প্রবন্ধ ২...
চার দশক পর এটুকু পারাই তো বিরাট অর্জন
ঢাকার একটি ব্যস্ততম সড়কের মাঝখানে গত ৫ ফেব্রুয়ারি এসে দাঁড়ালেন প্রথমে কয়েকশো ব্লগার, তার পর আরও হাজার খানেক মানুষ। তাঁদের হাতের ব্যানারে লেখা “যুদ্ধাপরাধীদের এই রায় আমরা মানি না, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই।” তাঁরা নিজেরাও তখন ভাবতে পারেননি, কী ভাবে এই জটলা থেকে তৈরি হয়ে উঠবে একটা গোটা আন্দোলন, লক্ষ লক্ষ মানুষ যোগ দেবে তাতে, বিশ্বের সাম্প্রতিক সামাজিক আন্দোলনগুলির (New Social Movements) তুলনা টানা হবে এর সঙ্গে। হঠাৎই মানুষের মুখে মুখে বদলে গেল শাহবাগের নাম: ‘প্রজন্ম ৭১ চত্বর’, কিংবা তহরির স্কোয়্যারের অনুসরণে, ‘শাহবাগ স্কোয়্যার’।
শুরুতে এঁদের পিছনে কোনও সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক শক্তি ছিল না। অথচ এঁদের দাবিগুলি প্রথমাবধিই রাজনৈতিক। একটা কথা অবশ্য ব্লগাররা ভাল করেই বুঝে গিয়েছিলেন: রাষ্ট্রক্ষমতা অনুকূল না থাকলে এই লড়াই শুধু গানবাজনা ও জমায়েতের শক্তির ভিত্তিতে বেশি দূর আগাতে পারবে না, তাই ক্রমে দেখা গেল, রাজনৈতিক শক্তির অপ্রত্যক্ষ সাহায্য নিতে তাঁরা মোটেও দ্বিধা করলেন না। ক্ষমতাসীন আওয়ামি লিগ এই আন্দোলনকে স্বাগত জানাল। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি প্রথমে বিরোধিতা করলেও শেষে আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে এল, যুক্তি দিল, আন্দোলনকে বর্তমান সরকার “ব্যবহার করছে” তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার মূল আন্দোলনকে চাপা দেওয়া জন্য। আর প্রধান বামপন্থী দলগুলি তো এর সঙ্গে প্রথম থেকেই এককাট্টা। দেখা গেল, জনজাগরণের বেগ যাতে ব্যাহত না হয়, তার জন্য রাষ্ট্রের যথেষ্ট আনুকূল্য: মিউনিসিপ্যালিটি ব্যবস্থা করল চলন্ত ‘টয়লেট কার’-এর। সশস্ত্র আক্রমণ বা বোমা হামলা আটকানোর জন্য সিসিটিভি, মেটাল ডিটেক্টর-সহ তীক্ষ্ণ নজরদারির ব্যবস্থা করল সরকার।

এখন পর্যন্ত এই আন্দোলন বহু দল-বহু মতের প্ল্যাটফর্ম, যার ন্যূনতম ভিত্তি হিসেবে ধরা যায় তিনটি দাবিকে: ১) সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও তাদের সর্বোচ্চ দণ্ড (মৃত্যুদণ্ড) দান, ২) যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাত-এ-ইসলামিকে নিষিদ্ধ করা, ৩) জামাত-এর হাজার হাজার সহযোগী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বয়কট করা। তবে প্রথম দাবিটিই মূল। জামাত-এ-ইসলাম ও বিএনপি-র অঙ্গ দুই ছাত্র সংগঠন (জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ইসলামি ছাত্রশিবির) ছাড়া অন্যান্য ছাত্র সংগঠন এবং দুটি ব্লগার গোষ্ঠীর দুই প্রতিনিধি এর প্রধান অংশীদার।
আন্দোলনের মূল দাবিটি বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের সঙ্গে এত গভীর ভাবে জড়িত যে গোটা দেশের মানুষকেই তা নাড়া দিয়েছে, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাঁরা জড়ো হয়েছেন শাহবাগে। বাংলাদেশের এখনকার তরুণ প্রজন্ম মূলত মুক্তিযুদ্ধের পর জন্ম নেওয়া ছেলেমেয়েরা তারা যে দলে দলে যোগ দিয়েছে তাই নয়, ‘ট্র্যাডিশনাল’ নেতৃত্ব ও সংগঠনগুলিকে পাশে সরিয়ে রেখে নিজেরা প্রথম সারি দখল করেছে। যে ছেলেটি কখনও রাজনীতি করেনি, কিংবা রাজনীতির প্রতি যার এক ধরনের তীব্র অনীহাই এত দিন টের পাওয়া যেত, সেও কিন্তু এখানে এসেছে বিনা দ্বিধায়। অর্থনীতি বা রাজনীতির দীর্ঘমেয়াদি জটিল বিষয়গুলি বা ক্ষমতার জটিল লড়াই ইত্যাদি কিছুই তার কাছে অত জরুরি নয়, সবচেয়ে জরুরি তার স্বদেশের জন্মের পিছনে যে মুক্তিযুদ্ধের কথা সে জানে, জামাত-রাজাকার-আলবদরদের বিচার শেষ করে সেই মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা। জন্মাবধি শুনে-আসা বহু গল্প, বহু অভিজ্ঞতা, বহু দুঃখ-প্রতিহিংসা-বীরত্বের ব্যক্তিগত ও জাতীয় বাস্তবের