বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র এখন শাহবাগ। ঢাকার এই চৌরাস্তার মোড়ে তরুণ ব্লগারদের গণজাগরণ-মঞ্চকে ঘিরে লক্ষ মানুষের ঢল নামছে প্রতিদিন বিকেল হতেই। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই থাকছেন গভীর রাত পর্যন্ত। হাজার কয়েক তরুণ-তরুণী রাস্তাতেই রাত কাটাচ্ছেন। এই জাগরণের ঢেউ লেগেছে সারা দেশে। মফসস্লে, একেবারে উপজেলা পর্যায়েও, তরুণদের উদ্যোগে জাগরণ-মঞ্চ তৈরি হয়েছে এবং সব বয়সের মানুষ তাতে যোগ দিচ্ছেন।
বোঝা যাচ্ছে, ইতিহাসের আরেকটি সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। এ দেশের মানুষ ইতিহাসের ভাঙাগড়ায় অংশ নিতে বারবার রাজপথে নেমে এসেছে। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন তরুণদের ওপর কেন এত ভরসা মানুষের? কেননা, বার বার তাদের আশাভঙ্গের কারণ হয়েছেন গতানুগতিক ধারার রাজনীতিবিদরা বাম-ডান-মধ্যপন্থী সকলেই। এই আনকোরা তরুণদের বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা এবং আপসহীন অবস্থান তাদের আকৃষ্ট করেছে। মূল একটি দাবিকে ঘিরেই তাদের আন্দোলন, সেটি স্পষ্ট ভাবেই তাঁরা বলছেন। তাদের যে কোনও গোপন অ্যাজেন্ডা নেই অর্থাৎ মাঝপথে আপস করে আন্দোলনের ইতি টানার সম্ভাবনা যে নেই, সেটাও মানুষকে আশ্বস্ত রাখছে।
বাংলাদেশের মানুষ বারবার স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে জেগে উঠেছে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের কথা বলা যায় নজির হিসেবে। প্রতিবারই ঐতিহাসিক বিজয়ও অর্জিত হয়েছে। এ বারেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার দাবি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ ঘটে চলেছে দেশে। |
পরপ্রজন্ম। শাহবাগ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। |
কিন্তু এ বারে, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রায় চল্লিশ বছর পরে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণকারী দল আওয়ামি লিগের নেতৃত্বাধীন সরকার রয়েছে ক্ষমতায়। প্রশ্ন হল, আইন এবং ব্যবস্থার অধীন একটি নিয়মতান্ত্রিক সরকার তার অবস্থান থেকে এ দাবি কী ভাবে পূরণ করবে। অতীতের সব গণ-জাগরণ, গণ-আন্দোলনে সরকার ছিল প্রতিপক্ষ। তাকে প্রতিরোধ করে, এমনকী অপসারণ করেই জনতার বিজয় এসেছে।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে যারা বিচারাধীন আছেন, তাঁদের সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ বিচারে মৃত্যুদণ্ডের রায় হলে আওয়ামি লিগ ও তার শরিকদের আপত্তি বা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তরুণ এবং তাদের সঙ্গে লক্ষ মানুষ সর্বোচ্চ শাস্তি এবং জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে কণ্ঠ মিলিয়ে জাতিকে একাত্তরের অবস্থানে ফিরিয়ে এনেছে। তাদের অন্তরে নিহত বুদ্ধিজীবী, ত্রিশ লক্ষ শহিদ বা নির্যাতিতা নারীদের ফরিয়াদ যেন তরতাজা স্মৃতি। সেই সঙ্গে আবেগপ্রবণ লেখনী আর জীবন্ত সব ছবির মাধ্যমে রাজপথে মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত ঢলকে উজ্জীবিত রাখছে দেশের সকল গণমাধ্যম। বিভিন্ন পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলের সার্বক্ষণিক কাভারেজ আন্দোলনের উদ্দীপনাকে শুধু জিইয়ে রাখেনি, পুরো জাতিকে এর মধ্যে শরিক রেখেছে। এ ভাবে একটা জাতীয় ঐক্যও তৈরি হচ্ছে। একাত্তরে যেমন কিছু পাকিস্তানপন্থী ছাড়া বাকি সকলেই ছিল বাংলাদেশের পক্ষে আজ গণমাধ্যম ও রাজপথে সেই অবস্থারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু হয়তো প্রকৃত বাস্তব এত সহজ ও সরল নয়। এ পর্যায়ে সঙ্গত ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, এ আন্দোলনের সুফল কে কী ভাবে পাচ্ছেন? এবং রাজপথ অবরোধ করে এই যে আন্দোলন, তার সমাপ্তি টানা যাবে কী ভাবে?
