষয় নিয়ে বন্ধ ডাকা হয়েছিল, সেটাই জানি না! তবে ওঁরা (ধর্মঘটীরা) যে বিষয়গুলির বিরোধিতা করছেন, আমিও তার বিরোধী। ওই সব নীতির প্রতিবাদ করেই আমরা কেন্দ্রীয় সরকার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। কিন্তু সহজ উপায়ে বন্ধ করে অন্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া সমর্থন করি না আমি! আমি ও আমার সরকার বন্ধের বিরোধী।”
বুদ্ধ-মমতার সুর কোথাও যে মিলে গিয়েছে, তা অস্বীকার না-করেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক প্রবীণ সদস্যের মন্তব্য, “আমরাও রাস্তায় ছিলাম না, তৃণমূলও ছিল না। ভালই হয়েছে! সংঘাত ছাড়াই ধর্মঘট হয়েছে!” রাজনীতির কারবারিদের অনেকের মতে, বাঙালি এমনিতেই ছুটিপ্রিয়। তার উপরে রক্তপাত-অশান্তি-সংঘাতের আশঙ্কা বন্ধের দিনে তাদের ঘরবন্দি করে রাখত। এ বার মমতা-বুদ্ধ যুগলবন্দি তাদের একটা অংশের মনে সাহস জুগিয়েছে। যার জেরে আজ, বৃহস্পতিবার ধর্মঘটের প্রভাব আরও কমে আসার ইঙ্গিতও মিলছে।
ভাষা দিবসকে উপলক্ষ করে বুদ্ধবাবুদের বিরোধিতায় এমনিতেই আজ পরিবহণকে ছাড় দিয়েছে সিটু। বাধা দেওয়ার কথা নয় স্কুল-কলেজেও। এবং এই প্রশ্নে বাকি ধর্মঘটকারী বাম ইউনিয়নগুলিকে পাশে পেতে সক্ষম হয়েছে সিটু। বাম সূত্রের খবর, শ্রমিক-কর্মচারীদের ছাতা-সংগঠন ১২ জুলাই কমিটির আওতাধীন ২৮টি ইউনিয়নের মধ্যে অন্তত ২৫টিই জানিয়েছে, আজ তারা আর ধর্মঘটে সামিল হতে চায় না। সিটু নেতৃত্বও তাতে কোনও আপত্তি করতে পারেননি। এই নিয়ে ঘোষণায় না-গেলেও বাস্তব ছবিটা তাঁরা বুঝে নিয়েছেন।
প্রকাশ্যে ধর্মঘটকারী ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব অবশ্য প্রত্যাশিত ভাবেই দাবি করেছেন, ধর্মঘট সফল। সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামলবাবুর দাবি, “অনেক হুমকি, ভয়-ভীতি উপেক্ষা করেই ধর্মঘটে মানুষ সাড়া দিয়েছেন। প্রথম দিকে রাস্তায় গাড়ি বেরিয়েও পরে উঠে গিয়েছে।” |
|
ধর্মঘটে নেই যাত্রী পরিবহণ, রেলে ছাড় বহাল |
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সহ সর্বত্র ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে ছাড় |
অন্যান্য জরুরি পরিষেবায় ছাড় বহাল |
|
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা অবশ্য অন্য কথা বলছেন। তাঁদের বক্তব্য, ট্রেড ইউনিয়নগুলি ধর্মঘট ডাকলে রাজনৈতিক দলগুলির সক্রিয় সহযোগিতাতেই তা সাধারণ ধর্মঘটের চেহারা নেয়। বুদ্ধবাবুর দৌলতে যে সক্রিয়তা থেকে সিপিএম এ বার খানিকটা পিছিয়ে ছিল। সিপিএম সূত্রের খবর: দলের অন্দরে বুদ্ধবাবুর মত, যে সব প্রশ্নে এ বার সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়েছে, তার বেশ কয়েকটি ট্রেড ইউনিয়নের এক্তিয়ারেই পড়ে না। তিনি যেমন ধর্মঘটের প্রভাব শিথিল করতে দলে সক্রিয় ছিলেন, তেমনই দু’দিনের ধর্মঘটের যৌক্তিকতা নিয়ে সিপিএমের রাজ্য কমিটিতে প্রশ্ন উঠেছিল। প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে ধর্মঘট-বিরোধিতার যুক্তি ক্রমশ সবল হওয়া এবং শাসক দলেরও ধর্মঘটের বিপক্ষে থাকা এই দুইয়ের সহাবস্থান রাজ্যে বনধ-সংস্কৃতি ঠেকানোর ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সহায়ক হয়েছে বলে রাজনৈতিক নেতাদের একটা বড় অংশের ব্যাখ্যা।
যার জেরে মহাকরণ-সহ রাজ্য সরকারি দফতরে এ দিন গড় উপস্থিতির হার ছিল ৮৮ শতাংশ। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য দাবি করেছেন, উপস্থিতি ১০০ শতাংশ। দোকানপাট খোলা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, “আগে কেউ দোকান খুলত না, ভয় পেত। একটা আতঙ্কের পরিবেশ কাজ করত। সেটা অনেকটাই কেটেছে। যাঁরা দোকান খোলেননি, তাঁরা আশা করি খুলবেন। আদালত তো বলে দিয়েছে, বনধে কোনও ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তা ছাড়াও, অপেক্ষা না-করে আমরা জানিয়ে দিয়েছি, সরকার নিজেই ক্ষতিপূরণ দেবে।” মুখ্যমন্ত্রীর আরও মন্তব্য, “আদালত আগেই নির্দেশ দিয়েছে, এই বনধ বেআইনি। আমি শুধু বলব যে, আইন আইনের পথে চলবে। কারও গায়ে একটা ইট পড়লে সরকার পাশে দাঁড়াবে।”
এই আশ্বাসেও অবশ্য ক্ষতির আশঙ্কা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় ছোটখাটো দোকানপাট কিছু কিছু খুললেও কলকাতার বেশির ভাগ বাজার বন্ধ ছিল। তা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, “বাজে কথা! আমি নিজে গিয়ে দেখে এলাম। ওপরে ওপরে দেখবেন না। ভিতরে ঢুকুন।” তিনি স্ট্র্যান্ড রোড, হাজরা, বেহালা, ঠাকুরপুকুর, রাসবিহারী ঘুরে এসেছেন বলে জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, “আগে ১০০% দোকানই বন্ধ থাকত। এ দিন অন্তত ৪০% দোকান খোলা ছিল। মানুষ বন্ধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। মানুষ কথায় কথায় বনধ চায় না।” |
|
|
|
|
|