নির্যাস হয়ে উঠছে তাদের একটিমাত্র স্লোগান: ফাঁসি-ফাঁসি-ফাঁসি চাই! স্লোগানটি নিষ্ঠুর, মানবতাবাদীদের মোটেও এ স্লোগান শুনতে ভাল লাগবে না, কিন্তু বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে এই স্লোগান এখন অস্তিত্বের শিকড়ের টান, তাদের একমাত্র প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সেন্টিমেন্ট। তাই স্বামী-স্ত্রী ছোট-ছোট শিশু নিয়ে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে নির্দ্বিধায় বলছেন, “আমি চাই আমার বাচ্চারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে ধারণ করেই বেড়ে উঠুক।” হিংসা ঠেকানো যায়নি, কয়েকটি হত্যা ইতিমধ্যেই ঘটে গিয়েছে: শান্তিপূর্ণ পথে এই আন্দোলনকে কী ভাবে পরের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, জল্পনা চলছে।
ভবিষ্যতের প্রশ্নে একটা কথা মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে একটা অদ্ভুত গোঁজামিল আছে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্র কোনও বৈষম্য করবে না এ কথা উল্লেখ করেও কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামকেই গ্রহণ করেছে। অন্য অনেক পুঁজিবাদী দেশের মতোই এ দেশেও এখন দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা, দুই দলেরই অর্থনৈতিক আদর্শ মোটের উপর কাছাকাছি। তবে একটি দলের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক বিকাশের দীর্ঘ ইতিহাস আছে, অন্য দলটির জন্ম সেনাশাসনের ছত্রছায়ায়, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর জোরালো সাহচর্যের মধ্যে। এমনকী জামাতের দুই যুদ্ধাপরাধীকে (এই মুহূর্তে বিচারাধীন) মন্ত্রিসভায় ঠাঁইও দিয়েছিল তারা। এ দিকে, আওয়ামি লিগ মুক্তিযুদ্ধের ধারায় গঠিত দল হলেও ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছে, এবং ভোটের স্বার্থে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলিকে (এমনকী জামাত-এ-ইসলামিকেও) অনেক ক্ষেত্রে ‘কনসেশন’ দিয়েছে।
বর্তমান আন্দোলনের অভিঘাতে এই জায়গাটায় পরিবর্তন ঘটে কি না, সেটাই একটা বড় প্রশ্ন। এই মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধী-প্রশ্নে বিএনপি থমকে দাঁড়িয়েছে, আওয়ামি লিগও বর্ধিত দৃঢ়তা দেখাচ্ছে। এই আন্দোলন কোনও ভাবে জিইয়ে রাখলে, তরুণ প্রজন্মের মনে যদি আন্দোলনের মূল চেতনা কিছুটা শিকড় ছড়ালে আগামী নির্বাচনী রাজনীতিতেও তার প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশের রাজনীতির আর একটি গলার কাঁটা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নটি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যদি যুদ্ধাপরাধী-বিষয়ে তাদের মত পাল্টিয়ে জামাতকে পরিত্যাগ করে, এবং আওয়ামি লিগও নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে কিছুটা এগিয়ে আসতে সম্মত হয়, তা হলে হয়তো ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতার সন্ধান মিলবে। জামাত তখন একা হয়ে পড়বে, নতুন প্রজন্মের দাবিগুলি পূরণ করা তখন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষে সহজতর হবে। বাইরের দেশের প্রভাবের বিষয়টিও ভুলে গেলে চলবে না। এখন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে ভারতের সমর্থন লক্ষ করা গেলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের ভূমিকা তেমন স্পষ্টনয়। আচ্ছা, ভাবা যাক তো, যদি বাইরের প্রশ্রয় না মেলে? এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎও যদি তত উজ্জ্বল না হয়? তবু একটা জিনিস তো থেকে যাবে। এই কয়েক দিনের মধ্যে যতটুকু মিলেছে, সেটা হারিয়ে যাবে না। এ এক বিরাট অর্জন: ‘অপহৃত’ বাংলাদেশকে চার দশক পর শাহবাগ চত্বরে আবার নতুন করে খুঁজে পাওয়া!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.