অতীতের সব গণ-আন্দোলনের মতোই এ পর্যন্ত মনে হচ্ছে এ বারও, সরকারে থেকেও আওয়ামি লিগই সুফল সবচেয়ে বেশি পাবে। একতরফা এ সুফল ভোগ করার কারণ দেশের অপর বড় দল বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে পরিচিত জামায়াত-এ-ইসলামির সঙ্গে জোট এখনও বজায় রাখছে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমল থেকে যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা করার যে অভিযোগ, তা নিয়েও দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করতে তারা উৎসাহী নয় বলেই মনে হয়। আর যে ছোট দলগুলো আওয়ামি লিগের সঙ্গে জোট রয়েছে, তাদের সামর্থ্য নেই আলাদা ভাবে এর সুফল ভোগ করার।
তবে বিএনপি এই অবস্থানেই থেকে গেলে এ আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ সমাধান কঠিন হয়ে যাবে। বিএনপি’কে পাশে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জামায়াতের প্রত্যাঘাতের তীব্রতা বাড়ছে। বাংলাদেশের দীর্ঘ দিনের অস্থির ও সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির এটাই হোক চূড়ান্ত পর্ব, এমনটাই অনেকে চাইছেন। তরুণদের আন্দোলন সে রকম একটি সম্ভাবনার দুয়ার কিন্তু খুলে দিয়েছে। তবে সে দায় তরুণরা একক ভাবে তা নিতে পারবে না। আর অরাজনৈতিক তরুণদের সৃষ্ট এ আন্দোলনের ফল হিসেবে জামায়াত শিবিরের সঙ্গে চূড়ান্ত বোঝাপড়ার দায় রাজনৈতিক দল, বিশেষত আওয়ামি লিগ এখনই নিতে কতটা প্রস্তুত এবং কতটা ইচ্ছুক, তা-ও স্পষ্ট নয়।
শাহবাগ আন্দোলনের দাবিগুলোর রাজনৈতিক সারসংক্ষেপ করলে মূল একটি দাবিই দাঁড়ায়: বাংলাদেশের রাজনীতির আদর্শিক ভিত্তি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনার মূল উপাদান হল ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্র। এখন হয়তো এর সঙ্গে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক স্বাধিকার রক্ষার প্রসঙ্গটিও আসবে। এতে জামায়াতের সঙ্গে আর না জড়িয়ে চলমান আন্দোলনে শামিল থাকার কৌশল নিলে এ গণ-জাগরণের এ পর্যায়ে সুষ্ঠু সমাপ্তি টানা যেত।
কিন্তু দলের ইতিহাসের প্রভাবে আচ্ছন্ন নেতৃত্ব এ ধরনের সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে না। গঠন-পর্ব থেকেই বিএনপি-র প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামি লিগ। ফলে এর বিপরীতে রাজনীতি দাঁড় করাতে গিয়ে জিয়াউর রহমান ও তাঁর সঙ্গীরা পুরনো মুসলিম লিগের পথে হেঁটেছেন, এমনকী মাঠ-পর্যায়ে আওয়ামি লিগকে ব্যতিব্যস্ত রাখার জন্যে জামায়াত শিবিরের পুনরুজ্জীবনে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে গেছেন।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির ইতিহাস মূলত বিএনপি ও আওয়ামি লিগের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ক্ষমতার জন্য তীব্র লড়াইয়ের ইতিহাস। তরুণদের চলমান আন্দোলন এই সংঘাত ও অসহিষ্ণুতার অবসান ঘটানোর একটা সুযোগ তৈরি করেছে। সেটা কাজে লাগাতে হলে বিএনপি’কেই পরিবর্তনের পথে বড় পদক্ষেপ নিতে হত। কিন্তু তারা ইতিহাসের ডাক উপেক্ষা করে অভ্যস্ত পথেই যেন চলতে চাইছে। যুদ্ধাপরাধীদের চরম শাস্তির দাবিটাকে নিয়ে রীতিমতো গণ-আন্দোলন গড়ে তুলে তরুণরা বুঝিয়ে দিয়েছে যে, এটি কেবল তাদের দাবি নয়, এটি মোটামুটি বাংলাদেশের দাবি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি এ ভাবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ার একটি সহজ কারণ হল সাধারণ মানুষ গৌরবের অংশীদার হতে চায়, গ্লানির বোঝা বহন করতে চায় না। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ মানুষের প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য থেকে এ রকমই ধারণা হয়।
বিএনপি সাধারণ মানুষের এই ভাবাবেগকে উপেক্ষা করে জামায়াতকেই সমর্থন দিয়ে গেলে শাহবাগের আন্দোলনকে দীর্ঘমেয়াদে টেনে নেওয়ার প্রশ্ন দেখা দেবে। আর তাতে যে উদ্যোগটি নির্দলীয় স্বতঃস্ফূর্ততার জন্যে জনগণকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিল, তার পক্ষে সে চরিত্র ধরে রাখা হবে কঠিন। ঢাকার বাইরে অনেক জায়গাতেই আওয়ামি লিগ বা সমমনা অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সহযোগিতা ছাড়া আন্দোলনকে জামায়াতি প্রত্যাঘাতের ঝাপটা থেকে রক্ষা করাই হবে মুশকিল। এই সূত্র ধরেই বলা যায়, এই আন্দোলন আওয়ামি লিগের জন্যে চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করে সুযোগও তৈরি করেছে। সুযোগটা হল কালো টাকা, পেশিশক্তি, দখলদারি ও টেন্ডারবাজি অর্থাৎ ক্ষমতার প্রতাপ আর দুর্নীতির গাঁটছড়া-বাঁধা যে গতানুগতিক দূষিত রাজনীতির প্রকোপ বেড়েছে, তা থেকে দলকে সম্পূর্ণ বের করে আনা। দ্বিতীয়ত, এ আন্দোলন জাতীয় জীবনে যে বৃহত্তর ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি করেছে, তাকে মূল্য দিয়ে সংকীর্ণ স্বার্থ-বিবেচনা বাদ দেওয়া। আওয়ামি লিগ বড় দল, তাই তার মধ্যে নানা ধরনের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সমাবেশ। ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতির আবহে নানা স্বার্থের কাছে তাদের রাজনীতি বাঁধা। তরুণদের আন্দোলন জানান দিচ্ছে, এই গতানুগতিক ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতি আর চলতে পারে না।
এই দাবির দিকে লক্ষ রেখে বিএনপি এবং আওয়ামি লিগ দেশের দুই প্রধান দল যদি সময়ের দাবি অনুযায়ী সৃজনশীল হতে না পারে, তবে এ আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের নতুন কোনও তাৎপর্য বয়ে আনতে পারবে না। তবে, সেই হতাশাজনক পরিস্থিতি তৈরি হলে ‘ত্রাতার’ ভূমিকায় নামার জন্যে সামরিক বাহিনী যাতে কোনও সুযোগ করে না নিতে পারে, সেই দিকে নজর রেখে তরুণ প্রজন্মকে প্রয়োজনে কৌশল পরিবর্তন করতে হবে, দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন চালানোর কথা ভাবতে হবে।
|